আমরা ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর নতুন এক ঢেউ দেখেছিলাম। ঢাকার পাশাপাশি তখন এর প্রাদুর্ভাব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে; যেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ১ লাখের অধিক মানুষ এবং মারা যান ১৭৯ জন। পরের বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলে বিশ্ব কভিড-১৯ অতিমারির মুখোমুখি হয়। তখন একটা স্বস্তি ছিল, করোনায় মানুষ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলেও ডেঙ্গু নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। ২০২১-এর পর অবশ্য করোনা কমলেও ডেঙ্গু সেই অর্থে কমেনি। ২০২৩ সাল বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ বছর ছিল। তখন করোনা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এ বছর এসে আমরা একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও করোনার প্রকোপ দেখছি। এবার জ্বরের বৈচিত্র্যময় কারণ দেখা যাচ্ছে। এগুলো একদিকে যেমন করোনা, অন্যদিকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বর, শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণজনিত জ্বর, পানিবাহিত রোগের কারণেও জ্বর হচ্ছে, যেমন টাইফয়েড। টাইফয়েড ও শ্বাসতন্ত্রের জ্বর বাদে অন্যগুলো ভাইরাসজনিত। যেমন করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা। 

আগে কখনও বলা হতো, একাধিক ভাইরাসের সংক্রমণ সাধারণত এক জায়গায় হয় না। এটা বলা চলে, অনুমানপ্রসূত। আমরা ব্রাজিলেও দেখেছি, ডেঙ্গু ও করোনা একত্রে হচ্ছে এবং বাংলাদেশেও তেমনটা দেখছি। তার মানে, এখন জ্বর হলে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। বরং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং এক-দুইটা পরীক্ষা করা জরুরি। এতে বোঝা যাবে জ্বরের কারণটা কী– ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, নাকি করোনা? এ ক্ষেত্রে অবহেলা হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমনকি মৃত্যুও। এ কারণেই এবারের জ্বরকে ভিন্নমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। অর্থাৎ জ্বর হলে এর ধরনটা নিরূপণ করা। একে অবহেলা করা যাবে না। জ্বর পরীক্ষার ক্ষেত্রে হয়তো একটা দিয়ে পুরো চিত্র আসবে না। সে ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ও করোনার একসঙ্গে পরীক্ষা করা যেতে পারে। আবার লক্ষণ অনুযায়ী পরীক্ষা হতে পারে। যেমন চিকুনগুনিয়া হলে প্রচণ্ড জ্বর ও সন্ধিস্থলে ব্যথা করবে। এটিও মশাবাহিত রোগ।

জ্বরের এসব পরীক্ষা সর্বত্র সহজলভ্য করা দরকার। অথচ সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, সর্বত্র সব রোগের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। যেমন করোনার পরীক্ষার কিটের সংকট যেখানে রাজধানীর অনেক হাসপাতালেই দেখা গেছে, সেখানে বাইরের চিত্র বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার জেলায় জেলায় বাড়ছে চিকুনগুনিয়া। অথচ পরীক্ষা শুধু ঢাকাতেই হচ্ছে। সে জন্য আমি মনে করি, ডেঙ্গু, করোনা এবং চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থা বাইরে সমানভাবে থাকতে হবে; সরকারি-বেসরকারি উভয় হাসপাতালেই। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত পরীক্ষা করতে পারবে এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় সময় থাকতেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, ডেঙ্গুর কিছু হটস্পট চিহ্নিত হয়েছে। যেমন বরগুনা, কুমিল্লার দাউদকান্দি। বিশেষ করে বরিশালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। সেখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। বলা চলে, একসময় ডেঙ্গু শহরের রোগ বলে পরিচিত ছিল এবং শুরুতেই যেটা বলেছি, ২০১৯-এর মহামারির মাধ্যমে এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এডিস মশার ভাইরাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও এর ঘনত্ব বেড়েছে। সে জন্য এখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট কোনো জায়গার অগ্রাধিকারে আবদ্ধ থাকা উচিত নয়। এ মশা নিয়ন্ত্রণে সারাদেশেই একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে এবং এ পরিকল্পনায় জনগণকে সঙ্গে রাখতে হবে। অর্থাৎ কমিউনিটির অংশগ্রহণ এখানে জরুরি। আর যেসব জায়গায় হটস্পট, সেসব অঞ্চলে গুরুত্বটা বেশি দিতে হবে। এটা না করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।

