ক্ষমতার ন্যায্য বাঁটোয়ারার প্রশ্নে উচ্চকক্ষের ভূমিকা কী
Published: 29th, June 2025 GMT
রাজনৈতিক ক্ষমতার ন্যায়সংগত বাঁটোয়ারার অভাব আমাদের রাজনীতির প্রধান এক সমস্যা। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি বিন্দুতে বা ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত হয়। এমন রাষ্ট্রকাঠামোতে অন্তর্নিহিত বন্দোবস্তের অধীন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বা বিতরণ সম্ভব হয় না। এ জন্য আলাদাভাবে ক্ষমতা বণ্টনের বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়।
আমাদের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’, অর্থাৎ ভোটে যিনি এগিয়ে থাকবেন, তিনিই জয়ী হন। এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ভোট যা–ই হোক না কেন, হেরে গেলে তার পুরোটাই মূল্যহীন। এ নীতির কারণে ক্ষমতা বণ্টনের অন্যান্য পদ্ধতির অনুপস্থিতিতে বাস্তবে তা ‘উইনার্স টেক অল’ হয়ে যায়; পরাজিত ব্যক্তি বা দলের জন্য কিছুই থাকে না। আত্মগর্বী দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক মননের বিরাট উন্নতি ছাড়া একদম অল্প ভোটে হেরে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন হয়ে যাওয়ার বিষয়টা মেনে নেওয়া আসলেই কঠিন।
ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের যে সংসদীয় গণতন্ত্র, যার অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় আইনসভার নিম্নকক্ষের বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। আইনসভায় সরকারকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহির মধ্যে রাখে তারা।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে বিরোধী দল থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়, এমনকি একটি ছায়া সরকারও গঠন করে; আর সরকারকেও সর্বোচ্চ উদারতার সঙ্গে এসব বস্তুনিষ্ঠ বিরোধিতা সহ্য করতে হয়। এভাবে সরকারের অপরিসীম নির্বাহী ক্ষমতায় তৈরি হয় ভারসাম্য। ফলে বিরোধীরা সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিপক্ষ হয়েই ‘অপেক্ষমাণ সরকার’ হিসেবে সংসদে সহাবস্থান করে।
২.আমাদের আইনসভার ধরন কেমন হবে, এ নিয়ে গণপরিষদ সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছিলেন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি খসড়ায় তা না রাখায় তিনি কমিটির প্রতিবেদনে ভিন্নমত আকারে অন্তর্ভুক্ত করেন এভাবে, একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত ৬০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ থাকবে। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সমান ক্ষমতা থাকবে, শুধু অর্থ বিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের একক অধিকার থাকবে। দুই কক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য হলে ফয়সালা হবে যৌথ অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে।
হাফেজ হাবীবুর রহমানের যুক্তি ছিল, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় আধিপত্যের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এখানে দ্বিতীয় কক্ষ থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কোনো অঙ্গকেই অনিয়ন্ত্রিত ও দুর্দমনীয় ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়। বিশেষত সংবিধানের খসড়ায় আমরা কিছু বিধানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে সংকুচিত করেছি। তাই সংসদের সর্বব্যাপক ক্ষমতার ওপর আমাদের অন্তত কিছু সংশোধনমূলক বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।…দৃঢ়প্রত্যয়ের কোনো মেধাবী ব্যক্তি সাধারণ ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারেন, কিন্তু তাঁর প্রজ্ঞা, পরামর্শ, অভিজ্ঞতা ও স্বাধীন চেতনা জাতির জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় হতে পারে।’
এ প্রস্তাবের মধ্যে সদস্য নির্বাচনের বিষয়টির সঙ্গে বিএনপির দেওয়া ৩১ দফার মিল রয়েছে। বিএনপির ৩১ দফায় ‘দেশে প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, কিন্তু দেশ গঠন, উন্নয়ন ও পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে চান, এমন’ এবং ‘বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইনসভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন’–এর কথা বলা হয়েছে। ক্ষমতার প্রশ্নে এটা অনেকটা যুক্তরাজ্যের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের মতো।
হাফেজ হাবীবুর রহমানের সেই প্রস্তাব অবশ্য ধোপে টেকেনি; সেটা বা উচ্চকক্ষের জন্য আরও উৎকৃষ্ট কোনো প্রস্তাব গ্রহণ না করার ফল আমরা ভালোভাবেই টের পেয়েছি ৫৪ বছর ধরে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তার অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলো অতিক্রম করতে না পেরে জাতীয় প্রতিনিধি সভায় উপনীত হতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পুরো দেশের আইনপ্রণেতা হওয়ার বদলে নিজ নির্বাচনী এলাকার স্থানীয় শাসকে পরিণত হয়েছেন। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় কিছু অভিজাত গোষ্ঠী, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর পুঁজিপতিদের কবজায়। এর চূড়ান্ত কদর্যরূপ দেখা গিয়েছিল শেখ হাসিনার বিগত শাসনামলে।
৩.
