যখন পর্দায় একেকটি দৃশ্য বদলে যায় নিখুঁতভাবে, যখন দর্শকের হৃদয় কাঁপে কোনো সংলাপের টানটান আবেগে, তখন খুব কম মানুষই খেয়াল করে, এসবের পেছনে একজন মানুষ আছেন– যিনি নিজ হাতে গড়েন গল্পের ছন্দ। এখন ঢাকার পোস্ট-প্রোডাকশন জগতে এক পরিচিত নাম জোবায়ের আবির পিয়াল। বগুড়ার এ তরুণের পথচলাটা ছিল যেমন পরিশ্রমে ভরা, তেমনি প্রেরণায়।
তাঁর ভিডিও এডিটিংয়ের শুরুটা ছিল কৌতূহল থেকে। ছোটবেলায় সিনেমা দেখার সময় তাঁর মাথায় ঘুরত ‘এই দৃশ্যগুলো বানানো হয় কীভাবে?’ আলোর খেলা, শব্দের ছন্দ আর সময়ের নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় কীভাবে তৈরি হয়? সেই আগ্রহই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় ভিডিও এডিটিংয়ের এক নতুন জগতে। প্রথমে একটি সাধারণ ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে হাতেখড়ি। এরপর তাঁর সামনে খুলে যায় ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে নতুন নতুন সব দরজা। প্রতিটি কাট, প্রতিটি ট্রানজিশন যেন হয়ে উঠল গল্প বলার নিজস্ব এক টুল। প্রতিদিন এডিটিং টেবিলে তিনি শুরু করেন এক নিঃসঙ্গ অথচ রোমাঞ্চকর যাত্রা। পিয়াল বললেন, ‘শুরুর দিকে কিছুই জানতাম না। তখন শুধু জানতে চেয়েছি দৃশ্যগুলো কীভাবে তৈরি হয়। যখন কাটা শুরু করলাম তখনই খুঁজে পেলাম নিজের ভাষা। প্রতিটি কাটই তখন মনে হতো একেকটা শব্দ, যা দিয়ে আমি একটি গল্প বলতে পারি।’ এই কৌতূহলই তাঁকে টেনে নিয়ে আসে ঢাকায়। পোস্ট-প্রোডাকশন হাউসে সহকারী সম্পাদক হিসেবে শুরু হয় পিয়ালের জীবন। সেখানেই পান ভিডিও এডিটিংয়ের প্রথম গুরু ইকবাল কবির জুয়েলকে। পিয়াল বলেন, ‘জুয়েল ভাই শুধু বস ছিলেন না, ছিলেন আমার শিক্ষক। তাঁর হাত ধরেই বুঝতে শিখি, এডিটিং মানে শুধু দৃশ্য সাজানো নয়, গল্পের ভেতরের আবেগ বের করে আনা।’
এরপর এক দশকেরও বেশি সময়ের যাত্রা। বর্তমানে পিয়াল কাজ করছেন আলফাআই লিমিটেড-এ চিফ ভিডিও এডিটর হিসেবে। তাঁর প্রতিটি কাজেই যেন থাকে এক ধরনের ভিজ্যুয়াল সংবেদনশীলতা। শাহরিয়ার শাকিলের নেতৃত্বে কাজ করতে গিয়ে পেয়েছেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
পিয়াল বলেন, ‘শাকিল ভাই সবসময় বলেন, একজন সম্পাদক যদি নির্মাণের সব স্তরে থাকতে পারে, তাহলে সে কেবল কাজ করে না, নির্মাণের আত্মাকেও ধরতে পারে।’ এই কথাটা আমি হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি।
পিয়ালের কাজের পরিসর বিশাল। ওয়েব সিরিজ মহানগর, সিন্ডিকেট, আগস্ট ১৪, জিম্মি, কথোপকথন– এসব জনপ্রিয় প্রজেক্টের পেছনে তাঁর নিখুঁত কাট, আবেগ তৈরি করা টাইমিং, আর গল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। পিয়াল বলেন, ‘আমি প্রতিবার ভাবি– এই গল্পটা যদি আমার হতো, আমি কীভাবে বলতাম? সেই ভাবনা থেকেই আমি কাজ শুরু করি।’
ফিচার ফিল্ম দাগি-তে প্রধান এডিটর, সুড়ঙ্গ-এ পোস্ট-প্রোডাকশন সুপারভাইজার, তুফান ও তাণ্ডব-এ সহ-সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন পিয়াল। একক নাটকের সংখ্যাও তিনশর বেশি। তবে শুধু এডিটর হিসেবে নয়, তিনি কাজ করেছেন নন-ফিকশন প্রজেক্টেও। এক ডিশ দুই কুক, হলিডে প্ল্যানার, দ্য বক্স এসব কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সহযোগী পরিচালকও। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছে নির্মাণের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট বোঝার সুযোগ। আর ভিএফএক্স? সেটিও তাঁর আরেক দক্ষতার ক্ষেত্র।
‘সিন্ডিকেট’, ‘আগস্ট ১৪’, ‘মাইসেলফ অ্যালেন স্বপন’, ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ এগুলোতে ভিএফএক্স ডিজাইন ও এক্সিকিউশনের কাজেও রেখেছেন নিজের ছাপ। পিয়ালের ভাষায়, ‘ভিএফএক্স যদি ঠিকভাবে ব্যবহার না হয়, তাহলে সেটি গল্পের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি চাকচিক্য হয়ে দাঁড়ায়। যখন গল্পের ছন্দে থাকে, তখন সেটি জাদুর মতো কাজ করে।’
পিয়াল তাঁর এই দীর্ঘ যাত্রায় পাশে পেয়েছেন দেশের বহু খ্যাতিমান নির্মাতা– শিহাব শাহীন, আসফাক নিপুণ, কাজল আরেফিন অমি, মিজানুর রহমান আরিয়ান, ভিকি জাহেদ, সুমন আনোয়ারকে– যাদের সান্নিধ্য তাঁকে করেছে আরও পরিপক্ব, আরও গভীর দর্শনসম্পন্ন। পিয়ালের কাজগুলো দেখে বলা যায় পর্দার আড়ালে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছেন হাজারো গল্পের নেপথ্য নায়ক।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন টক ভ ড ও এড ট গল প র ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
বিপ্লবের এক বছর পর আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে
