Prothomalo:
2025-07-03@01:22:28 GMT

আত্মঘাতী হেমিংওয়ে

Published: 2nd, July 2025 GMT

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের আত্মঘাতী হওয়ার বছর দেড়েক আগে থেকেই স্বামীর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন তাঁর চতুর্থ স্ত্রী মেরি ওয়েলশ। এটা শুরু হয় ১৯৬০ সালের নববর্ষের পর থেকে। বহু গোপন প্রেমিকার সান্নিধ্য ছাড়াও সুপুরুষ নারীপ্রেমী এই লেখক বিয়ে করেছেন চারটি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ততা, মুষ্টিযুদ্ধ, বুলফাইটিং, আফ্রিকাসহ নানা অরণ্যে দুঃসাহসিক শিকার, মাছ ধরার দুর্দমনীয় নেশা, প্রবল সুরাসক্তি এবং আরও সব পুরুষালী দোষগুণের অধিকারী হেমিংওয়ের উদ্দাম জীবনে একসময় ধীরে ধীরে নেমে আসে ভাটার টান। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষাটের কোঠায়, কিন্তু তাঁর মধ্যে দেখা দিতে থাকে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক ও বিমর্ষতা। ওজন কমে যাওয়া, রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণহীন ওঠানামা—সবকিছু মিলিয়ে আগের সেই বিশালদেহী মানুষটি হয়ে পড়েছেন অশক্ত দুর্বল।

এসব উপসর্গ যখন প্রথম দেখা দেয়, সে সময় তুষারপাতের কারণে বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধ, লেখালেখিতেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না তিনি। মেরি লক্ষ করেন, ঘুমও খুব কমে গিয়েছিল তাঁর। একদিন এক পারিবারিক বন্ধুর বাড়িতে ডিনার খাওয়ার সময় হেমিংওয়ে জানালা দিয়ে লক্ষ করেন, পাহাড়ের গোড়ায় স্থানীয় ব্যাংকটির ভেতর তখনো বাতি জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে তিনি সভয়ে বলেন, নিশ্চয়ই ওরা তাঁর অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছে। ব্যাংকটির ভেতরে সাফাইকর্মীরা কাজ করছে—এ কথা বলার পরও বিশ্বাস করছিলেন না তিনি। মেরি যখন চেপে ধরেন যে ‘ওরা’ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন তিনি, আর্নেস্ট তখন বলেন, এফবিআই তাঁর বিষয়ে তদন্ত করছে। এ সময় থেকেই স্বামীর মানসিক বৈকল্য নিয়ে শঙ্কা জাগতে শুরু করে মেরির ভেতর। এফবিআই-আতঙ্ক ছাড়াও এ সময় তাঁর মনে হতে থাকে যে তিনি খুবই দরিদ্র। তাঁর অমূলক আশঙ্কা দূর করার জন্য মর্গান স্ট্যানলি ট্রাস্টের এক কর্মকর্তাকেও সাক্ষী মেনেছিলেন মেরি। সেই ব্যাংকারের কথাও বিশ্বাস করেননি হেমিংওয়ে। এর মধ্যে আরেকটা নতুন ভয় তাঁর মধ্যে কাজ করতে শুরু করে। প্যারিসের রিৎজ হোটেল থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরি ও কিছু মালমসলা থেকে লেখা তাঁর প্যারিসের স্মৃতিকথা আ মুভেবল ফিস্ট বই হিসেবে প্রকাশিত হলে মানহানির মামলায় পড়বেন কি না, এ আতঙ্কও ভর করে তাঁর ওপর।

শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে মায়ো ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেন নিরুপায় মেরি। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সাল মিলিয়ে দুই দফায় এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আর্নেস্ট। দ্বিতীয়বার বিষয়টা গোপন রাখার জন্য তাঁকে ভর্তি করানো হয় ছদ্ম নামে। তবে তাঁর মতো সেলিব্রিটি লেখকের পরিচয় গোপন রাখা সম্ভব হয়নি।

