ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহজে ব্যবসার সুযোগ দরকার
Published: 26th, June 2025 GMT
ব্র্যান্ডিং, বিপণন ও গ্রাহক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের বাজার বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এছাড়া কর ব্যবস্থার জটিলতা, হিসাব সংরক্ষণ ও রিটার্ন দাখিলের ঝক্কি অনেক উদ্যোক্তাকে নিরুৎসাহিত করছে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে কটেজ, মাইক্রো, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) খাত অন্যতম প্রাণশক্তি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আঞ্চলিক উন্নয়ন, নারীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এ খাতের অবদান অপরিসীম। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ এ খাত থেকে আসে। জিডিপিতে সিএমএসএমইয়ের অবদান ২৫ শতাংশের বেশি। শিল্পনীতি ২০১০-এ এমএসএমই খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। কভিড-১৯ মহামারির সময় যখন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় যাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ ৫ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, যার পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল এই সিএমএসএমই।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ খাতটি দীর্ঘদিন ধরে নানাবিধ কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর মধ্যে অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, প্রযুক্তি গ্রহণে পিছিয়ে পড়া এবং দুর্বল নীতিগত সমর্থন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ উদ্যোক্তাই জামানতবিহীন ঋণ পেতে হিমশিম খান, আর উচ্চ সুদের হার এবং জটিল প্রক্রিয়া ঋণগ্রহণ আরও জটিল করে তোলে। বাস্তবতা হলো, উদ্যোক্তারা চাহিদাভিত্তিক ও কার্যকর ঋণ ব্যবস্থার আশায় থাকলেও নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা তাদের পিছিয়ে দেয়। অথচ এ খাতের উদ্যোক্তাদের ৯৭ শতাংশ নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে থাকেন, যা তাদের ওপর আস্থা রাখার যথেষ্ট কারণ তৈরি করে দেয়।
এসএমই খাতে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং বাজারে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন আধুনিক অবকাঠামো এবং দক্ষ শ্রমশক্তি। বিদ্যুৎ, পানি, পরিবহনসহ মৌলিক সুবিধার ঘাটতি এবং প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি উদ্যোক্তাদের ব্যয় বাড়ায় এবং উৎপাদনশীলতা কমায়। পণ্যের বাজারজাতকরণেও এ খাত পিছিয়ে রয়েছে। ব্র্যান্ডিং, বিপণন ও গ্রাহক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের বাজার বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এছাড়া কর ব্যবস্থার জটিলতা, হিসাব সংরক্ষণ ও রিটার্ন দাখিলের ঝক্কি অনেক উদ্যোক্তাকে নিরুৎসাহিত করছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) দেশের সিএমএসএমই খাতের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। আমরা বিশ্বাস করি, নীতিনির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং উদ্যোক্তা-সক্ষমতা বাড়ানোর একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি করা জরুরি, যা সিএমএসএমইদের জন্য সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ফলপ্রসূ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ইতোমধ্যে অর্থায়ন প্রক্রিয়া সহজ করতে ডিসিসিআই এনআইডি-সংযুক্ত ডিজিটাল ট্রেড লাইসেন্স, ক্যাশ-ফ্লোবেইজড লেন্ডিং এবং জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছে। এছাড়া উপজেলাভিত্তিক বিপণন কেন্দ্র, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও আমরা গুরুত্ব আরোপ করছি।
কর ব্যবস্থা সহজ ও বাস্তবমুখী করতে সম্প্রতি ডিসিসিআই ‘এমএসএমই ট্যাক্স কোড’ প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পুনঃবিনিয়োগে উৎসাহ পান এবং কর পরিশোধ সহজতর হয়। এই কোডে করপোরেট করহার কমানো, অর্জিত-নয় এমন আয়ের কর অব্যাহতি, অগ্রিম আয়করের পুনর্বিন্যাস ও স্বয়ংক্রিয় রিটার্ন দাখিলের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি এসএমই নীতিমালা-২০১৯ সংশোধন করে নতুন ‘সিএমএসএমই নীতিমালা’ প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। যেখানে এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানি-সহায়ক নীতিমালা, সেবা খাতের জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা এবং কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
দেশের বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের দায়িত্ব হলো সিএমএসএমই খাতকে সংস্কারের প্রবণতায় যুক্ত করে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা। সেজন্য প্রয়োজন ডিজিটাইজেশন, অর্থায়ন, প্রণোদনা, ট্যাক্স, নীতিগত সংস্কারসহ একটি বৃহত্তর ‘সিএমএসএমই-রিলিফ প্যাকেজ’ কার্যকর করা; যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ করতে পারে। যখন দেশে একটি নতুন ধারার সূচনা ঘটেছে, তখন শুধু সরকারি উদ্যোগ নয় বেসরকারি খাত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অংশীদারদের সৃজনশীল ও যুগোপযোগী ভূমিকা গ্রহণ আবশ্যক। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা সিএমএসএমই খাতকে একটি শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারব বলে আশা রাখি। একটি বাস্তবভিত্তিক, তথ্যনির্ভর ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কাঠামো গড়ে তুলতে পারলে আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি সিএমএসএমই খাতই হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নতুন মেরুদণ্ড।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মত মত স এমএসএমই খ ত র ব যবস ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম পর্বত ‘আমা দাবলাম’ জয় করছেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির (২৭)। গত ৪ নভেম্বর নেপাল সময় দুপর ১টার দিকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পর্বতের চূড়া স্পর্শ করেন তিনি।
