দেশের ব্যাংক খাত এখন সংকটকাল পার করছে। একদিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, অন্যদিকে ঋণপ্রবাহে স্থবিরতা। আবার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থনীতি ও ব্যবসার পরিবেশ সংকুচিত হচ্ছে। আর্থিক খাতের এ রকম অব্যবস্থাপনা থেকে উত্তরণে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ আজ শনিবার এক সেমিনারে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ দশমিক ২ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আর্থিক খাতে অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ধীরগতি আমাদের শিল্প উৎপাদনসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।’

রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই মিলনায়তনে ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণগ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী প্রধান অতিথি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের (মুদ্রানীতি বিভাগ) নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম বিশেষ অতিথি ছিলেন।

সেমিনারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও জমাকৃত সুদ পরিশোধে সাত বছরের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর (গ্রেস পিরিয়ড) প্রস্তাব দেন ডিসিসিআইয়ের সভাপতি তাসকীন আহমেদ। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণীকরণের বর্তমান সময়সীমা ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানোরও সুপারিশ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও পরিচালক আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক স্থিতিপত্রে ব্যাপক চাপ পড়েছে। এর ফলে বেসরকারি খাত একটি ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ ঘাটতি, আমদানি নিষেধাজ্ঞা, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার, বেসরকারি খাতে ঋণের অপ্রতুলতা উল্লেখযোগ্য।

আশরাফ আহমেদ বলেন, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, মানুষের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, বাজার চাপে রয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহের অভাবে শিল্প খাতের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমেছে। জ্বালানি সরবরাহ ঠিক থাকলে দেশের জিডিপি হয়তো দ্বিগুণ হতে পারত।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেবল সুদের হার বাড়ানোই একমাত্র সমাধান নয়। আমাদের অবশ্যই আনুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করতে হবেআনিসুজ্জামান চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।

আশরাফ আহমেদ আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হয়, বিনিয়োগ হ্রাস পায়, ফলে বেসরকারি খাত ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেশের ১৪টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ভালো ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত বাকি ৪৭টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশ।

সেমিনারের প্রধান অতিথি আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৫ বছরে অর্থনীতির যে অবস্থা হয়েছে, সেই দায় আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে নিতে হবে। বিগত সরকারের আমলে ঋণ দেওয়ার সময় তারা কি জানত না যে এই দেশের অর্থনীতি দুর্নীতিতে জর্জরিত। সে সময় ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেখা যেত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা। তবে আজ তারা এসে নানান কাঠামোগত সংস্কারের পরামর্শ দিচ্ছে। এ যেন নিজেদের দায় চাপিয়ে দেওয়া।’

আনিসুজ্জামান চৌধুরী আরও বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেবল সুদের হার বাড়ানোই একমাত্র সমাধান নয়। আমাদের অবশ্যই আনুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে অনানুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এই পরিস্থিতিতে ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলো চাইলেই সুদের হার কিছুটা কমিয়ে ঋণগ্রহীতাদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত সময়ে আমাদের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ কিছু পরিবারের মধ্যে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ও মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পর উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে।

এজাজুল ইসলাম জানান, গত বছরের আগস্টের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রথম ধাপে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং পরবর্তী সময়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বেসরকারিভাবে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা এলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। ফলে ভবিষ্যতে কারখানা চালু রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতে নেতিবাচক ঋণপ্রবাহের কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার বলেন, সরকারের দুর্বল নীতির কারণে খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের হারেও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমাতে সরকারের নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

বিকেএমইর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ভালো ঋণগ্রহীতারা প্রয়োজনীয় সুবিধা পান না। ডলারের মূল্য হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ছোট উদ্যোক্তারা বেশি হুমকির মধ্যে পড়েছেন। আগে ৮৫ টাকায় এক ডলার ধরে তাঁদের ঋণ অনুমোদন হয়েছিল। এখন সেটা ১২০ টাকা। এতে সক্ষমতার অভাবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ক্রেডিট দরকার হলেও বেশির ভাগ ব্যাংক তা বাড়াতে পারছে না। এর ফলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে গিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়ছে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারি-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো কিছুটা হলেও খেলাপি ঋণ আদায়ে সক্ষম হবে। শিল্প খাতে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অনেক উদ্যোক্তাই খেলাপি ঋণে পড়তে পারে।

ব্যাংকঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন র‌্যাংগস মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানা রউফ চৌধুরী। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে স্বল্প সুদের তহবিল নিশ্চিত করতে পারলে এই খাতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়বে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব সরক র সরবর হ আম দ র আর থ ক আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করেছে ইসরায়েল 

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহ আবারও স্থগিত করেছে ইসরায়েল। এর ফলে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। বিতরণ করা ত্রাণসামগ্রী হামাস সদস্যদের হাতে চলে যাচ্ছে, এমন অভিযোগে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে ইসরায়েলের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ত্রাণসামগ্রী যাতে হামাসের হাতে না যায়, সে জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি পরিকল্পনা করবে। সেটি না হওয়া পর্যন্ত গাজায় কোনো ত্রাণ ঢুকতে দেবে না ইসরায়েল।

এর আগেও দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল ইসরায়েল। চার সপ্তাহ ধরে সেখানে ত্রাণ বিতরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত সংস্থা গাজা ‘হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)। সংস্থাটির ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ আনতে যাওয়ার পথে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৪৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা সরকারের গণমাধ্যম দপ্তর গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুফাঁদ’ বানিয়ে চালানো হামলায় এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৬ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অনাহারে থাকা ৩৯ ফিলিস্তিনি।

মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী নেতা ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গভির গাজায় ত্রাণ বিতরণ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর আগে ইসরায়েলের সরকার দাবি করে, গাজায় সরবরাহ করা পণ্য ও খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে হামাস।

এএফপির খবরে বলা হয়েছে, গাজার প্রভাবশালী কিছু পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী একটি কমিটি গতকাল এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানিয়েছে, এ ধরনের দাবি ভিত্তিহীন। এটি গাজায় প্রবেশ করা মানবিক সহায়তাকে বাধাগ্রস্ত করার একটি অজুহাত মাত্র।

স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, গাজা এখন গণহত্যার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এমন অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে বিদ্যমান সহযোগিতা চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পর্যটন শহরে করোনা, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ
  • চীন–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যচুক্তিতে সই করেছে: ডোনাল্ড ট্রাম্প
  • ভারত-রাশিয়ার মধ্যে আরও এস-৪০০ সরবরাহ নিয়ে আলোচনা
  • যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর
  • বেড়েছে চালের দাম
  • বিপ্লব বদলালেন উত্তরবঙ্গের হালকা প্রকৌশলশিল্প
  • গাজায় ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করেছে ইসরায়েল 
  • নাগরপুর বাজারে ‘পলিথিনমুক্ত’ পরিবেশ গড়তে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগ
  • মাসল গেইন বা পেশি গঠনের জন্য কেমন খাবার খাবেন