এক বছরে এসএমই ঋণ বিতরণ ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা
Published: 26th, June 2025 GMT
২০২৪ সালের কিছু সময়জুড়ে অস্থিরতা ছিল। আবার ব্যাংক খাতে তারল্য প্রবাহও কম ছিল। এসবের প্রভাব পড়েছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প (সিএমএসইএমই) খাতের ঋণ বিতরণে। করোনার পর গত বছর বিতরণ কমেছে। ২০২৪ সালে সিএমএসএমইতে বিতরণ হয়েছে মোট ২ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় যা ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বা সাড়ে ৬ শতাংশ কম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কম খরচে বেশি কর্মসংস্থান হয় ছোট ও মাঝারিশিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে। যে কারণে উন্নয়নশীল দেশে সব সময়ই এসব খাতে বিতরণে জোর দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বেশ আগ থেকে এ খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়ে আসছে। চলতি বছরের এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের অন্তত ২৭ শতাংশ সিএমএসএমইতে বিতরণের নির্দেশ দেওয়া। বিনা জামানতে নারীদের জন্য ২৫ লাখ টাকা এবং অন্য ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে বলা হয়েছে। করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই এ ধরনের ব্যবসায়ীর অন্য ব্যবসাসংক্রান্ত সনদ দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন সমকালকে বলেন, ২০২৪ সালের বড় একটি সময়জুড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ছিল। গত বছরের শুরুর দিকে নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়। যে কারণে হয়তো ঋণ বিতরণ কমে গেছে। কেননা, যে কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ হয় খুব কম। বেসরকারি খাতের সার্বিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে নেমেছে। আরও কিছুদিন হয়তো এরকম থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণভাবে সব সময়ই সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ বেড়ে থাকে। তবে গত বছর কমেছে। এর আগে করোনার মধ্যে লকডাউনের কারণে অধিকাংশ কাজে স্থবিরতা ছিল। ফলে ২০২০ সালে ঋণ বিতরণ কমে যায়। ওই বছর বিতরণ নেমে ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকায়। আগের বছর ২০১৯ সালে যেখানে বিতরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এর মানে এক বছরে বিতরণ কমে ১৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে সিএমএসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১৩ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএমএসএমইতে মোট ২ লাখ ২৯ হাজার ৩১৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। ২০২২ সালে বিতরণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ঋণ বিতরণ বেড়েছিল ৮ হাজার ৮২৩ টাকা; যা ৪ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালে এ খাতে ঋণ বেড়েছিল ৩৫ হাজার ৬১ কোটি টাকা বা প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০২১ সালে সিএমএসএমইতে মোট বিতরণ হয়েছিল এক লাখ ৮৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় যা বেশি ছিল ৩২ হাজার ৩২ কোটি টাকা বা প্রায় ২১ শতাংশ।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ২০২৪ সালে বিভিন্ন ধরনে অস্থিরতা ছিল। যে কারণে ঋণ চাহিদা ছিল কম। আবার দু’একটি ব্যাংক ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এসএমই ঋণে খেলাপি বেশি। এসব কারণে হয়তো কমেছে। এসএমই ঋণ বিতরণ কমার ক্ষেত্রে তারল্য সংকট কোনো কারণ ছিল না বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ বাড়াতে অনেক আগ থেকে নানা নির্দেশনা দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ খাতের জন্য কম সুদের বেশ কয়েকটি প্রণোদনা ও পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এসএমই ঋণ ব তরণ ব ড় ২০২৪ স ল ১৪ হ জ র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ রয়েছে
ঢাকা ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ও সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনার আওতায় কম সুদে এসএমই ঋণ দিচ্ছে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং কাঠামো ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন ও দক্ষ করে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে
সমকাল : ঢাকা ব্যাংক এসএমই খাতকে কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে? এ খাতে আপনাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে জানতে চাই।
শেখ মোহাম্মদ মারুফ : দেশের অর্থনীতির টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে এসএমই খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এসএমই অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসএমই খাতের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে ঢাকা ব্যাংক ২০১৪ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ এসএমই ডিভিশন গঠন করে। পরে ২০২১ সালে একটি স্বতন্ত্র এমএসএমই বিজনেস ডিভিশন গঠন করে। ঢাকা ব্যাংক এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সময়োপযোগী ও কার্যকর কয়েকটি সঞ্চয় ও ঋণপণ্য চালু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে– সুক্তি চলতি হিসাব, প্রবৃদ্ধি ডিপিএস, অদ্বিতীয়া ওভারড্রাফট, অদ্বিতীয়া টার্ম লোন, স্টার্টআপ লোন ইত্যাদি। এ ছাড়া এসএমই ডিস্ট্রিবিউটর ফাইন্যান্স ও সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্সের জন্য পৃথক ইউনিট চালু করা হয়েছে, যা সরবরাহকারী ও পরিবেশকদের জন্য সহজ শর্তে অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষায়িত ইউনিট ও পণ্যের মাধ্যমে ঢাকা ব্যাংক বর্তমানে দেশের অগ্রণী কয়েকটি ব্যাংকের অন্যতম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
