চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) দেয়ালগুলো যেন আবারও হয়ে উঠছে ‘দলীয় আদর্শ প্রচারের ক্যানভাস’। ৫ আগস্টের আগে দেয়ালজুড়ে চোখে পড়ত এক বা দুই ছাত্র সংগঠনের চিকা, এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অনেক সংগঠনের স্লোগান। ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে দেয়ালের রং বদলে গেছে, দেয়ালে দৃশ্যমান হয়েছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ, বামপন্থি ও পাহাড়ি ছাত্র সংগঠনগুলো। দেয়াল লিখনে ফুটে উঠছে শিক্ষার্থীদের ভাবনা, উদ্বেগ ও আশার কথাও।
ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের চিকা খুব কম, ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় তারা চিকা মারছে না বলে জানিয়েছে। তারা অভিযোগ করেছে, ৫ আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেয়ালের চিকা মুছে ফেললেও কয়েকটি সংগঠন যত্রতত্র চিকা মেরে পরিবেশ নষ্ট করছে, দেয়াল দখলের রাজনীতি করছে। একটি সংগঠনের চিকার পাশে অন্য সংগঠন নতুন চিকা মারছে, কোনো সংগঠনের চিকা মুছে অন্য সংগঠন নতুন চিকা মারছে।
দেয়ালজুড়ে কারা সক্রিয়: ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসের দেয়ালে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে রাজনৈতিক চিকার বৈচিত্র্য। আগে যেখানে কেবল ছাত্রলীগের চিকা দাপটের সঙ্গে দেখা যেত, সেখানে এখন বামপন্থি ছাত্র সংগঠন (ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র কাউন্সিল), ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং পাহাড়ি ছাত্র সংগঠনগুলোর নানা স্লোগান শোভা পাচ্ছে।
দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্লোগানগুলোতে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বার্তা, ইসলামী আদর্শের প্রচার এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আহ্বান উঠে এসেছে। অনেক চিকায় সরাসরি প্রশাসনের সমালোচনাও দেখা যাচ্ছে।
দেয়ালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের চিকার ভাষা–‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’, ‘শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করুন, ‘মেধা ও সততায় গড়ব, সবার বাংলাদেশ।’ তারা আরও লিখেছে, ‘আমাদের ভয় দেখিয়ে শয়তান নিজেই অন্ধকারে পালিয়ে যায়।’
অন্যদিকে বাম সংগঠনের দেয়াল লিখন জরঘনিষ্ঠ। গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল লিখেছে– ‘ভাত, কাজ সুবিচার, দয়া নয় অধিকার।’ বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর চিকা– ‘প্রশাসনিক জটিলতা বন্ধ করো।’
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দেয়াল লিখনে মানুষের মনের ভাষা– ‘পাহাড় সমতলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাও’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড বানানোর ষড়যন্ত্র রুখে দাও’।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন দাবি করছে, চিকার মাধ্যমে তারা মূলত মতাদর্শিক বার্তা ও শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া তুলে ধরছে। অনেকের মতে, এটি রাজনৈতিক অবস্থান জানানোর কৌশল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ছাত্র সংগঠনের নেতারা যা বলেন: বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের দেয়াল লিখন কম। এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান সমকালকে বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। অতীতে ছাত্রলীগ যত্রতত্র চিকা মেরে সেই সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। অভ্যুত্থানের পর আমরা চেয়েছিলাম পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস ফিরে আসুক, সে কারণে আমরা দেয়ালে চিকা মারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও চিকা মুছে দেয়াল পরিষ্কার করেছিল। কিন্তু এখন আবার কিছু সংগঠন দেয়াল দখলের রাজনীতি শুরু করেছে, যা শিক্ষার্থীদের বিরক্ত করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চিকার গুরুত্ব স্বীকার করি, তবে যেখানে সেখানে চিকা মেরে পরিবেশ নষ্টের পক্ষে নই। বর্তমানে অনলাইনই বড় প্রচারমাধ্যম। তারপরও আমরা রেলস্টেশনে বড় একটি চিকা মেরেছি ও কয়েকটি গ্রাফিতি এঁকেছি, যেখানে যা উপযুক্ত মনে হয়েছে। চিকার রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও সেটি যেন পরিবেশ নষ্টের কারণ না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।’
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর জশদ জাকির বলেন, ‘আমরা চিকার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও শোষণের ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। এটি কোনো শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়। চিকা হলো শিক্ষার্থীদের দাবি প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানকে বোঝানোর একটি মাধ্যম। তবে চিকার ক্ষেত্রে দখলদারিত্বের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়, যেখানে বিভিন্ন সংগঠন অন্যদের চিকা মুছে নিজেরা চিকা মারে। সহিষ্ণুতার পরিবেশ গড়ে তোলা প্রশাসনের ভূমিকার ওপর নির্ভর করছে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক তামজীদ উদ্দিন বলেন, ‘দেয়াল লিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে বার্তা সহজে পৌঁছানো যায়। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থই বড় হয়ে উঠছে। দেয়াল
লিখন দলের
