নারী নেতৃত্ব কেবল ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, এটি দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুরক্ষা ও গণতন্ত্র উন্নয়নের প্রমাণিত উপায়। ইউএনডিপির হিসাব বলছে, যেসব দেশে সংসদে অন্তত ৩০ শতাংশ নারী রয়েছেন, সেখানে মা ও শিশুর মৃত্যুহার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। সুইডেনে নারী সংসদ সদস্য ৪৫ শতাংশ হওয়ার পর নারীবান্ধব নীতি দ্বিগুণ হয়েছে এবং কর্মক্ষেত্রে ও পরিবারে লিঙ্গবৈষম্য কমেছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সমান হলে জিডিপি প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত বাড়তে পারে।

নীতি নির্ধারণে নারী থাকলে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ে। বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সমান হলে জিডিপি অর্ধেক পর্যন্ত বাড়তে পারে।

বাংলাদেশের সংসদে নীতিনির্ধারণে নারীরা অংশ নিতে পারেন দুইভাবে—সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়ে বা ৫০টি সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে। তবে সাধারণ আসনে নির্বাচিত নারীর সংখ্যা খুবই কম। ২০০১ সালে ৭ জন, ২০০৮ সালে ২০ জন, ২০১৮ সালে ২২ জন (৭.

৩৩ শতাংশ) নির্বাচিত হয়েছেন।

দুই ব্যবস্থা মিলেও সংসদে নারীর অংশগ্রহণ কখনোই ২২ শতাংশ দাঁড়ায়নি, যদিও দেশের জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী। সংরক্ষিত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতায় কার্যকর অংশগ্রহণ হয়নি, মনোনয়নও বাড়েনি, অথচ এত বছরেও এ ব্যবস্থার কোনো সংস্কার হয়নি।

সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থায় নারী সংসদ সদস্যরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় তাঁদের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকা থাকে না। ফলে জনগণের সঙ্গে তাঁদের জবাবদিহিমূলক সম্পর্ক তৈরি হয় না; মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতেও তাঁদের সম্পৃক্ততা কমে যায়। নিজের এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে গেলেও তাঁরা বাধার মুখে পড়েন। কারণ, সাধারণ আসনের সংসদ সদস্য মনে করেন, এটি তাঁর একক দায়িত্ব।

সর্বশেষ যদি রাজনৈতিক দলগুলো ১০০টি আসন সংরক্ষণ এবং সেখানে সরাসরি নির্বাচনে একমত না হয়, তাহলে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। শুরুতে বর্তমান পদ্ধতিতে ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রেখে সাধারণ আসনে ন্যূনতম ৩০টি আসনে নারী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা হবে। এটি আরপিও সংশোধন করে এ বিষয়ে ধারা যুক্ত করতে হবে।

প্রশাসনের সহায়তা মেলে না। দলেও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কেন্দ্র থেকে তাঁদের ‘বিরোধ এড়িয়ে চলার’ নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেক সময় নারী সংসদ সদস্যদের সরকারি অনুষ্ঠান বা মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। প্রকল্প প্রস্তাব দিলেও বলা হয়, ‘এ এলাকা আপনার না।’ সংসদ সদস্য হয়েও তাঁদের বাস্তব কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ সীমিত।

সংরক্ষিত আসনের মনোনয়ন সরাসরি দল থেকে আসে, যেখানে যোগ্যতা নয়, ঘনিষ্ঠতা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও আর্থিক লেনদেন প্রাধান্য পায়। অভিজ্ঞ নারী নেত্রীরা উপেক্ষিত হন, বরং ত্যাগী পুরুষ নেতার স্ত্রী বা আত্মীয়রা পুরস্কারস্বরূপ মনোনয়ন পান। এতে নারীদের মধ্যে ‘কাকে খুশি করলে মনোনয়ন মিলবে’ মনোভাব তৈরি হয়।