প্রথমবারের ২৪ দিনে মোট ৯ বার বৈদ্যুতিক শক থেরাপি (ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি) দেওয়া হয় তাঁকে। স্মৃতিকথা হাউ ইট ওয়াজ-এ মেরি লেখেন, ‘এ সময় হাসপাতাল থেকে তাঁর কাছে খবর পাঠানো হয়, আর্নেস্টের যৌন আগ্রহটা ফিরে এসেছে, সুতরাং তিনি যাতে একটা দাম্পত্য মিলনের ব্যবস্থা করেন। মেরি লেখেন, সেই মিলনটা দুজনের কারও জন্যই সন্তোষজনক ছিল না। কয়েক দিন পর মেরিকে আবার খবর দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে। চিকিৎসকের অফিসে গিয়ে অবাক হয়ে যান মেরি, দেখেন, আর্নেস্টের গায়ে হাসপাতালের পোশাকের বদলে বাইরে যাওয়ার কাপড়, মুখে ‘চেশায়ার বিড়ালের মতো’ হাসি। হেমিংওয়ে যে সুস্থ হয়ে যাওয়ার ভান করেছিলেন, সেটা মেরি বুঝতে পারেন পরে। অবশ্য তাঁর মনোচিকিৎসকের আশা ছিল, যেহেতু নিজের লেখালেখির কাজে ফিরে যেতে চাইছেন আর্নেস্ট, এটা ভালো লক্ষণ। নিয়ম করে টেবিলেও বসছিলেন তিনি, কিন্তু কাগজ সামনে নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করলেও আসলে কিছুই লিখতে পারেননি তিনি।

আত্মহত্যার মাস দুয়েক আগে তাঁকে যখন একটা ছোট বিমানে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন বিমান আকাশে ওড়ার অল্প কিছুক্ষণ পর বিমানের দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেন হেমিংওয়ে। তাঁর ভ্রমণসঙ্গীরা অবশ্য নিরস্ত করতে পেরেছিলেন তাঁকে। পথিমধ্যে জ্বালানি নেওয়ার জন্য একটা এয়ারপোর্টে যাত্রাবিরতি করে বিমানটি। সেখানে নেমে হ্যাঙ্গারের যন্ত্রপাতি, পার্ক করা গাড়িগুলোর মধ্যে বন্দুক খুঁজতে থাকেন পাগলের মতো। বলা বাহুল্য, কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি খুঁজে পাননি তিনি, পাওয়ার কথাও নয়। এ সময় রানওয়েতে নেমে আসে একটা বিমান, সেই প্লেনের ঘূর্ণায়মান প্রপেলারের দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টাও করেন আর্নেস্ট। পাইলট ইঞ্জিন থামিয়ে না দিলে হয়তো আত্মহত্যাপ্রবণ এই লেখক সফল হতে পারতেন সে যাত্রায়।

আত্মঘাতী হওয়ার এসব অসফল প্রচেষ্টার পর নির্বিঘ্নে মায়ো হাসপাতালে পৌঁছানো হয় তাঁকে, ভর্তি করানো হয় তালাবদ্ধ সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ডে। চিকিৎসকেরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পান একধরনের ক্ষুব্ধ বিষাদ, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, নিজের সম্পর্কে নীচ ধারণা এবং চরম অপরাধবোধের উপসর্গ। এ সময় তাঁকে একাধিক শক থেরাপি দেওয়া হয় আবার। কয়েক দফা থেরাপির পর তিনি মেরিকে লেখেন, আগের চেয়ে ভালো বোধ করছেন এখন, তবে রাত আর দিনগুলোকে মনে হয় অনেক দীর্ঘ। এলোমেলো হাতের লেখায় নিজের একাধিক উদ্বেগের কথা জানান তিনি, লেখেন মেরিকে ছাড়া নিসঃঙ্গতার কথাও। সপ্তাহখানেক পর আরেক চিঠিতে লেখেন যে তাঁদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত তিনি। নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর কথাও করতে পারছেন না। কয়েক দফা থেরাপির পর এক চিঠিতে লেখেন, তাঁর মাথার মধ্যে এমন গুঞ্জন হচ্ছে যে চিঠিটাও ঠিকভাবে লিখতে পারছেন না।