শাসনতান্ত্রিক অভিযাত্রায় নিজেদের পরিসরে আমরা ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির কেবল সংসদীয় গণতন্ত্রের খোলসটুকুই নিয়েছি, এর ভেতরের প্রাণটির নাগাল মেলেনি বা ধরতেই চাইনি। ফলে পাঁচ বছর পরপর একটিমাত্র কালান্তক দিনে হওয়া নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে জিততে না পারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘পরাভূত শত্রু’ মনে করে তাকে হেয়জ্ঞান উপেক্ষা আর ক্ষেত্রবিশেষে নিকেশ করতে চাওয়ার বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজয়ীর বাসনা।
অন্যদিকে সামান্য ব্যবধানে জিততে ব্যর্থ হওয়াকে বিরোধী দলগুলো নিজেদের অস্তিত্বের সংকট হিসেবে ধরে নেয় বা ধরতে বাধ্য হয়। ফলে সরকারকে এক দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে না দেওয়ার পণ করে দায়িত্বহীন আচরণ করাকে বিরোধী দলগুলো তাদের অধিকার মনে করতে থাকে। এই মল্লযুদ্ধের ফলে আইনসভা অকার্যকর হয় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে হতে একসময় পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই স্থবির হয়ে পড়ে।
এ রকম বিভক্ত-বিভাজিত রাজনৈতিক পরিসরে জনসমর্থনের সমানুপাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ন্যায্য বাঁটোয়ারা হলে সংঘাত কমে আসবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টনের একটি লাগসই রাষ্ট্রনৈতিক প্রযুক্তি হতে পারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত উচ্চকক্ষ।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে একমত হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে, তার অন্যতম হলো সংসদের একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫)। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে, এটা নিয়ে কোনো দর–কষাকষি চলবে না—এমন সংস্কার হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। উচ্চকক্ষের গঠন কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এমন কিছু যে দরকার, তা নিয়ে মতানৈক্য নেই, সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
৪.
সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে উচ্চকক্ষে ১০৫টি আসন থাকবে। এর মধ্যে ১০০টি আসন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাপ্ত মোট ভোটের আনুপাতিক হারে বণ্টন হবে। আসন পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে কমপক্ষে ১% ভোট পেতে হবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন মনোনীত করবেন রাষ্ট্রপতি।
অর্থবিল ছাড়া অন্য সব বিল উচ্চকক্ষে উপস্থাপিত হবে। উচ্চকক্ষ একবারে দুই মাসের বেশি তা আটকে রাখতে ও দুইবারের বেশি সেই বিল ফেরত দিতে পারবে না। তৃতীয়বার নিম্নকক্ষে পাস হলে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য চলে যাবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির অভিশংসন, সংবিধান সংশোধন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রেও উচ্চকক্ষের ক্ষমতা থাকবে।
উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে সমাজের ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেওয়ার ধারণা অনেকভাবেই ত্রুটিপূর্ণ। অনেকটা এ পদ্ধতিতেই বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো বণ্টিত হয়, যা কোনোভাবেই নাগরিক প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি এবং রাষ্ট্রকাঠামোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাস্তব কোনো অগ্রগতিও এতে সূচিত হয়নি।
অন্যদিকে সরকার পরিচালনার জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন মেটাতে উচ্চকক্ষে এই ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের সদস্য করার বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, এ জন্য ১০ শতাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নিয়োগের সুযোগ আছে। চাইলে সেটা আরও বাড়ানো যেতে পারে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের সব ধরনের নির্বাহী কাজ থেকে দূরে রেখে সংসদীয় বিতর্ক, আইনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদারকিকে নিবিষ্ট রাখাই শ্রেয়।
আরও পড়ুনআনুপাতিক উচ্চকক্ষই এখন সংস্কারের প্রধান চাওয়া এবং কেন?১২ জুন ২০২৫৫.