এতে নারীদের সাধারণ আসনে অংশগ্রহণের আগ্রহ কমে যায়। তাঁদের বলা হয়, ‘তোমাদের জন্য তো সংরক্ষিত আসন আছে।’ এতে সাধারণ আসনে মনোনয়ন কমে যায় এবং দলও যোগ্য নারী খুঁজে পায় না। ফলে সংরক্ষিত আসন কেবল সংখ্যা বাড়ায়, নেতৃত্ব বা ক্ষমতায়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে না।

এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর। সংসদে যদি সদস্যরা জনগণের সমস্যা না তুলতে পারেন, আইন প্রণয়নে অংশ না নেন, তাহলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। সরকার যে বেতন, ভাতা ও সুবিধা দেয়, তা যদি কার্যকর নেতৃত্বে রূপ না নেয়, তবে সেটি একপ্রকার অর্থনৈতিক অপচয় হিসেবেই গণ্য হয়।

প্রশ্ন হতে পারে, বিকল্প কী হতে পারে? আসলে নারীদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনটি ধরনের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে—

১. নির্বাচনের মাধ্যমে সংরক্ষিত আসন

মোট আসনসংখ্যা ৪০০ করে এর মধ্যে ১০০টি (২৫ শতাংশ) আসন নারীর জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এই আসনগুলোতে শুধু নারী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। প্রতি চারটি আসনের একটি সংরক্ষিত থাকবে, এগুলো ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে নির্ধারিত হবে এবং নির্বাচন কমিশন আগেই তা ঘোষণা করবে।

২. সাধারণ আসনে বাধ্যতামূলক নারী মনোনয়ন

বাকি ৩০০ আসনে অন্তত ১০ শতাংশ নারী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ বিষয়ে আরপিও-তে ধারা সংযোজন করে তা আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। এই ধারা লঙ্ঘন করলে দলীয় নিবন্ধন স্থগিত, অর্থদণ্ড বা পাবলিক ফান্ডিং বন্ধের মতো শাস্তির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

৩. নারী প্রার্থীদের জন্য পাবলিক ফান্ডিং

অনেক নারী প্রার্থীর নিজ নামে সম্পদ বা অর্থ না থাকায় নির্বাচনী ব্যয় বহন করা কঠিন হয়। বিআইজিডির গবেষণা বলছে, মাত্র ৪ শতাংশ নারীর নিজের নামে জমি বা সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে। তাই তাঁদের জন্য আলাদা ‘পাবলিক ফান্ডিং’ বরাদ্দ করা যেতে পারে। অনেক দেশ ইতিমধ্যেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।

রুয়ান্ডায় নারী প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত তহবিল ব্যয় বাধ্যতামূলক এবং বেশি নারী জয়ী হলে বাড়তি অর্থ মেলে। নেপালে ‘ইনক্লুশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন প্রশিক্ষণ ও প্রচার ব্যয় সহায়তা করে। সুইডেনে ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি বোনাস’ দেওয়া হয়, যেখানে নারী-পুরুষ সমান মনোনয়নের ভিত্তিতে বাড়তি অনুদান দেওয়া হয়।

ইউএন উইমেন ও ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া বলছে, আর্থিক সহায়তা থাকলে নারীদের জয়ের সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়।

সর্বশেষ যদি রাজনৈতিক দলগুলো ১০০টি আসন সংরক্ষণ এবং সেখানে সরাসরি নির্বাচনে একমত না হয়, তাহলে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। শুরুতে বর্তমান পদ্ধতিতে ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রেখে সাধারণ আসনে ন্যূনতম ৩০টি আসনে নারী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা হবে। এটি আরপিও সংশোধন করে এ বিষয়ে ধারা যুক্ত করতে হবে।

পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে এটি বাড়িয়ে ৬০টি মনোনয়ন এবং সংরক্ষিত আসন ২৫-এ নামিয়ে আনা হবে। পরেরবার ৩৩ শতাংশ নমিনেশন সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের সাধারণ আসনে অংশগ্রহণ বাড়বে এবং সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে কমে যাবে।

এই পুরো প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু সংখ্যা নয়, গুণগত দিক থেকেও টেকসই ও কার্যকর হবে।