একসময় মায়ো হাসপাতালের মনোচিকিৎসা বিভাগের প্রধানের মনে হয়, রোগীর অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, তাই আপাতত আর হাসপাতালে আটকে রাখার দরকার হবে না তাঁকে। শক থেরাপির কার্যকারিতা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মতামত পাওয়া গেছে বিভিন্নজনের লেখায়। এই চিকিৎসাপদ্ধতির একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে স্মৃতিভ্রংশ, যা সাময়িক হলেও হতে পারে। আর্নেস্টের চিকিৎসক ধরেই নিয়েছিলেন যে এই থেরাপি যথেষ্ট কার্যকর। পরে বোঝা গেছে, সুরাসক্ত রোগীর বেলায় এই চিকিৎসা ঠিকভাবে কাজ করে না। কিছু চিকিৎসাবিজ্ঞানীর মতে, হেমিংওয়ে যদি আগে থেকেই স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগে থাকেন, তাহলে শক থেরাপির ফলে সেই উপসর্গের আরও অবনতি ঘটেছিল।

মায়ো ক্লিনিক থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এক বন্ধু প্রায় আড়াই হাজার মাইল গাড়ি চালিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন আর্নেস্টকে। সেই দীর্ঘ যাত্রায়ও নানা মানসিক বৈকল্যের প্রমাণ পাওয়া যায় আর্নেস্টের। তাঁর প্রথম উদ্বেগ ছিল, গাড়িতে তাঁরা যে পরিমাণ মদ বহন করছেন, তার কারণে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারে। এ ছাড়া উদ্বিগ্ন ছিলেন, বিকেলের মধ্যে রাত কাটানোর জন্য যদি কোনো মোটেলে ঢুকে না পড়েন, তাহলে রাত হলে কোথাও কোনো ঘর খালি পাওয়া যাবে না।

১৯৬১ সালের এপ্রিলে আরেক দফা আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর একটা আতঙ্ক ভর করেছিল মেরির মধ্যে। স্বামীর সব বন্দুক তলকুঠুরিতে নামিয়ে রাখলেও চাবিটা লুকিয়ে রাখেননি, রেখে দিয়েছিলেন অন্য সব চাবির সঙ্গে। পরবর্তী সময় এটা নিয়ে মেরির অনুতাপের অন্ত ছিল না।

আর্নেস্টের জীবনের শেষ রাতে মেরি যখন তাঁর নিজের ঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন শোনা যাচ্ছিল, অন্য ঘর থেকে হেমিংওয়ে খোলা গলায় গাইছেন ইতালীয় একটা লোকগীতি। তারপর স্ত্রীকে ‘শুভরাত্রি, আমার বিল্লিছানা’ বলে শুতে চলে গিয়েছিলেন আর্নেস্ট। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর কিছু একটা শব্দ শুনে উৎকর্ণ হয়ে আর্নেস্টের নাম ধরে ডাক দেন মেরি। জবাব না পেয়ে স্বামীর শোবার ঘরে গিয়ে বিছানা দেখে বুঝতে পারেন, রাতে ঘুমিয়েছেন তিনি। এবার বাড়ির মূল দরজার সামনে গিয়ে দেখেন, পড়ে আছে রক্তে মাখামাখি একটা শরীর, পরনে নীল পাজামা, গায়ে বহু বছর আগে ইতালিতে মেরির সেলাই করা লাল রঙের গাউন, বন্দুকটা পড়ে আছে দুই পায়ের মাঝে। ঘরের দেয়াল ও ছাদে ছড়িয়ে আছে মাংসের কণা।