এক বছরের সামান্য কিছু আগের কথা। বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম দমন অভিযান চালান, তখন রংপুর শহরে সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন আবু সাঈদ। তাঁর দুই হাত ছিল প্রসারিত।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হন। পরিবার জানায়, আহত হয়ে পরে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন সেই গণ–অভ্যুত্থানের একজন শহীদ; যেখানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। শেষ পর্যন্ত ওই আন্দোলনেই শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
শেখ হাসিনা পরে পালিয়ে ভারতে চলে যান। দেশকে নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে রেখে তিনি পালিয়েছেন; কিন্তু তখনো দেশে ছিল আশার আলো।
শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশকে আরও ন্যায়সংগত ও কম দুর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে বসাতে সহায়তা করেন। এ সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল দেশকে বিশৃঙ্খলা থেকে স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যাওয়া।
কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ধীরগতিতে অনেক বাংলাদেশি হতাশ। তাঁরা ভাবছেন, তবে কি আবু সাঈদের মতো বিক্ষোভকারীরা বৃথাই নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, চাকরির স্বল্পতা ও প্রবলভাবে জেঁকে বসা প্রশাসনের মতো পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো দূর করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনরোষ আংশিক বাড়িয়ে দিয়েছিল এসব সমস্যা।
গণতান্ত্রিক সংস্কারকাজ দ্রুত কার্যকর করা—শিক্ষার্থীদের জোর দাবি। তাঁরা চাইছেন, গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের অভিযুক্ত নেতা–কর্মী, পুলিশ সদস্যসহ অন্যদের দ্রুত শাস্তি হোক।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ‘আমাকে কষ্ট দেয়’ উল্লেখ করে আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, দেশ নৈতিকভাবে উন্নত হবে, বৈষম্য শেষ হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, হত্যাকারীরা শাস্তি পাবেন এবং সেই শাস্তি অপরাধীদের আতঙ্কিত করবে; কিন্তু এ রকম কিছুই ঘটেনি।’
রমজান আলী আরও বললেন, মুহাম্মদ ইউনূস না থাকলে পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপ হতো।
নতুন সূচনা
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের সংস্কারকাজের ভার মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে এসে পড়েছে। এটি এমন এক দেশ; যা (নানা বিষয়ে) এখনো বিভক্ত। সেখানে আবার প্রায় ৫০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম কাজ। গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী লুটপাট, বিশৃঙ্খলা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। তবে দেশ বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, হিন্দু সংখ্যালঘু ও শেখ হাসিনার সমর্থকদের ওপর চালানো সহিংসতা দমনে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি। অন্যদিকে একই সময়ে ‘ইসলামি কট্টরপন্থীরা’ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
বড় পরিসরে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করা ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের পরবর্তী লক্ষ্য। তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশ বাহিনীর মতো ক্ষেত্রগুলোতে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেছিলেন। শেখ হাসিনা যেসব প্রতিষ্ঠানকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করেছিলেন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে চাপ মোকাবিলায় সেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর শক্তিশালী করাই ছিল (সংস্কার কর্মসূচির) প্রধান লক্ষ্য।
৫ আগস্ট হাসিনার পতনের বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষ সমবেত হন। সন্ধ্যার হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ শোনেন। তাঁর কথায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন; কিন্তু এসব উদ্যাপনের আড়ালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাগ-ক্ষোভ লুকিয়ে ছিল। কারণ, ২০২৪-এর জুলাই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি।কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে। এ পরিস্থিতিতে আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন বলেন, ‘এখন সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।’ গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসন্তোষ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে তাঁর পায়েও গুলি লেগেছিল।