পর্বতারোহণ বিষয়ক অর্গানাইজেশন রোপ ফোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়। তার এই অভিযানে সঙ্গী হিসাবে ছিলেন রোপ ফোরের আরেকজন তরুণ পর্বতারোহী আবরারুল আমিন অর্ণব।
আরো পড়ুন:
রঙ হারাচ্ছে অদম্য মেধাবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন
উপজেলায় এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেলেন অনুরাগ
আমা দাবলাম খাড়া বরফ দেয়াল, গভীর ক্রেভাস, ঝুলন্ত বরফ খণ্ড এবং কঠিন আবহাওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পর্বত হিসেবে পরিচিত। তৌকিরের এই অভিযানটি ছিল বাংলাদেশি পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক গৌরবময় সংযোজন।
চূড়ায় পৌঁছার প্রতিক্রিয়ায় তৌকির বলেন, “আমা দাবলাম আমার কাছে শুধু একটা পর্বত নয়, এটা ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার যাত্রা। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম, মনে হলো এটি শুধু আমার সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশের সব তরুণের স্বপ্নের স্পন্দন।”
তিনি বলেন, “আমার এই অভিযানটা ছিল পৃথিবীর সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাদের জীবনটা কেটে যায় অন্যের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে এবং চার দেয়ালের আলোতে পৃথিবী দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আসা সব প্রাণী শক্তিশালী। আসুন, ডিপেন্ডেবল এই মানুষগুলোর ওপর আরো বিনয়ী হই, ভালোবাসা এবং সাহায্যে তৈরি করি তাদের নতুন পৃথিবী।”
যেভাবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
গত ১২ অক্টোবর দুঃসাহসিক এই অভিযানের জন্য দেশ ছাড়েন তৌকির। এরপর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় তার মূল অভিযান। হিমালয়ের পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে ট্রেকিং করে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২২ অক্টোবর। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তৌকির শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কৌশল। যা এক্লিমাটাইজ রোটেশন নামে পরিচিত।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ২৯ অক্টোবর সামিটের কথা থাকলেও ২৭ অক্টোবর থেকে হিমালয়ের শুরু হয় তীব্র তুষার পাত। এই তুষার পাতের মধ্যেই তৌকির অবস্থান করেন আমা দাবলাম ক্যাম্প-১ এ। যার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফিট। ২৮ অক্টোবর আবহাওয়া আরো খারাপ হলে তাদের শেরপা লিডার সিদ্ধান্ত নেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবার। তীব্র এই তুষার ঝড়ের মধ্যে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দল বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে শুরু হয় নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।
৬৮১২ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম পর্বত
তুষার পাতের কারণে ফিক্সড রোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলেও নতুন রুট ওপেন না করা পর্যন্ত সামিট পুশ সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচদিন। তরপর সুখবর আসে রুট ওপেন হবার। নভেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয় আবার সামিট বিট। এইদিনে তৌকির পৌঁছে যান ১৯ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-১ এ। এরপর ৩ তারিখ ইয়োলো টাওয়ার খ্যাত ১৯ হাজার ৬৮৫ ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান। বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন সামিট পুশ। তীব্র বাতাস, ফিক্সড রোপে অতিরিক্ত ট্রাফিক এবং আইস ফলকে উপেক্ষা করে ৪ নভেম্বর ২২ হাজার ৩৪৯ ফিট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ চূড়ায় পৌছান তিনি।
তৌকির বিশ্বাস করেন, “স্বপ্ন যদি সত্যিকার অর্থে জ্বলে, তবে পাহাড়ও নত হয়। প্রতিটি শিখর আমাদের শেখায়, সীমা কেবল মনেই থাকে, সফলতায় নয়।”
তরুণ এই পর্বতারোহী এবারের স্বপ্ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন তার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৌকির ২০২৬ সালেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আবারো উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের তিনটি ছয় হাজার মিটার পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির। ২৭ দিনের অভিযানে গিয়ে কোন শেরপা সাপোর্ট ছাড়াই পর্বতগুলো আরোহণ করেন তিনি। পর্বতগুলো হলো ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক, ৬১৬৫ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক ও ৬৪৬১ মিটার উচ্চতার মেরা পিক।
তারও আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৌকির খুম্বু রিজিওনের ৫০৭৬ মিটার উচ্চতার নাগা অর্জুন এবং ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন।
তৌকির পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার আকরাম হোসেন সাবু-সুলতানা সামিয়া পারভীন দম্পতি ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল-ই তে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন
ঢাকা/মাসুদ