প্রচারের হাতিয়ার হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দেয়াল বা পরিচিতমূলক সাইনবোর্ডেও একটি রাজনৈতিক সংগঠন চিকা মেরে রাখে। এতে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের চিকাই বেশি দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী সমকালকে বলেন, “চিকা হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। আমাদের চিকার মূল উদ্দেশ্য হলো, মতাদর্শ ও দাওয়াত প্রচার, প্রতিবাদ ও দাবি আদায়। আমরা কুরআন-হাদিসের বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করি। অন্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। প্রশাসন জুলাইয়ের পর অনেক চিকা মুছে দিয়েছে, যা তাদের দায়িত্ব।’
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা বলেন, “আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লিখেছি ‘পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত কর।’ সমতলের মানুষকে পাহাড়ের বাস্তবতা জানানোর জন্যই আমরা চিকা লিখি।’
সাধারণ শিক্ষার্থীরা কী ভাবছে : মৎস বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী উদয় দাশ তীর্থ বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন দেয়ালে চিকা মেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। তারা শুধু নিজেদের দলের প্রচারেই ব্যস্ত, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা তুলে ধরার উদ্যোগ কম।’ সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তায়েফ আল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে চিকা মারার ইতিবাচক দিকই বেশি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত প্রকাশের জন্য চিকা কার্যকর একটি মাধ্যম। দেয়াল লিখনের মাধ্যমে আমরা আমাদের দাবি ও আন্দোলনের কথা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারি। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও তাদের অবস্থান জানাতে দেয়াল ব্যবহার করে থাকে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ ত র স গঠন র জন ত ক স ৫ আগস ট র স ন দর য পর ব শ ন র র জন ত ছ ত রদল স গঠন র ক স গঠন আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা: নুরুল হক
বাংলাদেশে আগামীতে অনেক ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, ‘সেই সংকট থেকে আগামীতে ওয়ান–ইলেভেনের কিংবা ফ্যাসিবাদের পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়ে গেছে। নির্বাচন হবে, কেউ সরকারে যাবে অন্যরা বিরোধী দলে; পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও এখনো শঙ্কা কাটেনি।’
আজ রোববার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আঠারো থেকে চব্বিশ, কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্রসংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় নুরুল হক এ কথা বলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদ এ সভার আয়োজন করে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি (সহসভাপতি) নুরুল হক বলেন, ‘এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যদি লক্ষ করেন, রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নাই। যখন ছাত্রসংগঠনগুলো সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করেছিল, তখন রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানেও রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারে নাই। এখন যদি আসল কথা বলি, অনেকের সাংগঠনিক শক্তি, জনশক্তি আমার বিরুদ্ধে নানান প্রোপাগান্ডা ছড়াবে।’
চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব রাজনৈতিক দলের সব নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, আপনারা ১৯ জুলাইয়ের বীভৎসতা সম্পর্কে জানেন। সেই পরিস্থিতির পরও যদি আমরা কিছু না করতে পারি, তাহলে আমাদের ভয় নিয়ে এ দেশে বাস করতে হবে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলো আর বসে থাকবেন না, সিদ্ধান্ত নেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বরিশালের আঞ্চলিক এক বড় নেতা বললেন, ‘‘তোমাগো কি খাইয়াদাইয়্যা কাম নাই, খালি সরকার পতন খুঁজো সব জায়গায়, কোটার মধ্যেই থাকো।’’ আমরা যে একদফায় যাব, এটায় তিনি একমত নন। এ রকম আরও অনেকেই সরকারের পতনের একদফায় একমত হননি।’
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রসংগঠনগুলোকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে নুরুল হক বলেন, ‘নব্বই দশক থেকে ফ্যাসিবাদী আমল পর্যন্ত অস্ত্রের ঝনঝনানি, পেশিশক্তি ও আধিপত্যের রাজনীতির বিপরীতে সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ ও সৃজনশীল মেধাভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চার পদক্ষেপ নিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখি নাই। কারণ, তারা ছাত্রসংগঠনগুলোকে রাজনীতিতে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। মেধাবীদের পরিবর্তে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য একদল গুন্ডার হাতে ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্ব তুলে দিয়েছে। যার জন্য ছাত্ররাজনীতি তরুণদের কাছে ঘৃণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্ররাই আমার ভরসা। তারাই যেকোনো সংকটে লড়াই করেছে, তারাই জীবন দিয়েছে। আগামীতেও ছাত্রদের সজাগ থাকতে হবে।’
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ২০১৮ সালের কোটার সংস্কার আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক মাসুদ মোন্নাফ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আল শাহারিয়া শুভর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সভাপতি মেহেদী হাসান মারুফ।