চার মাস ধরে স্থবির কুয়েট: অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ
Published: 27th, June 2025 GMT
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) চার মাসের বেশি সময় ধরে এক চরম অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, প্রশাসনিক জটিলতা, শিক্ষকদের রাজনৈতিক বিভাজন এবং তদন্ত নিয়ে বিতর্ক—সব মিলিয়ে কুয়েট আজ এক ভয়াবহ স্থবিরতার নাম। এই চার মাসে পাঠদান বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ, গবেষণা কার্যক্রম স্থগিত এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে এই সংকট।
১৮ ফেব্রুয়ারি: নৃশংস হামলায় উত্তাল ক্যাম্পাস২০২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েট ক্যাম্পাসে ঘটে এক নজিরবিহীন হামলা। সশস্ত্র হামলাকারীরা পিস্তল, রামদা ও চাপাতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আহত হন দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী এবং একজন সম্মানিত শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের দাবি, হামলাকারীরা বিএনপি-ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট এবং পূর্বপরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস চালায়।
৬ দফা দাবি উত্থাপনহামলার পরপরই আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তবে প্রথম ধাপে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের দাবি উপস্থাপন করেন। শিক্ষার্থীরা ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, হামলায় জড়িত শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার ও অভিধাগত হামলাকারীদের নামে মামলা করা, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ মোট ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। দাবি মেনে না নেওয়ায় ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনগুলোতে শিক্ষার্থীরা তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপও দাবি মেনে না নেওয়ায় স্লোগানে–মিছিলে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত থাকে।
স্মারকলিপি ও গণস্বাক্ষরপ্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর স্বাক্ষরসহ একটি স্মারকলিপি প্রধান উপদেষ্টার বরাবর প্রেরণ করা হয়। কিন্তু কুয়েট প্রশাসন এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকে। এরপর প্রশাসন আবাসিক হলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
ঈদের পর আন্দোলনের নতুন ঢেউ, প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া আরও কঠোররোজার ঈদের ছুটির পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে এসে আবারও আন্দোলনে নামেন। হল খুলে দেওয়ার দাবি নিয়ে কয়েক রাত প্রশাসনিক ভবনের সামনে ঘুমিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আর এদিকে প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়। আন্দোলন থামাতে একজন এলাকাবাসীর ওপর হামলার ও চেইন চুরির মামলা এবং তদন্ত কমিটির সুপারিশে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়—যাঁদের নাম প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা শিক্ষকসমাজ কেউই জানতেন না। কিন্তু চাঞ্চল্যকরভাবে ঢাকার কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি এই ৩৭ জনের মধ্যে ৭ জনকে ছাত্রদলের কর্মী বলে উল্লেখ করেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে, যা এই ঘটনা ও তদন্তের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক সংযোগের সন্দেহ জোরালো করে। কুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক মাছুদের অপসারণের দাবি নিয়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে বসেন। শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে কুয়েট ক্যাম্পাসে যান, ইউজিসির প্রতিনিধিদল সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত করেন। অনশনের দীর্ঘ ৫৪ ঘণ্টা পর, ইউজিসির প্রতিনিধিদলের অধ্যাপক তনজিমউদ্দীন খান, শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি লিখিত প্রেস রিলিজ পাঠ করেন, যেখানে বলা হয় কুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক মাছুদের অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। এর কয়েক দিন পর তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অপসারণ করা হয়।
তদন্ত কমিটি নিয়ে বিতর্ক ও শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত জবাবদিহিশিক্ষার্থীরা প্রথম থেকেই তদন্ত কমিটির বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাঁদের দাবি, তদন্ত কমিটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নয়। তবে শিক্ষার্থীদের কোনো কথা আমলে না নিয়ে প্রশাসন বিতর্কিত তদন্ত কমিটি বহাল রেখেছে। সেই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৩০ জন আন্দোলনকারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ করেন এবং একটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাবি করেন।
নতুন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে ঘিরে স্বচ্ছতার চেষ্টা ব্যর্থনিয়োগ পাওয়া নতুন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শিক্ষার্থীদের থেকে সাক্ষাৎকার, তথ্য, ছবি, ভিডিও, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং তদন্ত কমিটির পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা সম্পর্কে একটি বিশদ উপস্থাপনা গ্রহণ করেন। অডিটরিয়ামে শিক্ষার্থীরা প্রজেক্টরের মাধ্যমে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন। এতে শিক্ষার্থীরা তুলে ধরেন কীভাবে রাজনৈতিক চাপে তাঁদের আন্দোলন দমন করা হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষকদের অসহযোগিতার কারণে এবং তাঁদের দ্বারা চাপ সৃষ্টির ফলে এই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যও কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েন এবং শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
