আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অচলাবস্থা
Published: 28th, June 2025 GMT
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। ঢাকায় এনবিআর ভবন থেকে শুরু করে সংস্থাটির চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর এবং ঢাকা কাস্টমস হাউসসহ দেশের সব কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সব ধরনের শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ আছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি আজ শনিবার সকাল ছয়টায় শুরু হয়। কর্মসূচির প্রথম দিনে আজ শুরু থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) কোনো কাজ হয়নি। এনবিআর ভবনের ভেতরে কেউ ঢুকতে পারেননি। অফিস সময় শেষ হওয়ার আগে ভেতর থেকেও কাউকে বের হতে দেওয়া হয়নি। এতে এনবিআরের সব সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। খবর আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো।
রাজস্ব খাতের সংস্কার এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আজ ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করেন সংস্থাটির আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি আজ থেকে সারা দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়ে শুরু হয়েছে লাগাতার ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি।
চট্টগ্রাম থেকে বিশেষ প্রতিবেদক জানান, আজ শনিবার সকাল ছয়টায় এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন। তবে কিছু জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো কার্যক্রম চালু রয়েছে। কারণ, এসব জাহাজের নিবন্ধনসহ অন্যান্য কার্যক্রমের অনুমোদন আগেই হয়েছে। তবে নতুন আসা যেসব জাহাজের নিবন্ধন হয়নি। ফলে বন্দরের জেটিতে সেসব জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ থাকবে না। অর্থাৎ কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে পুরো বন্দর অচল হয়ে পড়বে।
জানতে চাইলে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগের অনুমোদন থাকায় জেটিতে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ চলছে। তবে রপ্তানি শুল্কায়ন না হলে পণ্য রপ্তানি করা যাবে না।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই কর্মসূচি আমদানি-রপ্তানিতে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। কারণ, কাস্টমসের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পুরো বন্দরে অচলাবস্থা তৈরি হবে।
যশোর অফিস জানায়, আজ শনিবার সকাল থেকেই বেনাপোল কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের কেউ চেয়ারে বসেননি। কর্মচারীরাও কাজ করেননি। ফলে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়নি। এতে এই বন্দরে পণ্যের জট বাঁধার শঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে বন্দর ব্যবহারকারী মতিয়ার রহমান বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তাদের শাটডাউনের কারণে আজ অন্তত ১০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি ও ৪০০ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়নি। এতে শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। আজ বিকেল পর্যন্ত ভারত থেকে কোনো আমদানি পণ্য দেশে আসেনি। আবার ভারতেও যায়নি কোনো রপ্তানি পণ্য। বন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা ও বন্দর পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা পানামা পোর্টলিংক লিমিটেডের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাঁরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছেন। এ জন্য শুল্ক আদায়ের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকবে এই স্থলবন্দরে। কর্মকর্তারা আরও জানান, কর্মসূচির কারণে বন্দরে অন্তত রপ্তানি পণ্যবাহী ছয়টি ট্রাক আটকা পড়েছে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার আরিফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, আ সারা দিন শাটডাউন কর্মসূচি পালনের পর সন্ধ্যা নাগাদ কেন্দ্র থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে তা সোনামসজিদ স্থলবন্দরেও পালন করা হবে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মাঈনুল ইসলাম জানান, কর্মসূচির কারণে আমদানি–রপ্তানি একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওপারে ভারতের মহদিপুর স্থলবন্দরে বাংলাদেশের আমদানি পণ্য নিয়ে কয়েক শ ট্রাক আটকা পড়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আগাম সই করে রাখা কাগজপত্রের মাধ্যমে আজ ২৬ গাড়ি পণ্য আগরতলায় রপ্তানি করা গেছে। এর বাইরে অন্য আর কোনো পণ্যবাহী গাড়ি আখাউড়া স্থলবন্দরে আসেনি। হাসিবুল হাসান নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে কাগজপত্র তৈরি থাকা পণ্য পাঠানো হয়েছে।’
আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, শনিবার তিন গাড়িতে ৩০ টন আটা ও ২৩ গাড়িতে ১১৫ টন মাছ আগরতলায় রপ্তানি হয়েছে।
নেসার আহমেদ ভূঁইয়া নামে আখাউড়া স্থলবন্দরের এক ব্যবসায়ী জানান, বন্দরে একপ্রকার অচলাবস্থা চলছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কখন সমস্যার সমাধান হয়, সেটা জানা নেই।
