‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালানোর সময় ভারতের যুদ্ধবিমান নষ্টের দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপালেন ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত ভারতের ডিফেন্স অ্যাটাশে ক্যাপ্টেন শিব কুমার। তাঁর ভাষ্য, অভিযানের শুরুতেই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর জন্য গণ্ডি কেটে দিয়েছিলেন। ভারতকে ‘কিছু’ যুদ্ধবিমান সেই কারণেই হারাতে হয়েছে।

গণ্ডিটা কেমন ছিল? শিব কুমার সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের কোনো সামরিক ঘাঁটি বা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর যেন আঘাত করা না হয়। এই বাধা বা প্রতিবন্ধকতার কারণেই ভারতকে ‘কিছু’ যুদ্ধবিমান হারাতে হয়েছে।

শিব কুমার এই মন্তব্য করেছিলেন কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়াতেই এক আলোচনা সভায়। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় গত রোববার রাতে ইন্দোনেশিয়ার ভারতীয় দূতাবাস ‘এক্স’ হ্যান্ডেল মারফত এক বিবৃতি জারি করে বলেছে, ডিফেন্স অ্যাটাশের বক্তব্য সংবাদমাধ্যম প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে ব্যবহার করেছে। তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বশেষ সংঘাতে ভারত মোট কতগুলো ও কোন কোন যুদ্ধবিমান হারিয়েছে, আজও সরকারিভাবে তা জানানো হয়নি। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের দাবি পাঁচ থেকে ছয়টি। পাকিস্তানের দাবি, রাফাল, সুখোইসহ পাঁচটি যুদ্ধবিমান তারা নামিয়েছে। এই পাঁচটির মধ্যে ৩টি রাফাল, বাকি ২টির ১টি সুখোই ৩০, অন্যটি মিগ ২৯।

অসমর্থিত খবর অনুযায়ী, ওই সংঘাতের সময় একটি ড্রোন ও দুটি এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির এই খতিয়ান আজও সরকার দেয়নি। পেহেলগাম–কাণ্ড ও পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত নিয়ে আলোচনার জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার বিরোধী দাবিতেও সরকার কর্ণপাত করেনি।

পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের শুরুতেই ভারতের যুদ্ধবিমান হারানোর কথা প্রথম স্বীকার করেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান। সিঙ্গাপুরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অবসরে বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুদ্ধবিমান হারানোর কথা প্রথম স্বীকার করেন তিনি। তবে কয়টি বিমান ভূপাতিত হয়েছে, তা তিনি জানাননি।

জেনারেল অনিল চৌহান বলেছিলেন, যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়াটা বড় কথা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেদের লক্ষ্য হাসিল হচ্ছে কি না। ক্রিকেটের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, কটা উইকেট পড়ল, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা খেলায় জয় হলো কি না।

অনিল চৌহানকে সেই সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের দাবি উল্লেখ করে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ওরা ছয়টি বিমান ভূপাতিত করার কথা বলেছে। জবাবে জেনারেল চৌহান বলেছিলেন, ওই দাবি ডাহা মিথ্যা।

এবার ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত ডিফেন্স অ্যাটাশে নতুন বিতর্ক বাধালেন ‘কিছু’ বিমান নষ্টের কথা বলে। ‘কিছু’ মানে একাধিক। কিন্তু সেটা কয়টা, তা তিনি নিশ্চিত করেননি।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস নতুন করে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জয়রাম রমেশ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, কেন তিনি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে সব জানাচ্ছেন না? কেন সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি খারিজ করে দিচ্ছেন?

আরেক মুখপাত্র পবন খেরার অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখেছেন। ভুল তথ্য দিচ্ছেন। তথ্য লুকিয়ে রাখছেন।

কংগ্রেসের মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতেও এই ঘটনার পর মোদি সরকারের সমালোচনা করেছেন। তাঁর অভিযোগ, শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী তথ্য গোপন করে চলেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট অন্তত ২০ বার বলেছেন, তিনিই যুদ্ধ থামিয়েছেন। বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে যুদ্ধ থামিয়েছেন। এর অর্থ বাণিজ্যের জন্য দেশের স্বার্থের সঙ্গে তিনি আপস করেছেন। তাই ট্রাম্পের দাবি সত্ত্বেও নীরবতা পালন করছেন।

ডিফেন্স অ্যাটাশে যা বলেছেন, সেটাই ছিল ভারতের প্রাথমিক নীতি। বস্তুত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আগেই এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অভিযানের শুরুতে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ভারতের লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি। সেই নীতিই যে ‘কিছু’ যুদ্ধবিমান হারানোর কারণ, এ কথাই ডিফেন্স অ্যাটাশে ক্যাপ্টেন শিব কুমার কবুল করেছেন। জুলাই মাসে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন এ নিয়ে অবশ্যই সরগরম হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন দ ন শ য় বল ছ ল ন বল ছ ন র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় রায় হলো ৩৯৭ দিনের মাথায়

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা হয়েছিল গত বছরের ১৭ অক্টোবর। তারপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিচার। সবশেষে রায় হতে সব মিলিয়ে লাগল ৩৯৭ দিন।

আজ সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এর দেওয়া রায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার অন্য দুই আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে।

সময় তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান রয়েছেন ভারতে। তাদের দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম রয়েছে নিষিদ্ধ।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে।

পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

আরও পড়ুনরাষ্ট্র কেন শেখ হাসিনার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিল০৫ নভেম্বর ২০২৫

এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। এ বছরের ১৬ মার্চ তাঁর পাশাপাশি সাবেক আইজিপি আল-মামুনকেও আসামি করা হয়।

একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নাম প্রথমবারের মতো আসে গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদনে। সেদিন থেকে এ মামলায় আসামি হন তিনজন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও আল-মামুন।

তাঁদের বিরুদ্ধে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এর মধ্য দিয়ে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়।

এরপর গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই আল–মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন।

গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা।

মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।

আরও পড়ুনমানবতাবিরোধী অপরাধে হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড১ মিনিট আগে

এ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর।

সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। সব মিলিয়ে ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।

পলাতক শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মো. আমির হোসেন।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম আগেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সাজা হলে তাঁরা আপিল করতে পারবেন না। এর কারণ তাঁরা পলাতক। আপিল করতে হলে তাঁদের আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