হেমিংয়ের মৃত্যু-পরবর্তী ষাট বছর ধরে বহু গবেষণা হয়েছে তাঁর মানসিক রোগ, মৃত্যু ও চিকিৎসা বিষয়ে। মায়ো হাসপাতালের মেডিকেল রেকর্ড প্রকাশ না করার কঠোর নীতিমালা সত্ত্বেও গবেষকেরা বিভিন্ন মেডিকেল জার্নাল এবং অন্যান্য মাধ্যমে তাঁদের ধারণার কথা জানাতে কসুর করেননি। তাঁদের একদলের মত, রক্তে লোহিতকণিকার আধিক্য ও অপরিমিত মদ্যপান এই লেখকের বিষাদরোগ ও আত্মহত্যার একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। একই কারণে হেমিংওয়ে পরিবারে ঘটেছে একাধিক আত্মহত্যা। আরেক দলের ধারণা, তাঁর পরিবারের প্রায় সবারই বাইপোলার, অর্থাৎ মেজাজের চরম ওঠানামার রোগ ছিল। এসব ধারণার কোনোটিই খুব বেশি হালে পানি পায়নি।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, আর্নেস্ট ছাড়াও হেমিংওয়ে পরিবারে প্রথম আত্মহত্যা করেন তাঁর বাবা ক্ল্যারেন্স হেমিংওয়ে। তাঁর ছিল বিষাদরোগ আর উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস। ঠিক একই রোগে ভুগছিলেন আর্নেস্টের ছোট ভাই লেস্টার হেমিংওয়ে। তিনিও বাবার পথ ধরে পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছিলেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন ছোট বোন উরসুলা। তাঁরও ছিল বিষাদরোগ। নাতনি মারগো ছিলেন ৭০ দশকের নামকরা ফ্যাশন মডেল। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাঁকে। ধারণা করা হয়, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারা যান তিনি। এটা আত্মহত্যা হলেও তাঁর পরিবারের দ্বিমত ছিল এ বিষয়ে। হেমিংওয়ে পরিবারের সর্বশেষ (২০০১ সালে) অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে আর্নেস্টের তৃতীয় সন্তান গ্রেগরির বেলায়। অবশ্য তখন তিনি আর গ্রেগরি ছিলেন না, চারবার দারপরিগ্রহের পর লিঙ্গান্তরের মাধ্যমে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন গ্লোরিয়া। হৃদ্‌রোগে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে হাইওয়ের মাঝের আইল্যান্ড ধরে প্রায় নগ্নাবস্থায় হেঁটে যাওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। লিঙ্গান্তরিত বলে তাঁর ঠাঁই হয়েছিল জেনানা ফাটকে। বলা বাহুল্য, গ্রেগরি ওরফে গ্লোরিয়ারও ছিল বাইপোলার রোগ। হেমিংওয়ের স্বজনদের মধ্যে আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা আছে, যদিও সেটি হেমিংওয়ের বংশধারার বাইরে। তাঁর প্রথম শ্বশুর, অর্থাৎ হ্যাডলি রিচার্ডসনের বাবাও বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেছিলেন তাঁদের বিয়ের ১৮ বছর আগে। হেমিংওয়ে পরিবারের সদস্যদের মতো কোনো মানসিক বৈকল্য ছিল না তাঁর। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন গমের বাজারে ফাটকাবাজারি বিনিয়োগে লোকসানের কারণে।

এ প্রসঙ্গে আর্নেস্টের নাতনি (প্রথম সন্তান জ্যাকের মেয়ে) অভিনেত্রী ম্যারিয়েল হেমিংওয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। সুপারমডেল বোন মারগো যখন আত্মহত্যা করেন, তখন ম্যারিয়েলের এই বোধোদয় ঘটে যে একটা বংশের সাতজন মানুষ আত্মহত্যা করার পর বিষয়টি আর হালকা করে দেখার উপায় থাকে না। এটাকে লুকিয়ে না রেখে বরং সত্যের মুখোমুখি হওয়া উচিত। অথচ তাঁর বাবা জ্যাক মারগোর আত্মহত্যার বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে এমন ভাব করেছিলেন যে আত্মহত্যা ছিল না ওটা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার একটা দুর্ঘটনামাত্র। তাই দীর্ঘ শিরোনামে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথা আউট কেইম দ্য সান: ওভারকামিং দ্য লিগ্যাসি অব মেন্টাল ইলনেস, অ্যাডিকশন অ্যান্ড সুইসাইড ইন মাই ফ্যামিলি (২০১৫) বইতে নিজ পরিবারের সাতটি আত্মহত্যার অন্ধকার দিকটি তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর মতে, সত্যপ্রকাশের এই প্রয়াস হয়তো তাঁদের মতো অন্য পরিবারগুলো সাহায্য করতে পারে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ষা করতে পারে অমূল্য জীবনও। তাই সবারই উচিত মানসিক অসুস্থতা নিয়ে আরও বেশি করে কথা বলা। কোনো পরিবারে এমন প্রবণতা থাকলে তাতে তো দোষের কিছু নেই, তাই কারও দ্বিধা বা লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে নিজের মতের পক্ষে হেমিংওয়ে পরিবার নিয়ে একটা প্রামাণ্য ছবিও তৈরি করেছিলেন ম্যারিয়েল।