উচ্চকক্ষ গঠন প্রশ্নে কমিশন প্রস্তাবিত কিছু সুপারিশও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত পাঁচটি সংরক্ষিত আসনের সুপারিশ বাতিল করা উচিত। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে (ভোটের আনুপাতিক হারে) উচ্চকক্ষে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর সদস্য সংখ্যার ব্যবধান কম থাকবে বলে ধারণা করা যায়। ব্যবধান কম থাকায় পাঁচটি আসন দিয়ে উচ্চকক্ষের সমতা বিনষ্ট ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
আবার এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে বড় দলগুলো যেন অবশিষ্ট আসন থেকে উচ্চকক্ষে কোনো বোনাস আসন না পায়। অন্যথায় এটি ভোটারদের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করবে। এই লক্ষ্যে ১ শতাংশের কম ভোট পাওয়া দলগুলোকেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও নিজেদের মধ্যে নির্বাচন–পরবর্তী জোট গঠনের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এতে অপচয়িত ও কৌশলগত ভোট দূরীভূত হয়ে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে।
দলগুলোকে নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের জন্য তাদের মনোনীত ১০০ সদস্যের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে মনোনয়ন বেচাকেনা রোধ করা যাবে—এমনটা ধারণা করা যায়। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার যাতে একই দল থেকে নির্বাচিত না হতে পারে, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে এটা জরুরি।
৬.
উচ্চকক্ষে আসন নিশ্চিতের জন্য কেউ কেউ ন্যূনতম ভোটহার কিছুটা উচ্চ হারে, যেমন ৫, ৮ বা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করার দাবি করছেন। এটা উচ্চকক্ষে ছোট রাজনৈতিক দলের কণ্ঠস্বরকে যেমন রুদ্ধ করবে, তেমনি জনমতের ন্যায়সংগত প্রতিফলনও তাতে থাকবে না। ২০০২ সালে তুরস্কের নির্বাচনে ন্যূনতম ভোটহার ১০ শতাংশ থাকায় কেবল দুটি দল এই সীমা পেরোতে পেরেছিল। এ সুযোগে এরদোয়ানের একে পার্টি ৩৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েই দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে, যা ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেয়।
ভোট গ্রহণ প্রশ্নেও অন্যান্য দেশে প্রচলিত একাধিক ব্যালট, ‘র্যাংকড চয়েজ’ ইত্যাদি পদ্ধতি পরিহার করে একটিমাত্র ব্যালটেই উভয় কক্ষের নির্বাচন সম্পন্ন করা যেতে পারে। সেসব জটিল পদ্ধতি বোঝা ও প্রয়োগ করা আমাদের দেশের ভোটারদের জন্য অসুবিধাজনক হতে পারে। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হতে পারেন।
৭.
ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ বলা যায়। এখনো পরিপক্ব হয়ে উঠতে না পারা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় শুরুতেই উচ্চকক্ষকে খুব বেশি ক্ষমতা দিয়ে দিলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বদলে আলাদা ভরকেন্দ্র তৈরি করার ঝুঁকি থেকে যায়। এর চেয়ে বরং ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে এর সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। শুরুতে কোনো বিল উচ্চকক্ষে কেবল একবারই প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে। সেই ফেরত দেওয়া বিল নিম্নকক্ষ পাস করলে তা সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যেতে পারে।
উচ্চকক্ষকে তদারকির ক্ষমতা না দেওয়ার যথার্থতা প্রশ্নে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য সংবিধান কমিশনের প্রস্তাবিত আরেকটি ধারণা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) খুবই প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রের তিন বিভাগের শীর্ষ পদাধিকারীরা এনসিসিকে উপলক্ষ করে যদি মাঝেমধ্যে এক টেবিলে বসে আলোচনায় লিপ্ত হন, তাহলে এটি মূল কাজের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য একটি কার্যকর ফোরাম হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। তবে এনসিসি যদি একেবারেই বাদ পড়ে যায়, তাহলে উচ্চকক্ষকে শুরুতে অল্প কিছু উচ্চপর্যায়ের নিয়োগ, অপসারণ ও তদারকির ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।
উচ্চকক্ষে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পাহাড়ি জনজাতি ও আমাদের অর্থনীতির তিন চালিকা শক্তি কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসীদের জন্য আসন বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোই তাঁদের আসন অনুপাতে এসব সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দিতে পারে। উচ্চকক্ষের নাম কী হবে, সেটা নিয়েও মতানৈক্য দেখা গেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নতুন দল এনসিপি যথাক্রমে ‘সিনেট’ ও ‘জাতীয় পরিষদ’ প্রস্তাব করেছে। ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’, ‘রাষ্ট্রসভা’, ‘সাধারণ পরিষদ’, ‘জাতীয় সভা’, ‘প্রতিনিধি পরিষদ’ হতে পারে কিছু বিকল্প নাম।
নির্বাচনে ‘বিজয়ীই সব পাবে’ পদ্ধতির তিক্ত অভিজ্ঞতার পর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে কিছু ইতিবাচক ইচ্ছা প্রকাশ করেছে; অবশ্যই এতে তাদের নিজস্ব পদ্ধতি, অনুপাত, স্বার্থ ইত্যাদি রয়েছে। তবু অন্তত নীতিগতভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সহাবস্থান করতে যে তারা প্রস্তুত, এটাকে সাধুবাদ জানানো যায়। দলগুলোর এমন ইতিবাচকতাকে আমলে নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে জনগণের মিলেমিশে থাকার ও একটি আত্মমর্যাদাবান জনগোষ্ঠী হিসেবে বেড়ে ওঠার উপযোগী রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের সুযোগ নষ্ট করা যাবে না।
মিল্লাত হোসেন সংবিধান, আইন ও আদালতবিষয়ক লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক ষমত ন ম নকক ষ র র র জন ত ক র জন ত ক স র ষ ট রপত ভ রস ম য ত র জন য প রস ত ব র সদস য র ব ষয়ট র ক ষমত ক ষমত র ব যবধ ন ন র জন র একট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষমতার ন্যায্য বাঁটোয়ারার প্রশ্নে উচ্চকক্ষের ভূমিকা কী
রাজনৈতিক ক্ষমতার ন্যায়সংগত বাঁটোয়ারার অভাব আমাদের রাজনীতির প্রধান এক সমস্যা। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি বিন্দুতে বা ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত হয়। এমন রাষ্ট্রকাঠামোতে অন্তর্নিহিত বন্দোবস্তের অধীন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বা বিতরণ সম্ভব হয় না। এ জন্য আলাদাভাবে ক্ষমতা বণ্টনের বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়।
আমাদের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’, অর্থাৎ ভোটে যিনি এগিয়ে থাকবেন, তিনিই জয়ী হন। এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ভোট যা–ই হোক না কেন, হেরে গেলে তার পুরোটাই মূল্যহীন। এ নীতির কারণে ক্ষমতা বণ্টনের অন্যান্য পদ্ধতির অনুপস্থিতিতে বাস্তবে তা ‘উইনার্স টেক অল’ হয়ে যায়; পরাজিত ব্যক্তি বা দলের জন্য কিছুই থাকে না। আত্মগর্বী দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক মননের বিরাট উন্নতি ছাড়া একদম অল্প ভোটে হেরে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন হয়ে যাওয়ার বিষয়টা মেনে নেওয়া আসলেই কঠিন।
ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের যে সংসদীয় গণতন্ত্র, যার অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় আইনসভার নিম্নকক্ষের বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। আইনসভায় সরকারকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহির মধ্যে রাখে তারা।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে বিরোধী দল থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়, এমনকি একটি ছায়া সরকারও গঠন করে; আর সরকারকেও সর্বোচ্চ উদারতার সঙ্গে এসব বস্তুনিষ্ঠ বিরোধিতা সহ্য করতে হয়। এভাবে সরকারের অপরিসীম নির্বাহী ক্ষমতায় তৈরি হয় ভারসাম্য। ফলে বিরোধীরা সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিপক্ষ হয়েই ‘অপেক্ষমাণ সরকার’ হিসেবে সংসদে সহাবস্থান করে।