‘আমাদের স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রয়ে গেছে’ মন্তব্য করে আবদুল্লাহ বলেন, ছাত্রনেতারা যে তাগিদ নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনাগুলো শুরু করেছিলেন, তা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে।
গত সপ্তাহে মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংস্কার করা একটি ভোটব্যবস্থার আওতায় দেশে নির্বাচন হবে; কিন্তু এর আগেই বিস্তারিত অনেক বিষয়ের সমাধান বাকি; যা রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের কারণে সুরাহা করা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তাঁর সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ‘সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত’ দেশ পেয়েছে। তবে দেশ সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠছে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূসের দায়িত্ব পালনের অর্ধেকের বেশি সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ নিয়ে আলাপ–আলোচনায় কেটে গেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ অস্তিত্ব সংকটে পড়ার পর দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গুরুত্বের সঙ্গে বলে আসছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজের বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য সংস্কারের ভার নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল প্রথমে আরও বিস্তৃত পরিসরে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের অবস্থানকে সমর্থন করেছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়। আমরা ভেবেছিলাম, দেশ নৈতিকভাবে উন্নত হবে, বৈষম্য শেষ হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, হত্যাকারীরা শাস্তি পাবেন এবং সেই শাস্তি অপরাধীদের আতঙ্কিত করবে; কিন্তু এ রকম কিছুই ঘটেনিরমজান আলী, আবু সাঈদের বড় ভাইজাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল দুই মাস ধরে সংবিধান ও শাসনব্যবস্থা–সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছে।
অগ্রগতির আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, ‘কোনো ধরনের তিক্ত বিবাদ ছাড়াই’ তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ও একজন ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, সেই সীমা নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রাজনৈতিক বিভাজন
সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের নেতাদের নির্বাচিত করতে পারাটা প্রায় ১৭ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ প্রধানত দুটি রাজনৈতিক পরিবার দিয়ে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান (শেখ হাসিনার বাবা) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা শুরু করেন (স্বাধীন হওয়ার পর)।
স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তা ও পরে রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছিলেন। বর্তমানে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লন্ডনে বসবাসরত তাঁর ছেলে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার আগ পর্যন্ত দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নিয়মিতভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। জালিয়াতির ভোট আখ্যা দিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এদিকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ দেখা না যেতে পারে। কারণ, দেশে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দলগুলো গ্রাম ও মফস্সল এলাকায় জনসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। গণ–অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার থেকে পদত্যাগ করে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) হাল ধরেন। সমর্থন জোগাড় করতে গত জুলাইতে দলটির নেতারা বিভিন্ন জেলায় ‘দেশ গড়ার’ পদযাত্রা করেন।
তরুণ ভোটাররা সব দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যবর্তী বয়স প্রায় ২৬ বছর (অর্থাৎ দেশের অর্ধেক মানুষ ২৬ বছরের কম বয়সী, বাকি অর্ধেক ২৬ বছরের বেশি বয়সী। এককথায়, জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ)। দেশের অনেক তরুণ শুধু হাসিনার শাসনামল দেখেই বেড়ে উঠেছেন।
গত বছরের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ খান সাগর। তিনি বলেন, ‘প্রজন্ম হিসেবে আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে ভালো কোনো বোঝাপড়া নেই। কারণ, আমরা এটি দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাই নাগরিকেরা যাতে কোনো ধরনের ভয় ছাড়াই শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারেন, তা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করা উচিত।’