হেমিংওয়ের মৃত্যুর ৫৬ বছর পর প্রকাশিত হেমিংওয়েজ ব্রেন (২০১৭) বইতে মনোবিজ্ঞানী অ্যানড্রু ফারাহ প্রথমবারের মতো ভিন্নতর এবং মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বহুল আলোচিত আত্মহত্যা বিষয়ে। তাঁর সন্দেহ, দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমাগত আঘাতজনিত এনসেফালোপ্যাথি রোগে ভুগছিলেন আর্নেস্ট। এই রোগে মস্তিষ্ক অকার্যকর হয়ে পড়ে তাঁর। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্মৃতিভ্রংশের প্রাথমিক পর্যায়। এ কথা ঠিক, স্কুলজীবনে ফুটবল খেলার সময় থেকে শুরু করে সারা জীবনে প্রায় গোটা দশেক তীব্র আঘাত সহ্য করেছে হেমিংওয়ের মস্তিষ্ক। এগুলোর মধ্যে মারাত্মক ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে খুব কাছাকাছি মর্টারের গোলা বিস্ফোরণ, বিভিন্ন সময়ে বক্সিং খেলা, গাড়ি দুর্ঘটনা, আফ্রিকায় এক দিনের ব্যবধানে দুবার বিমান দুর্ঘটনা। ফারাহর মতে, বিভিন্ন সময়ে পাওয়া এসব আঘাত ছিল মারাত্মক এবং মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। মুষ্টিযুদ্ধ, বুল ফাইটিংসহ নানা ধরনের দুঃসাহসিক কাজ এবং দুরারোগ্য সুরাসক্তি এই আঘাতজনিত ক্ষতের অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়। দীর্ঘ মেয়াদে এসব তীব্র আঘাত মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে বয়স ৫০ পেরোবার সময়েই সংশোধনাতীতভাবে বদলে গিয়েছিল তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো। মস্তিষ্কের এই অকাল নিষ্ক্রিয়তা বদলে দিয়েছিল তাঁর মানসিক গঠন।

আগের গতানুগতিক ধারণার বাইরে গিয়ে কেবল আর্নেস্টের মানসগঠন কিংবা পারিবারিক পরম্পরা নিয়ে মাথা ঘামাননি ফারাহ। তিনি নির্ভর করেছেন আর্নেস্টের বিষয়ে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের স্মৃতিকথার ওপর, ঘেঁটে দেখেছেন বিভিন্নজনের কাছে লেখা হেমিংওয়ের বিশাল পত্রসম্ভার, এমনকি পর্যালোচনা করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কিউবায় থাকাকালীন হেমিংওয়ের ওপর খোলা এফবিআইয়ের বিশেষ নথি। অ্যানড্রুর গবেষণালব্ধ এই আবিষ্কারের আগে প্রায় সব জীবনীকার একটা ধারণায় সীমাবদ্ধ ছিলেন যে আর্নেস্টের আত্মহননের পেছনের মূল কারণ বাইপোলার উপসর্গ এবং দুরারোগ্য মাদকাসক্তি। ফারাহর বক্তব্য, এ রকম স্বতঃসিদ্ধের কারণে বহুল আলোচিত এই আত্মহত্যার মূল সূত্রগুলো আড়াল হয়ে গিয়েছিল। ফলে বিবেচনা করা যায়নি, শক থেরাপির মতো একটা প্রায় অব্যর্থ চিকিৎসার পরও কেন আর্নেস্টের অবস্থার অবনতি ঘটেছিল।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মেরির প্রতি আর্নেস্টের মারমুখী আচরণ এবং লিখতে না পারার বিষয়টাকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন অ্যানড্রু। হেমিংওয়ের সঙ্গে মেরির দাম্পত্য জীবনের পুরোটাই যে খুব সুখের ছিল, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। স্বামীর মাতাল অবস্থায় বিভিন্নভাবে অপমানজনক আচরণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে মেরির সঙ্গে করেছেন নানা অপমানজনক আচরণ। স্ত্রীকে কখনো সেনাশিবিরের মনোরঞ্জনকারী নারী (ক্যাম্প ফলোয়ার), কখনো মড়াখেকো, কখনো দুষ্ট ও নিপীড়ক স্প্যানিশ যাজক ‘তোরকে মাদা’র মতো বলে মানসিক নিপীড়ন করেছেন হেমিংওয়ে। আফ্রিকায় ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর অন্য রোগের উপসর্গগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, স্মৃতিভ্রংশ, মাদকাসক্তি, মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অসংযত মেজাজ এবং অনিয়ন্ত্রিত বিষাদরোগ। স্বামীকে ভালো মেজাজে রাখার জন্য এমনকি কম বয়সী তরুণীদের প্রতি তাঁর দুর্বলতা কিংবা আসক্তি—এসবও না দেখার ভান করে থাকতেন মেরি। তারপরও স্ত্রীর প্রতি অসহিষ্ণুতা বেড়ে গিয়েছিল হেমিংওয়ের। খুব জাঁকজমক করে হেমিংওয়ের ৬০তম জন্মদিন পালনের জন্যও টাকাপয়সার অপচয়ের অজুহাতে মেরিকে দুষেছেন হেমিংওয়ে। জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো নিয়ে হেমিংওয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন মেরির ওপর। এমনকি অনুযোগ করেছেন, শক থেরাপির পরিকল্পনাটাও মেরির।