২.আমাদের আইনসভার ধরন কেমন হবে, এ নিয়ে গণপরিষদ সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছিলেন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি খসড়ায় তা না রাখায় তিনি কমিটির প্রতিবেদনে ভিন্নমত আকারে অন্তর্ভুক্ত করেন এভাবে, একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত ৬০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ থাকবে। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সমান ক্ষমতা থাকবে, শুধু অর্থ বিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের একক অধিকার থাকবে। দুই কক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য হলে ফয়সালা হবে যৌথ অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে।
হাফেজ হাবীবুর রহমানের যুক্তি ছিল, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় আধিপত্যের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এখানে দ্বিতীয় কক্ষ থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কোনো অঙ্গকেই অনিয়ন্ত্রিত ও দুর্দমনীয় ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়। বিশেষত সংবিধানের খসড়ায় আমরা কিছু বিধানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে সংকুচিত করেছি। তাই সংসদের সর্বব্যাপক ক্ষমতার ওপর আমাদের অন্তত কিছু সংশোধনমূলক বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।…দৃঢ়প্রত্যয়ের কোনো মেধাবী ব্যক্তি সাধারণ ভোটারের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারেন, কিন্তু তাঁর প্রজ্ঞা, পরামর্শ, অভিজ্ঞতা ও স্বাধীন চেতনা জাতির জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় হতে পারে।’
এ প্রস্তাবের মধ্যে সদস্য নির্বাচনের বিষয়টির সঙ্গে বিএনপির দেওয়া ৩১ দফার মিল রয়েছে। বিএনপির ৩১ দফায় ‘দেশে প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, কিন্তু দেশ গঠন, উন্নয়ন ও পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে চান, এমন’ এবং ‘বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইনসভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন’–এর কথা বলা হয়েছে। ক্ষমতার প্রশ্নে এটা অনেকটা যুক্তরাজ্যের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের মতো।
হাফেজ হাবীবুর রহমানের সেই প্রস্তাব অবশ্য ধোপে টেকেনি; সেটা বা উচ্চকক্ষের জন্য আরও উৎকৃষ্ট কোনো প্রস্তাব গ্রহণ না করার ফল আমরা ভালোভাবেই টের পেয়েছি ৫৪ বছর ধরে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তার অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলো অতিক্রম করতে না পেরে জাতীয় প্রতিনিধি সভায় উপনীত হতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পুরো দেশের আইনপ্রণেতা হওয়ার বদলে নিজ নির্বাচনী এলাকার স্থানীয় শাসকে পরিণত হয়েছেন। আর রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় কিছু অভিজাত গোষ্ঠী, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর পুঁজিপতিদের কবজায়। এর চূড়ান্ত কদর্যরূপ দেখা গিয়েছিল শেখ হাসিনার বিগত শাসনামলে।
৩.
শাসনতান্ত্রিক অভিযাত্রায় নিজেদের পরিসরে আমরা ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির কেবল সংসদীয় গণতন্ত্রের খোলসটুকুই নিয়েছি, এর ভেতরের প্রাণটির নাগাল মেলেনি বা ধরতেই চাইনি। ফলে পাঁচ বছর পরপর একটিমাত্র কালান্তক দিনে হওয়া নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে জিততে না পারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘পরাভূত শত্রু’ মনে করে তাকে হেয়জ্ঞান উপেক্ষা আর ক্ষেত্রবিশেষে নিকেশ করতে চাওয়ার বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজয়ীর বাসনা।
অন্যদিকে সামান্য ব্যবধানে জিততে ব্যর্থ হওয়াকে বিরোধী দলগুলো নিজেদের অস্তিত্বের সংকট হিসেবে ধরে নেয় বা ধরতে বাধ্য হয়। ফলে সরকারকে এক দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে না দেওয়ার পণ করে দায়িত্বহীন আচরণ করাকে বিরোধী দলগুলো তাদের অধিকার মনে করতে থাকে। এই মল্লযুদ্ধের ফলে আইনসভা অকার্যকর হয় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে হতে একসময় পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই স্থবির হয়ে পড়ে।
এ রকম বিভক্ত-বিভাজিত রাজনৈতিক পরিসরে জনসমর্থনের সমানুপাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ন্যায্য বাঁটোয়ারা হলে সংঘাত কমে আসবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টনের একটি লাগসই রাষ্ট্রনৈতিক প্রযুক্তি হতে পারে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত উচ্চকক্ষ।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে একমত হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে, তার অন্যতম হলো সংসদের একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫)। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে, এটা নিয়ে কোনো দর–কষাকষি চলবে না—এমন সংস্কার হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। উচ্চকক্ষের গঠন কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এমন কিছু যে দরকার, তা নিয়ে মতানৈক্য নেই, সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
৪.
সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে উচ্চকক্ষে ১০৫টি আসন থাকবে। এর মধ্যে ১০০টি আসন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাপ্ত মোট ভোটের আনুপাতিক হারে বণ্টন হবে। আসন পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে কমপক্ষে ১% ভোট পেতে হবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন মনোনীত করবেন রাষ্ট্রপতি।
অর্থবিল ছাড়া অন্য সব বিল উচ্চকক্ষে উপস্থাপিত হবে। উচ্চকক্ষ একবারে দুই মাসের বেশি তা আটকে রাখতে ও দুইবারের বেশি সেই বিল ফেরত দিতে পারবে না। তৃতীয়বার নিম্নকক্ষে পাস হলে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য চলে যাবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির অভিশংসন, সংবিধান সংশোধন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রেও উচ্চকক্ষের ক্ষমতা থাকবে।
উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে সমাজের ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেওয়ার ধারণা অনেকভাবেই ত্রুটিপূর্ণ। অনেকটা এ পদ্ধতিতেই বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো বণ্টিত হয়, যা কোনোভাবেই নাগরিক প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি এবং রাষ্ট্রকাঠামোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাস্তব কোনো অগ্রগতিও এতে সূচিত হয়নি।
অন্যদিকে সরকার পরিচালনার জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন মেটাতে উচ্চকক্ষে এই ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের সদস্য করার বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, এ জন্য ১০ শতাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নিয়োগের সুযোগ আছে। চাইলে সেটা আরও বাড়ানো যেতে পারে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের সব ধরনের নির্বাহী কাজ থেকে দূরে রেখে সংসদীয় বিতর্ক, আইনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদারকিকে নিবিষ্ট রাখাই শ্রেয়।
আরও পড়ুনআনুপাতিক উচ্চকক্ষই এখন সংস্কারের প্রধান চাওয়া এবং কেন?১২ জুন ২০২৫৫.
উচ্চকক্ষ গঠন প্রশ্নে কমিশন প্রস্তাবিত কিছু সুপারিশও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত পাঁচটি সংরক্ষিত আসনের সুপারিশ বাতিল করা উচিত। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে (ভোটের আনুপাতিক হারে) উচ্চকক্ষে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর সদস্য সংখ্যার ব্যবধান কম থাকবে বলে ধারণা করা যায়। ব্যবধান কম থাকায় পাঁচটি আসন দিয়ে উচ্চকক্ষের সমতা বিনষ্ট ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
আবার এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে বড় দলগুলো যেন অবশিষ্ট আসন থেকে উচ্চকক্ষে কোনো বোনাস আসন না পায়। অন্যথায় এটি ভোটারদের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করবে। এই লক্ষ্যে ১ শতাংশের কম ভোট পাওয়া দলগুলোকেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও নিজেদের মধ্যে নির্বাচন–পরবর্তী জোট গঠনের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এতে অপচয়িত ও কৌশলগত ভোট দূরীভূত হয়ে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে।
দলগুলোকে নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের জন্য তাদের মনোনীত ১০০ সদস্যের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে মনোনয়ন বেচাকেনা রোধ করা যাবে—এমনটা ধারণা করা যায়। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার যাতে একই দল থেকে নির্বাচিত না হতে পারে, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে এটা জরুরি।
৬.