সমকাল : এসএমই উদ্যোগের বিস্তার অর্থনীতিকে কীভাবে এগিয়ে নিতে পারে?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ : বিশ্বব্যাপী উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, এসএমই খাতই অর্থনীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করে। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জার্মানির মতো দেশের জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশই আসে এই খাত থেকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। বাংলাদেশে এসএমই খাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশজ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, যা আমদানি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ– টুথপিক, কটন বাড, শিশুদের খেলনা, প্রসাধনী, ফ্যাশন সামগ্রী ও কৃষিভিত্তিক অনেক পণ্যই এখনও বিদেশ থেকে আমদানি হয়। এসব পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমদানি ব্যয় কমানো যাবে, অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের পথও উন্মুক্ত হবে। এসএমই খাতে উদ্দীপনা তাই অর্থনীতিকে বহুগুণে চাঙ্গা করতে সক্ষম।
সমকাল : অনেক উদ্যোক্তার অভিযোগ, ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য নয়। আপনি কী মনে করেন?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ : ব্যাংকিং খাতের ঋণ প্রক্রিয়াকরণ একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। বাস্তবতা হলো, অনেক এসএমই উদ্যোক্তার ব্যবসায়িক লেনদেনের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণের অভাব, ট্রেড লাইসেন্স ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকা ইত্যাদি কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ জটিল হয়ে পড়ে। তবে ঢাকা ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ও সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনার আওতায় কম সুদে এসএমই ঋণ দিচ্ছে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং কাঠামো ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন ও দক্ষ করে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে, যেখানে নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সমকাল : এসএমই খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য কোন কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ : এসএমই খাতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও ফলপ্রসূ জাতীয় রোডম্যাপ। দেশের অবকাঠামো, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং দক্ষ মানবসম্পদ এখনও এসএমই খাতের পূর্ণ বিকাশে যথেষ্ট নয়। এ খাতকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, আধুনিক প্রশিক্ষণ, উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার, বাজারজাতকরণে সহায়তা ও নেটওয়ার্ক গঠন এবং তথ্যপ্রবাহের নিশ্চিতকরণ। এসএমই ফাউন্ডেশনের জেলা পর্যায়ে কার্যক্রম আরও শক্তিশালীকরণ এবং সম্প্রসারণ একান্ত জরুরি। আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এসএমই খাতকে উৎসাহিত করতে নারীদের জন্য ঋণ কোটাসহ সহজতর প্রক্রিয়া এবং ট্রেনিং ও মার্কেট লিংকেজ সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
সমকাল : নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যায়?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ : বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় প্রতিটি ব্যাংককে তাদের এসএমই ঋণ পোর্টফোলিওর কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার জন্য বরাদ্দ রাখতে হয়। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে ১ শতাংশ প্রণোদনা ও ৫ শতাংশ সুদে ঋণের সুবিধা রয়েছে।
ঢাকা ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষায়িত ঋণপণ্য চালু করেছে এবং জামানত সংক্রান্ত বাধা দূর করতে গ্রুপ গ্যারান্টির আওতায় ঋণ কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছে। এ ছাড়া জেলা ও থানা পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের প্রচার ও বিপণনের সুবিধার্থে মেলা আয়োজন, আলোচনা সভা ও বাজার সংযোগ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ঢাকা ব্যাংক আগামী ১৮ আগস্ট থেকে এক মাসব্যাপী নতুন উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করছে, যার একটি বড় অংশ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এবং প্রশিক্ষণ-পরবর্তী অর্থায়নের সুযোগ থাকবে।
সমকাল : এসএমই খাতে ঢাকা ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ : ঢাকা ব্যাংক এসএমই খাতে আরও শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিনির্ভর এবং গ্রাহকবান্ধব ব্যাংকিং প্রক্রিয়া চালু করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হলো– ঋণ প্রক্রিয়াকরণে সফটওয়্যার আধুনিকায়ন, ডিস্ট্রিবিউটর ও সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্সে অটোমেশন, ক্লাস্টারভিত্তিক অর্থায়নের জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, উদ্ভাবনী এসএমই পণ্য চালু, নারী উদ্যোক্তা ও তরুণদের জন্য বিশেষায়িত প্যাকেজ। ঢাকা ব্যাংক প্রতিবছর আন্তর্জাতিক এমএসএমই দিবস উদযাপনের মাধ্যমে এসএমই উদ্যোগের প্রচার ও বিকাশে অঙ্গীকারবদ্ধ।