লিখতে না পারার যন্ত্রণাও যে আর্নেস্টকে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ করছিল, অ্যানড্রুর এই পর্যবেক্ষণের প্রমাণ মেলে বন্ধু ও জীবনীকার অ্যারন হচনারের বয়ানে। নিজের লিখতে না পারা প্রসঙ্গে হেমিংওয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘৬২ বছর বয়স হতে চলেছে এমন একজন মানুষ যখন বুঝতে পারে, নিজের কাছে প্রতিশ্রুত বই আর গল্পগুলো সে আর কখনোই লিখতে পারবে না, তার কী অবস্থা হয় বলে মনে হয় তোমার?’ হেমিংওয়ে যখন প্যারিস স্মৃতি নিয়ে কাজ করছিলেন, তত দিনে তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে, দিনের পর দিন বসে থেকেছেন অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে, কিন্তু কিছুই লিখতে পারছিলেন না। এই অক্ষমতা স্বীকার করে হচনারকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি লিখতে পারি, এই বোধ যত দিন আমার ভেতরে থাকবে, তত দিন আমি এক দিন, এক বছর, এমনকি ১০ বছর না লিখলেও কিছু আসে–যায় না। কিন্তু সেই বোধ ছাড়া কিংবা সেটা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা নিয়ে এক দিন থাকাকেও মনে হবে অনন্তকাল।’

এসব বিভিন্ন বিবেচনায় অ্যানড্রু তাঁর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছিলেন যে চিকিৎসাপদ্ধতির কোনো অব্যবস্থার জন্য মৃত্যু ঘটেনি আর্নেস্টের, বরং ষাটের দশকের সর্বাধুনিক মনোরোগের চিকিৎসাই দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তবে সেটা দেওয়া হয়েছিল রোগনির্ণয়ের ভুল সিদ্ধান্তে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ছ ল ন আর ন স ট পর ব র র স আর ন স ট র চ ক ৎসক র ব ষ দর গ কর ছ ল ন দ র ঘটন র ব ষয়ট অবস থ র উপসর গ প রক শ জ বন র হয় ছ ল র পর ব বন দ ক র জন য ক জ কর কর ছ ন র ভ তর র একট র ওপর এ সময় প রথম আতঙ ক র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে রূপান্তরিত সাঁতারুর পদক

দ্বিতীয় দফা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর পররাষ্ট্রনীতিতে আরও কড়াকড়ি আরোপের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও কঠোর নীতি চালু করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মধ্যে একটি হলো মেয়েদের খেলায় রূপান্তরিত (ট্রান্সজেন্ডার) ক্রীড়াবিদদের নিষিদ্ধ করা।

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের খড়্গ নেমে এসেছে লিয়া টমাসের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের এই রূপান্তরিত সাঁতারুর ব্যক্তিগত অর্জন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁর রেকর্ড মুছে ফেলার পাশাপাশি শিগগিরই পদক কেড়ে নেওয়া হবে।

রূপান্তরিত সাঁতারু লিয়া টমাসের পদক কেড়ে নেওয়া হবে

সম্পর্কিত নিবন্ধ