উচ্চকক্ষে আসন নিশ্চিতের জন্য কেউ কেউ ন্যূনতম ভোটহার কিছুটা উচ্চ হারে, যেমন ৫, ৮ বা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করার দাবি করছেন। এটা উচ্চকক্ষে ছোট রাজনৈতিক দলের কণ্ঠস্বরকে যেমন রুদ্ধ করবে, তেমনি জনমতের ন্যায়সংগত প্রতিফলনও তাতে থাকবে না। ২০০২ সালে তুরস্কের নির্বাচনে ন্যূনতম ভোটহার ১০ শতাংশ থাকায় কেবল দুটি দল এই সীমা পেরোতে পেরেছিল। এ সুযোগে এরদোয়ানের একে পার্টি ৩৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েই দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে, যা ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেয়।
ভোট গ্রহণ প্রশ্নেও অন্যান্য দেশে প্রচলিত একাধিক ব্যালট, ‘র্যাংকড চয়েজ’ ইত্যাদি পদ্ধতি পরিহার করে একটিমাত্র ব্যালটেই উভয় কক্ষের নির্বাচন সম্পন্ন করা যেতে পারে। সেসব জটিল পদ্ধতি বোঝা ও প্রয়োগ করা আমাদের দেশের ভোটারদের জন্য অসুবিধাজনক হতে পারে। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হতে পারেন।
৭.
ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ বলা যায়। এখনো পরিপক্ব হয়ে উঠতে না পারা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় শুরুতেই উচ্চকক্ষকে খুব বেশি ক্ষমতা দিয়ে দিলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বদলে আলাদা ভরকেন্দ্র তৈরি করার ঝুঁকি থেকে যায়। এর চেয়ে বরং ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে এর সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। শুরুতে কোনো বিল উচ্চকক্ষে কেবল একবারই প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে। সেই ফেরত দেওয়া বিল নিম্নকক্ষ পাস করলে তা সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যেতে পারে।
উচ্চকক্ষকে তদারকির ক্ষমতা না দেওয়ার যথার্থতা প্রশ্নে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য সংবিধান কমিশনের প্রস্তাবিত আরেকটি ধারণা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) খুবই প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রের তিন বিভাগের শীর্ষ পদাধিকারীরা এনসিসিকে উপলক্ষ করে যদি মাঝেমধ্যে এক টেবিলে বসে আলোচনায় লিপ্ত হন, তাহলে এটি মূল কাজের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য একটি কার্যকর ফোরাম হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। তবে এনসিসি যদি একেবারেই বাদ পড়ে যায়, তাহলে উচ্চকক্ষকে শুরুতে অল্প কিছু উচ্চপর্যায়ের নিয়োগ, অপসারণ ও তদারকির ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।
উচ্চকক্ষে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পাহাড়ি জনজাতি ও আমাদের অর্থনীতির তিন চালিকা শক্তি কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসীদের জন্য আসন বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোই তাঁদের আসন অনুপাতে এসব সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দিতে পারে। উচ্চকক্ষের নাম কী হবে, সেটা নিয়েও মতানৈক্য দেখা গেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নতুন দল এনসিপি যথাক্রমে ‘সিনেট’ ও ‘জাতীয় পরিষদ’ প্রস্তাব করেছে। ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’, ‘রাষ্ট্রসভা’, ‘সাধারণ পরিষদ’, ‘জাতীয় সভা’, ‘প্রতিনিধি পরিষদ’ হতে পারে কিছু বিকল্প নাম।
নির্বাচনে ‘বিজয়ীই সব পাবে’ পদ্ধতির তিক্ত অভিজ্ঞতার পর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে কিছু ইতিবাচক ইচ্ছা প্রকাশ করেছে; অবশ্যই এতে তাদের নিজস্ব পদ্ধতি, অনুপাত, স্বার্থ ইত্যাদি রয়েছে। তবু অন্তত নীতিগতভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সহাবস্থান করতে যে তারা প্রস্তুত, এটাকে সাধুবাদ জানানো যায়। দলগুলোর এমন ইতিবাচকতাকে আমলে নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে জনগণের মিলেমিশে থাকার ও একটি আত্মমর্যাদাবান জনগোষ্ঠী হিসেবে বেড়ে ওঠার উপযোগী রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের সুযোগ নষ্ট করা যাবে না।
মিল্লাত হোসেন সংবিধান, আইন ও আদালতবিষয়ক লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব