‘আমি শুধু একজন মা। আমার ছেলেরা সীমান্তের ওপারে। আমি তাদের ফেরত নিতে এসেছি।’ কথাগুলো বলতে বলতে ছয় দিন ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল পেরিয়ে একাই রাশিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন ইউক্রেনের নাতালিয়া।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রুশ বাহিনী খেরসন দখল করলে এক প্রতিবেশীর পরামর্শে তাঁর দুই ছেলেকে রাশিয়ার আনাপা শহরের একটি ‘শিশু শিবিরে’ পাঠান নাতালিয়া।
শিবিরটি ছিল রাশিয়ার একটি সমুদ্র তীরবর্তী শহরে, ‘অনুষ্ঠানভিত্তিক’ এক ক্যাম্প। বলা হয়েছিল, ২১ দিনের ভ্রমণ, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। বাচ্চারা খেলাধুলা করবে, বিশ্রাম পাবে। তারাও যেতে চাইছিল। ‘আমি ভাবছিলাম, ছেলেরা নিরাপদে থাকবে, যুদ্ধের চাপ থেকে কিছুদিন মুক্তি পাবে। তখন বুঝিনি এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হবে’– বলেন নাতালিয়া।
কিন্তু ওই সফরের ২১ দিন পেরিয়ে গেলেও ফেরার কোনো বার্তা আসে না। এর মধ্যেই ইউক্রেনীয় বাহিনী খেরসন পুনর্দখল করে। কিন্তু নাতালিয়ার ছেলেরা তখনও রুশ অধিকৃত অঞ্চলের এক ক্যাম্পে।
নাতালিয়া যোগাযোগ করেন ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। বলা হয়, শুধু মা নিজে এসে নিয়ে গেলে তবেই ছেলেদের ছাড়া হবে। না হলে নয়। এর পর শুরু হয় নাতালিয়ার অন্যরকম এক যুদ্ধ। ইউক্রেনীয় এক সংগঠনের সহায়তায় ছেলেদের পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন তিনি।
এর পর পূর্ব ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া হয়ে রাশিয়ার ভেতরে ঢোকার চেষ্টায় ঝুঁকিপূর্ণ এক যাত্রা পথে পা বাড়ান নাতালিয়া। ছয় দিন ধরে যুদ্ধের গোলাগুলি, একের পর এক সীমান্ত চৌকিতে রুশ সেনাদের প্রশ্নবাণ, দেহ তল্লাশি, কখনও উপহাস, কখনও সন্দেহের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। নাতালিয়া বলেন, ‘প্রতিটি চেকপয়েন্টে আমাকে বলতে হয়েছে, আমি শুধু একজন মা। আমার ছেলেরা ওই পারে। আমি তাদের ফিরিয়ে নিতে এসেছি।’
সব কিছু পেরিয়ে অবশেষে আনাপা শহরে পৌঁছান নাতালিয়া। সেখানেই ক্যাম্প থেকে ছেলেদের কাছে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। ‘তাদের চোখে ভয় আর স্বস্তি একসঙ্গে ছিল। আমি শুধু ওদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম,’ বলেন নাতালিয়া।
এ রকম হাজারো শিশুর নিখোঁজ হওয়ার পেছনে রাশিয়ার সংঘটিত শিশু অপহরণ কর্মসূচি রয়েছে বলে দাবি করেছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তারা বলছেন, ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৩৫ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় শিশু নিখোঁজ হয়েছে। ইউক্রেনীয় শিশুদের অপহরণ করে যুদ্ধাপরাধ করেছে রাশিয়া– বলেন বিশেষজ্ঞরা। এদের কেউ কেয়ার হোম থেকে, কেউ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আবার কাউকে সরাসরি পরিবার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অনেককে সামরিক ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে, কেউ এতিমখানায়, আবার অনেককে রুশ পরিবারে দত্তক দেওয়া হয়েছে।
উদ্ধারও হয়েছে রাশিয়ার অপহৃত বেশ কিছু ইউক্রেনীয় শিশু। উদ্ধার হওয়া এসব শিশু জানিয়েছে, তাদের রাখা ক্যাম্পগুলোতে রুশ জাতীয় সংগীত গাইতে বাধ্য করা হতো, রুশ পতাকার ছবি আঁকতে হতো, আর ইউক্রেনীয় ভাষা বললেই মিলত শাস্তি। শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, একবার কোনো শিশু রাশিয়ার এতিমখানায় চলে গেলে, তাকে ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব।
২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং শিশু অধিকার কমিশনার মারিয়া লভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধে শিশু অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ইউক্রেন বলছে, অপহৃত শিশুদের ফেরত না নিয়ে কোনো শান্তি আলোচনা সম্ভব নয়। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাস্থ্য খাতে আলাদা বেতনকাঠামো হোক
দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল এক হলেও স্বাস্থ্য খাতের মর্যাদা ও আর্থিক কাঠামোয় বাংলাদেশের অবস্থান যেন এক পরিহাস। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কায় চিকিৎসক ও নার্সরা যেখানে তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক বেতন ও সুবিধার অধিকারী, সেখানে বাংলাদেশে তাঁদের উপার্জন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।
রাজধানীতে ‘অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ’-এর সাম্প্রতিক আলোচনায় প্রকাশিত তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে একজন চিকিৎসক বেতন পান তিন লাখ টাকা। আর একজন নার্স পান ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন চিকিৎসক বছরে বেতন পান ১৬ লাখ টাকার বেশি; অন্যদিকে নার্স পান প্রায় ৭ লাখ টাকা। নেপালে একজন চিকিৎসক বছরে বেতন পান ১০ লাখ টাকার বেশি আর একজন নার্স পান ৫ লাখ টাকা। একইভাবে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসক ও নার্সরা অনেক কম আর্থিক সুবিধা পান। দেশে স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো নেই। এ তথ্য শুধু পরিসংখ্যান নয়; বরং এক গভীর হতাশার প্রতিচ্ছবি।
চিকিৎসক ও নার্সদের পেশা কেবল চাকরি নয়; বরং এটি এক অনন্ত মানবিক ব্রত। তাঁরা মানুষের দুঃখ লাঘব করেন, প্রাণ রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন। অথচ এই পবিত্র দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে রাষ্ট্র তাঁদের যে স্বল্পতম আর্থিক প্রতিদান দেয়, তা এক অর্থে তাঁদের শ্রমের অবমাননা।
একজন চিকিৎসক যখন জানেন তাঁর জ্ঞান, দক্ষতা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য প্রাপ্তি নেই, তখন তাঁর মনে জন্ম নেয় বঞ্চনার বোধ। এই বঞ্চনাই কর্মস্পৃহা নিঃশেষ করে এবং অগণিত মেধাবী চিকিৎসক-নার্সকে প্রবাসমুখী করে তোলে।
এভাবে যদি শ্রমের অবমূল্যায়ন হতে থাকে এবং মেধাপ্রবাহ যদি বহমান থাকে, বাংলাদেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো একসময় দক্ষ জনশক্তিহীন হয়ে পড়বে। প্রতিদিন যে বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসার প্রত্যাশায় হাসপাতালে ভিড় করেন, তাঁদের সেবার মান অবধারিতভাবে হ্রাস পাবে। চিকিৎসা তখন আর মানবিকতার প্রতীক থাকবে না; বরং তা নিছক যান্ত্রিকতায় পরিণত হবে। এমনিতেই আমাদের হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যার বিপরীতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বহু আগে থেকে।
সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ন্যায্য মজুরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক ও নার্সদের ক্ষেত্রে এ প্রতিশ্রুতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটছে। সমাজ দর্শনের এক পুরোনো সত্য এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ‘যেখানে চিকিৎসক অসম্মানিত, সেখানে সমাজের রোগ নিরাময় অসম্ভব।’ স্বাস্থ্য খাতের এ অবমাননা কেবল চিকিৎসকদের নয়, গোটা জাতির জন্যও।
এ কারণে রাষ্ট্রীয় নীতিতে মৌলিক সংস্কার এখনই প্রয়োজন। চিকিৎসক-নার্সদের জন্য আলাদা ও সময়োপযোগী বেতনকাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। পেশার ঝুঁকিপূর্ণ চরিত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ঝুঁকি ভাতা চালু করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ন্যূনতম বেতন, বাসস্থানসুবিধা ও অবসরকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো কেবল অর্থনৈতিক সুবিধা নয়; বরং মানবিক দায়বদ্ধতারই বহিঃপ্রকাশ। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের কর্মীদের বেতন এমন হওয়া উচিত, যাতে তাঁকে অতিরিক্ত আয়ের জন্য বিকল্প খুঁজতে না হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মীর দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং সেবার মানও বাড়বে।
স্মরণ রাখা দরকার, একটি জাতি কীভাবে তার জ্ঞানবাহক ও জীবন রক্ষাকারীদের মর্যাদা দেয়, তার দ্বারা সেই জাতির সভ্যতার মান নির্ণীত হয়। চিকিৎসক-নার্সদের অবহেলা করা মানে মানবিকতাকেই অবহেলা করা। তাঁদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধীরে ধীরে অকার্যকরতায় নিমজ্জিত হবে এবং একদিন কেবল রোগীর দেহ নয়, জাতির মননও অসুস্থ হয়ে পড়বে।