লিপিকা বিশ্বাস নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন–বিষয়ক বিশ্লেষক।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক দ র জন য ব যবস থ ক র যকর র র জন গ রহণ আসন র

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি সম্পদ নয়, তিনি বাংলাদেশের সম্পদ : মাসুদুজ্জামান

নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের বিএনপি মনোয়ন প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ বলেছেন,  আজকে আমরা দোয়া চাই দেশনেত্রী গণতন্ত্রের মা এবং খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সংকটাপন্ন তিনি শুধু বিএনপির সম্পদ নন, তিনি গণ মানুষের সম্পদ, বাংলাদেশের সম্পদ।

বাংলাদেশের সকলে তার জন্য দোয়া করছেন। তিনি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।  আপনারা ওয়ান ইলেভেনের কথা সব জানেন কি ধরনের চাপ ছিল তারপরও আমাদেরকে ছেড়ে যাননি বাংলাদেশী জনগণের কাছ থেকে। উদ্দেশ্য একটাই আমাদের পাশে জনগণের পাশে থাকতে চেয়েছেন অনেক ত্যাগ আছে। 

বিএনপি চেয়ারপরসন বেগম খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি ও সুস্থতা কামনায় বিশেষ দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।  রোবার (১ ডিসেম্বর) বিকালে নারায়ণগঞ্জ হোসিয়ারী সমিতি কমিনিটি সেন্টারে মহানগর ছাত্র দলের আয়োজনে এই বিশেষ দোযার আয়োজন করা হয়। 

মাসুদুজ্জামান মাসুদ আরও বলেন, আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করব আপনারা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করবেন। যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের পাশে ফিরে আসতে পারেন সেই অনুরোধ আমার থাকবে এবং পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের জন্য দোয়া করবেন।

তিনি উদগ্রীব হয়ে আছেন মায়ের স্নেহ পাওয়ার জন্য, মায়ের সেবা করার জন্য। আল্লাহ পাক যাতে ওনাকে এই সুযোগটা করে দেন। যত দ্রুত সম্ভব আমরা আশা করি আমাদের নেতা আমাদের কাছে আসবেন। আমাদের পাশে আসবেন। 

এসময় সভায় সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাহিদ ইশতিয়াক শিকদার।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসূফ খান টিপু, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এড. জাকির হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন আনু, ফতেহ মোহাম্মদ রেজা রিপন, মহানগর মহিলাদলের সভাপতি দিলারা মাসুদ ময়না, মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম সজল, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক শাখাওয়াত হোসেন রানা, সদর থানা বিএনপির সভাপতি মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর শওকত হোসেন শকু, তোলারাম কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফারুক খান সুজন, নারায়ণগঞ্জ কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি আলিমুল ইসলাম সিফাত, এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

শেষে দোয়া পরিচালনা করেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর ওলামা দলের আহ্বায়ক হাফেজ মো. শিব্বীর আহম্মেদ।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাঁসের খামারি ম‌নি বেগ‌মের দিনবদলের গল্প
  • ৬৯ শতাংশ মানুষ মনে করে ড. ইউনূস ভালো কাজ করছেন: জরিপ
  • খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি সম্পদ নন, তিনি বাংলাদেশের সম্পদ : মাসুদুজ্জামান
  • খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি সম্পদ নয়, তিনি বাংলাদেশের সম্পদ : মাসুদুজ্জামান
  • ক্ষমতায় না গিয়েও অনেকে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন: জামায়াত আমির
  • দেশে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে: মির্জা ফখরুল
  • নতুন বছরে আয়–ব্যয় ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার ১০ পরামর্শ
  • বারবার মানুষ জীবন দেয় কিন্তু ক্ষমতায় যায় বুর্জোয়ারা: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • লন্ডন থেকে প্রেসক্রিপশন দিয়ে কেউ দেশ চালাতে পারবে না: সাদিক কায়েম
  • যাঁরা লুট করেছেন, তাঁদের ধরেন, কারখানাগুলো চালু থাকুক: ফখরুল