গত বছর সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, বাস্তবতা আগে স্বীকার করতে হবে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণের পর আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেকে বলতে থাকেন, এটি মহামারি নয়। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারি-বিষয়ক সংজ্ঞাও যেন তারা মানতে চান না। যেন অস্বীকার করলেই বাস্তবতা বদলে যাবে। মহামারি অস্বীকারের মধ্য দিয়ে ডেঙ্গু ঢাকা শহর থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামেও এখন ডেঙ্গুর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এর ফলে আরেকটা ক্ষতি হলো। ডেঙ্গুর রূপ পাল্টে গেল। যেটা এর আগে ছিল মৌসুমি বা বর্ষার রোগ, তা হয়ে গেল সারাবছরের।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তারা অভিযান চালাচ্ছে বটে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কিছু কাজ করছে। সে সাফল্য আসছে কতটা? সাধারণত দুই ধরনের এডিস মশাকে এখানে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী করা হয়। একটি এডিস ইজিপ্টাই বা গৃহবাসী এডিস; আরেকটি বুনো এডিস, যাকে এশিয়ান টাইগারও বলে। বুনো এডিস বাস করে বাড়িঘরের আশপাশে ঝোপঝাড়, গাছের পাতা বা খোঁড়লে জমে থাকা পানিতে। সিটি করপোরেশন হয়তো ঘরবাড়িতে থাকা এডিস ইজিপ্টাই মারার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু বুনো এডিস মারতে কী করছে? আমরা অনেক দিন ধরে এডিস নিধনে জাতীয় পরিকল্পনার কথা বলছি। যার আওতায় বাসাবাড়ির পাশাপাশি ঝোপঝাড়ের এডিসও মারা পড়বে। কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল নেই!
আমাদের দুঃখজনক দিকটা হলো, যখন মহামারি আসে বা রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়, তখন কর্তাব্যক্তিরা নানা পরিকল্পনা ও আশ্বাসের কথা বলেন। রোগী কমে গেলে তা ভুলে যান। এমনকি বলা চলে, ফ্রিজে পাঠিয়ে দেন। পরের বছর আবার যখন আসে, তখন আবার কথা বলেন। সারাদেশের জন্য সমন্বিত মশক নিধন অভিযানের যে দাবি আমরা করে আসছি, তার বাস্তবায়ন কিন্তু হয়নি। তবে এবার আমরা প্রত্যাশা রাখতে চাই, জুলাই অভ্যুত্থানের সরকার বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।

সর্বশেষ এবারের করোনার বিষয়টিতে জোর দেওয়ার কথা বলছি। আমার ধারণা, আমরা করোনার একটি নতুন ঢেউয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। কারণ ইতোমধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের করোনা বাড়তে শুরু করেছে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বলা হচ্ছে, এটি খুব দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে সক্ষম। যদিও সাধারণ মানুষ, যাদের অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি অসুখ নেই, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সমস্যা নেই, তাদের জন্য এটি অতি বিপজ্জনক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অন্যদিকে, এসব সমস্যা যাদের রয়েছে, তারা আক্রান্তের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। আমি মনে করি, এসব মৃত্যু হয়তো প্রতিরোধ করা যেত। প্রতিরোধযোগ্য একটি মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয়। সে জন্য এটি প্রতিরোধে জনসাধারণকে সতর্ক করার জন্য কাজ করতে হবে।

ডা.

লেলিন চৌধুরী: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ন পর ক ষ র ব যবস থ র জন য কর ন র

এছাড়াও পড়ুন:

ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফারাবীর জামিন বহাল

ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শফিউর রহমান ফারাবীকে হাইকোর্টের দেওয়া অন্তর্বর্তী জামিন বহাল রয়েছে। ওই জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনে ‘নো অর্ডার’ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক রোববার এ আদেশ দেন।

ওই মামলায় ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ে ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই হাইকোর্টে আপিল করেন ফারাবী।

২০২২ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিচারাধীন আপিলে জামিন চেয়ে আবেদন করেন ফারাবী। এর ওপর শুনানি নিয়ে গত ৩০ জুলাই হাইকোর্ট তাঁকে অন্তর্বর্তী জামিন দেন। এই জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে, যা এদিন চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সাইফুদ্দিন খালেদ। ফারাবীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহিনুর রহমান ও ওমর ফারুক।

পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, আদালত ‘নো অর্ডার’ দিয়েছেন। তার মানে হাইকোর্ট ফারাবীকে যে জামিন দিয়েছিলেন, তা বহাল। ফারাবী ১৬৪ ধারায় কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। মামলায় চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদের কেউই ফারাবীর নাম উল্লেখ করেননি। ফারাবী প্ররোচনা দিয়েছেন—কোনো সাক্ষী তা বলেনি। এমনকি তাঁর সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়নি। ফারাবীর জামিনের পক্ষে এসব যুক্তি তুলে ধরা হয়।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হামলায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদও গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন।

মামলাটি তদন্ত করে ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এই মামলায় ২৮ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়।

আরও পড়ুনব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফারাবীর জামিন৩০ জুলাই ২০২৫

এই মামলায় ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান রায় দেন। রায়ে পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং এক আসামিকে (শফিউর রহমান ফারাবী) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই হাইকোর্টে আপিল করেন ফারাবী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চ্যাটজিপিটির স্বাস্থ্য পরামর্শ মানতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে
  • ৬ বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়
  • ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফারাবীর জামিন বহাল
  • দক্ষিণ কোরিয়ায় কমছে পুরুষ, আকারে ছোট হচ্ছে সামরিক বাহিনী
  • ফল প্রকাশসহ ৩ দাবিতে বিভাগে তালা দিয়ে ইবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
  • তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সাফল্যের ২৫ গল্প নিয়ে বই ‘সুখবর বাংলাদেশ’
  • সহানুভূতি: একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