একটি বিদায়ী ব্যাচের স্বপ্নভঙ্গসবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদায়ী ২কে১৯ ব্যাচ। অনেকে পিএইচডি বা মাস্টার্সের অফার পেয়েও কুয়েট থেকে ট্রান্সক্রিপ্ট বা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট না পাওয়ায় স্কলারশিপ হারিয়েছেন। সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারছেন না, বিসিএস কিংবা পিএসসি ফরম পূরণ করতে পারছেন না। অনেকে গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থী—তাঁদের জন্য এই জটিলতা শুধু একাডেমিক সমস্যা নয়, জীবন ও পরিবারের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শঙ্কা।
একটি অচল বিশ্ববিদ্যালয়: সমাধান কোথায়বর্তমানে কুয়েট প্রশাসনিকভাবে প্রায় শূন্য হয়ে আছে। শিক্ষকদের একাংশ এখনো আগের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বিচার চায় এবং একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষার্থীরা বারবার আহ্বান জানালেও ক্লাস-পরীক্ষা চালু হয়নি। বরং নতুন উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া আবারও দীর্ঘসূত্রতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
দ্রুত সমাধানই একমাত্র পথঅভিভাবক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী ও সচেতন মহলের একটাই দাবি, একাডেমিক কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। যারা দায়ী তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ব্যাচ যদি ডিগ্রি না পায়, তার প্রভাব শুধু তার ওপর নয়—জাতির ওপর পড়ে। এটি আর দেরির সময় নয়, এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার।’—একজন অভিভাবক, কুয়েট
মো: ওবায়দুল্লাহ (৪র্থ বর্ষ ইইই বিভাগ), শেখ মুজাহিদ (৪র্থ বর্ষ ইইই বিভাগ), মোহন আলী (৪র্থ বর্ষ টেক্সটাইল বিভাগ), গালিব রাহাত (৪র্থ বর্ষ ইইই বিভাগ), তৌফিক তামিম (৪র্থ বর্ষ লেদার বিভাগ), রাহাতুল ইসলাম (৩য় বর্ষ সিভিল বিভাগ), আব্দুল্লাহ আল সৈকত (৩য় বর্ষ ইইই বিভাগ), মহিউজ্জামান উপল (৩য় বর্ষ আইইএম বিভাগ)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব শ বব দ য র জন ত ক উপ চ র য এক ড ম ক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
টাকা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে দল গড়া মানুষ দেখতে চায় না: জোনায়েদ সাকি
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছে, ‘গণ–অভ্যুত্থানের পর মানুষ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সত্যিকার নেতৃত্ব দেখতে চায়। টাকা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে দল গড়া মানুষ দেখতে চায় না। এমনকি যাঁরা আজকের তুর্কি–তরুণ, তাঁরাও অনেকে এই গড্ডালিকায় গা ভাসাবেন, এমনটা আশা করেনি কেউ। মানুষ ভরসা রাখতে চায়।’
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের জুলাই স্মৃতি হলে শ্রমিকনেতা ‘প্রয়াত মির্জা আবুল বশর স্মরণসভায়’ প্রধান আলোচকের বক্তব্যে জোনায়েদ সাকি এ কথা বলেন।
সভায় তিনি সংবিধানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিয়ে সবাই এখনো ঐকমত্য হতে না পারলেও অগ্রগতির জায়গা রয়েছে। আবার কিছু মতপার্থক্যও আছে। অগ্রগতির দিকটা ছোট করার কিছু নেই। আবার যেসব বিষয়ে পার্থক্য আছে, যেসব বিষয়কে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি এবং অপরিহার্য মনে করি, সেসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষ সে লড়াই চায়। মানুষ চায়, তাদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক।’
গণ–অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকি বলেন, গণ-অভ্যুত্থান শেষ হয়ে যায়নি। এ দেশে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার হবে, এমনটা কেউ ভাবেনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজীবনে ১০ বছরের বেশি কেউ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, সংসদের উচ্চকক্ষের গঠনপ্রকৃতি কী হবে, বিচার বিভাগ স্বাধীন কীভাবে হবে, এমন নানা বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে।
মির্জা আবুল বশর স্মৃতি পরিষদ এ স্মরণসভার আয়োজন করে। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন চট্টগ্রাম জেলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম জেলার যুগ্ম নির্বাহী সমন্বয়কারী মির্জা আবুল বশর। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই এ সভার আয়োজন করা হয়। এতে মির্জা আবুল বশরের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, মির্জা আবুল বশর অত্যন্ত সৎ ও প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন। মেহনতি মানুষের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন তিনি। অনেকে অনেক পেশা নেন, জীবনের ব্রত নেন, কর্তব্য ঠিক করেন। পরিবর্তনের জন্য কাজ করেন। এই কর্তব্য পালনের ডাকে আজকের তরুণেরা সাড়া দেবেন। তাঁরা টাকা কিংবা ক্ষমতার দাপটের কাছে পরাজিত হবেন না, বরং সেটাকে মোকাবিলা করে টিকে থাকবেন।
স্মরণসভায় ছাত্র, পেশাজীবী, শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। উপস্থিত ছিলেন মির্জা আবুল বশরের আত্মীয়স্বজন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হওয়া এ সভা শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। সভার সভাপতিত্ব করেন গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রামের আহ্বায়ক হাসান মারুফ রুমি।