ঢাকার বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপের সঙ্গে কাজ করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক থাহিতুন মরিয়ম। তাঁর আশঙ্কা, অন্য দশটির মতো আরেকটি সাধারণ সমস্যাও অমীমাংসিত রয়ে যেতে পারে। তা হলো এ দেশের প্রথাগত (রক্ষণশীল) সমাজে নারীর প্রান্তিকীকরণের সমস্যার হয়তো সমাধান হবে না। তিনি আরও বলেন, বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন না এলে শুধু নির্বাচন ও সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত বদল আসবে না; বরং এগুলো আবারও ‘পুরুষকেন্দ্রিক, পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক বাস্তবতা’ তৈরি করবে।
গণতান্ত্রিক সংস্কারকাজ দ্রুত কার্যকর করা শিক্ষার্থীদের জোর দাবি। তাঁরা চাইছেন, গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের অভিযুক্ত নেতা-কর্মী, পুলিশ সদস্যসহ অন্যদের দ্রুত শাস্তি হোক।২০২৪ সালের বিক্ষোভে বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষার্থীকে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল; কিন্তু তাঁরা এখন প্রকাশ্য ভূমিকা থেকে নিজেদের সরিয়ে ফেলেছেন। তবে মরিয়ম বলেন, তিনি এখনো আশা করেন, বাংলাদেশের নতুন গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে প্রমাণিত হবে।
মিশ্র অনুভূতি
৫ আগস্ট হাসিনার পতনের বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হাজারো মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। সন্ধ্যার হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ শুনেছেন।
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গত বছরের গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা জাতীয় বীর হিসেবে গণ্য হবেন এবং ‘শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আইনি সুরক্ষা’ দেবে সরকার। তাঁর এ কথায় উপস্থিত দর্শক–শ্রোতারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
কিন্তু এসব উদ্যাপনের আড়ালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাগ–ক্ষোভ লুকিয়ে ছিল। কারণ, ২০২৪–এর জুলাই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি।
আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী জানান, তাঁর ভাইকে গুলি করার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন; কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনাই এ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রমজান আলী বলেন, ‘আবু সাঈদ এ অভ্যুত্থানের একজন সুপরিচিত শহীদ।’ তিনি আরও বলেন, যদি তাঁর মামলাই যথাযথভাবে পরিচালনা করা না হয়, তবে বাংলাদেশ কি কখনো কোনো সুবিচার পাবে?
হত্যাকাণ্ডে নিজ ভূমিকার জন্য ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তাঁর অনুপস্থিতিতে মামলা চলছে। গত সপ্তাহে তিনি ভারত থেকে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে ছাত্রদের বিপ্লবকে নিজেদের ‘কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রের জন্য সহিংস বাধা’ হিসেবে তিনি আখ্যায়িত করেন।
এদিকে কিছু অধিকারকর্মী বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, নতুন বাংলাদেশে স্পষ্ট কোনো দিশা নেই।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলী সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার আটকে গেছে। এ সরকারকে একদিকে সংস্কারহীন নিরাপত্তা খাত সামলাতে হচ্ছে। ‘‘সহিংস ধর্মীয় গোষ্ঠী’’ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কখনো কখনো বাংলাদেশের অধিকার রক্ষার চেয়ে হাসিনার সমর্থকদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে।’
বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক দৈনন্দিন জীবনের বড় রকমের সমস্যাতেও রয়েছেন। কারণ, অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় গত বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালে তা ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
আবদুল কাদের (৩৭) বললেন, ঢাকা শহরে তাঁর এয়ার কন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর মেরামতের দোকানের আয় গণ–অভ্যুত্থানের পর ১০ শতাংশ কমেছে। তিনি বলেন, অস্থিরতার কারণে গ্রাহকেরা সতর্ক হয়ে পড়েছেন। তবে তিনি আশা করেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে কিছুটা স্বস্তি তৈরি হতে পারে।
আবদুল কাদের আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছে মানুষের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই কিংবা যাঁর কাছে আছে, তিনি খরচ করতে চাইছেন না।’