স্থলবন্দরটির রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব কর্মকর্তা-কর্মচারী স্টেশনে অবস্থান করছি। এটি আন্তর্জাতিক বন্দর। দুই দেশের যাত্রীদের পারাপার চলছে। নতুন করে কোনো পণ্যের কাগজপত্র নিয়ে কোনো ব্যবসায়ী বন্দরে আসেননি।’
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আজ আমদানি-রপ্তানি ও শুল্কায়নসংক্রান্ত কার্যক্রম হয়নি। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে দাপ্তরিক কার্যক্রম ও আমদানি পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। এদিন ভুটান থেকে আমদানি করা পাথর নিয়ে ১৪৮টি ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করে। তবে কোনো পণ্যেরই শুল্ককর আদায়সহ ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ফলে এসব গাড়ি এখন আমদানি করা পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাড়িগুলো এখন আমদানি পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে। এতে আমদানিকারদের পাশাপাশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আজ শনিবার এই বন্দর দিয়ে কিছুটা কম পণ্য রপ্তানি হয়। বিকেল পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য নিয়ে কোনো গাড়ি বন্দরে আসেনি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক কর মকর ত ব যবস য় ক স টমস আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্কের উদ্বেগজনক ধারা চলছে
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে অশুল্ক বাধার ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কের দুই দেশের জন্য একটি উদ্বেগজনক ধারা চলছে। সম্প্রতি ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চার ধরনের পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির পরিবর্তে শুধু মুম্বাইয়ের নাভোসেভা বন্দরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।
এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রবাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ৯৯ শতাংশের বেশি রপ্তানি স্থলপথেই ভারতে যায়। এই নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু খরচ বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধরনের লজিস্টিক জটিলতাও তৈরি করবে। যদিও ভারত এসব সিদ্ধান্তকে নিয়মকানুন বা গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে দেখাতে পারে। কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞার হঠাৎ প্রয়োগ ও পুনরাবৃত্তি একটি কৌশলগত উদ্দেশ্যের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি করে।
তবে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও একই পথে হাঁটছে। ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতীয় সুতা ও কয়েকটি পণ্যের আমদানিতে স্থলবন্দর দিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তবর্তী তিনটি স্থলবন্দর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, অবকাঠামোর অভাব ও সীমিত বাণিজ্য কার্যক্রম। এসব পদক্ষেপকে দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনা ও নিয়ন্ত্রণমূলক প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এসবই একধরনের রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতির ইঙ্গিত দেয়, যা পারস্পরিক আস্থা ও দ্বিপক্ষীয় স্থিতিশীল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এত দিন ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে পরিচিত ভারত ও বাংলাদেশ এখন বাণিজ্য সমস্যা সমাধানে স্বচ্ছ সংলাপের পরিবর্তে একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও অশুল্ক বাধার দিকে ঝুঁকছে। এসব পদক্ষেপ শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষতি করছে না (যেখানে ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারসাম্যহীনভাবে বেশি রপ্তানি হয়। ভারত থেকে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি হয় মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের মতো), বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতির সম্ভাবনাও ধ্বংস করছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা যখন বাড়ছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা দরকার। এর পাশাপাশি সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ না করা। এসব সরবরাহ চেইন ভেঙে দেয় এবং শিল্পোন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করা উচিত, যা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে মুক্ত। বাণিজ্যকে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহনশীলতার মাধ্যম হিসেবে দেখা, চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার নয়। দুই সরকারকেই কাঠামোগত আলোচনায় অগ্রাধিকার দিতে হবে, অশুল্ক বাধা–সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সহজতর করতে প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক মতভেদ যেন বৃহত্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুফলকে ছাপিয়ে না যায়। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অনেকটাই এ সহযোগিতার ওপর নির্ভর করছে।