সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক নারীর সঙ্গে জড়িয়ে সামনে এসেছে লামিনে ইয়ামালের নাম। মৌসুম শেষে ফুটবলের বিরতিতে ইয়ামাল প্রথম আলোচনায় আসেন ইনফ্লুয়েন্সার ফাতি ভাসকেজের সঙ্গে অবকাশ কাটাতে গিয়ে। এরপর বার্সেলোনা তারকার নাম জড়ায় প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট নির্মাতা ক্লদিয়া বাভেলের সঙ্গে।

ইয়ামালের জীবনে নারীদের আগমন অবশ্য এটুকুতেই থামেনি। এবার শোনা যাচ্ছে আর্জেন্টাইন সংগীতশিল্পী ও র‍্যাপার নিকি নিকোলের সঙ্গে ইয়ামালের প্রেমের গুঞ্জন। আনুষ্ঠানিকভাবে জানা গেলেও স্প্যানিশ সাংবাদিক হাভি হোয়োস ইয়ামাল-নিকোলের সম্পর্কে জড়ানোর খবর সামনে এনেছেন।

ইয়ামালের বিখ্যাত এবং বিতর্কিত ১৮তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের একজন ছিলেন আর্জেন্টিনার সংগীতশিল্পী নিকোল। তবে সেখানেই থেমে যাননি দুজন। সম্প্রতি একটি নাইট ক্লাবে দুজন আবারও সময় কাটিয়েছেন এবং একে অপরকে চুমুও খেয়েছেন। আর সেই চুমু থেকেই দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠার গুঞ্জন ছড়িয়েছে।

আরও পড়ুনএবার আরেক নারীকে ঘিরে বিতর্কে ইয়ামাল২২ জুন ২০২৫

হোয়োস বলেছেন, ‘শুধু যে তারা চুমু খেয়েছে তা–ই নয়, সেদিন থেকেই তারা একধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আমি কেন বলছি “একধরনের সম্পর্ক”? কারণ, এখনো তারা ঠিক প্রেমিক-প্রেমিকা নন। বিষয়টা এখনো অনেকটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।’

জন্মদিনে নিকোলের সঙ্গে ইয়ামাল.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

শূন্যতার ঠিকানা

ঢাকার এক ব্যস্ত এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকে রুমানা। বয়স ত্রিশের কোঠায়। চাকরি করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাইরে থেকে তাকে দেখে কেউ বলবে না, তার ভেতরে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ, শান্ত আর চুপচাপ মেয়েটির চোখে সব সময় একধরনের আত্মবিশ্বাসের ছায়া—কিন্তু তা কি সত্যিকারের?

রুমানা অনেক ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছে। কেউ তার রূপে মুগ্ধ হয়েছে, কেউ তার ব্যক্তিত্বে। কারও সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, আবার কারও সঙ্গে কাটিয়েছে কেবল কফিশপের কিছু ঘণ্টা। কখনো তার মুখে ভালোবাসার কথা ছিল, কখনো নীরবতায় ছিল আকর্ষণ। কিন্তু সবশেষে, সে কাউকেই সত্যিকার অর্থে আপন মনে করতে পারেনি।

সে বলত, ‘আমি স্বাধীন, আমার জীবন আমি যেমন চাই তেমনই কাটাব।’

তার অফিসের বস, আনোয়ার হোসেন। বয়সে দশ বছরের বড়। তার সঙ্গেও একসময় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। শুরুটা হয়েছিল কাজের প্রয়োজনে, তারপর ধীরে ধীরে রাতের ফোনালাপ, অফিস শেষে লিফটে চাপা হাসি, একদিন এক হোটেল রুমে শেষ হয় সব সংকোচ।

তবে সম্পর্কটা বেশি সময়ের নয়। আনোয়ার একদিন হঠাৎ বদলি হয়ে যায় আরেক শহরে। রুমানা শুধু ফেসবুকে দেখে, সে এখন পরিবারের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। একটা ছবিতে তার স্ত্রীর পাশে তার ছোট ছেলেটার হাসি। রুমানা চুপচাপ ফোনটা রেখে দেয়। জীবন হয়তো এমনই, কাছে আসা হয় দূরে সরার জন্য।

রুমানার একাধিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া হয়তো তার অন্তর্দ্বন্দের প্রতিফলন। তার এই আচরণ ছিল যেন একধরনের নিরাপত্তা ও ভালোবাসার খোঁজ, যা সে নিজের ভেতরে অনুভব করতে পারে না। শৈশবে যে যত্ন ও আবেগের অভাব তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল, তা পূরণ করার জন্য সে বাইরের মানুষের কাছে চলে যেত, যাতে অন্তত সাময়িক শান্তি আর গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি পায়। তার এই বহুমুখী প্রেমের পেছনে আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি, একাকিত্ব এবং অন্তর্জগতের শূন্যতাও লুকিয়ে ছিল, যা সে একধরনের সুখের আবরণের মধ্যে চাপা দিতে চেয়েছিল।

কেউ চলে গেছে, কোনো কোনো সম্পর্ক রুমানা নিজেই ভেঙেছে। শফিক, কলেজজীবনের বন্ধু। হঠাৎ একদিন অফিস-ফেরতা বাসে শফিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারপর কত গল্প, হাসি, ঠিকানা বিনিময়। শফিক এরপর নিয়মিতভাবে রুমানার ছোট্ট ফ্ল্যাটে আসতে থাকে। দুজনে ঘুরতে যায় নেপাল। সে সম্পর্কে ছন্দপতন হয় রুমানার কারণেই। তার আর শফিককে ভালো লাগছিল না। এত ঘনিষ্ঠতা, এত প্রেম...হুট করে তো ভেঙে দিতে পারে না। রুমানা তাই অজুহাত খুঁজতে লাগল। একদিন পেয়েও গেল। শফিককে দেখতে পেল আরেকটি মেয়ের সঙ্গে, নিউমার্কেটে। পাশের মেয়েটি দেখতে বেশ! শফিক মেয়েটিসহ রুমানার একেবারে মুখোমুখি! শফিক বিব্রত। রুমানাও। তাদের কোনো বাক্যালাপ হয় না। এরপর চিরতরেই বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যায়। দুজন দুই পথে চলে যায়।

রুমানা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নাটা ধোঁয়াটে হয়ে গেছে, তবু নিজের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। নির্ভার, অথচ নির্লিপ্ত চোখ। এমন চোখ তাদের, যারা অনেক কিছু দেখে ফেলেছে, কিন্তু কিছুই রাখতে পারেনি।

অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবরটা জানার পর প্রথম যাকে বলেছিল সে, সে ছিল কায়েস। আর কাউকে নয়।

কায়েস চুপ করেছিল কিছুক্ষণ, তারপর ধরা গলায় বলেছিল, ‘চলো বিয়ে করি, এবার সবকিছু গুছিয়ে নিই।’

কথাটা ভালোবাসায় ভরা ছিল। কিন্তু রুমানার ভেতর তখন অন্য কিছু চলছিল।

মনে মনে ভাবছিল, বিয়ে? সংসার? এই শহরের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা? যে জীবন গড়ে তুলতে কতটা যুদ্ধ করেছে সে। নিজের শরীর, ইচ্ছা, মন সবকিছুর ওপর কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে। সে জীবন কি এখন বাচ্চা আর দায়িত্বের ভারে নুয়ে পড়বে?

রুমানা ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘আমি বিয়ে করতে চাই না, কায়েস। আমি মা হতে চাই না।’

কায়েস প্রথমে বুঝতে পারেনি। তারপর তার মুখ বদলে যায়।

‘তুমি তাহলে শুধু এই সম্পর্কটাকে শরীরের জন্য রেখেছিলে? আমি তো ভাবছিলাম, তুমি আমার সঙ্গে একটা ভবিষ্যৎ দেখতে চাও।’

রুমানা চোখ নামিয়ে বলেছিল, ‘ভবিষ্যৎ মানেই কি বিয়ে? একটা বাচ্চা? তুমি কি বুঝতে পারো না, আমি বন্দী হতে চাই না?’

কায়েস আর কিছু বলেনি সেদিন। চলে গিয়েছিল।

পরে রুমানা নিজে সিদ্ধান্ত নেয়, গর্ভপাত করাবে। একা। কাউকে না জানিয়ে।

গর্ভপাতের পর, নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে রুমানা। ঘরটা নিঃশব্দ, কেবল জানালার বাইরে থেকে হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দ আসে।

সে জানে একটা জীবন সে শেষ করে দিয়েছে। নিজের শরীরের ভেতরে তৈরি হওয়া এক চুপচাপ স্বপ্নকে সে মুছে ফেলেছে। তবু কাঁদছে না সে। তাকে কাঁদতে শেখায়নি কেউ। বরং শিখিয়েছে, নিজের জন্য বাঁচতে হয়। নিজের শরীর, নিজের ভবিষ্যৎ, সবকিছুর সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। কিন্তু আজ, কায়েস নেই। তার মুখ, তার হাতের স্পর্শ, তার কথা সব আজ দূরের, অতীতের। কায়েস কোনো চিৎকার করেনি, কোনো রাগ দেখায়নি। শুধু চলে গেছে। চুপচাপ, কষ্ট নিয়ে। রুমানা জানে, কায়েস ওকে ভালোবাসত। সত্যিই ভালোবাসত। তবু রুমানা তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে বিশ্বাস করে, ভালোবাসা মানে আত্মত্যাগ নয়, আত্মপরিচয়ের অস্বীকৃতিও নয়।

মাঝেমধ্যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় রুমানার। ঘুমের মধ্যে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পায়। ঘরজুড়ে সেই কান্না বাজে তার বুকের ভেতরে, তার সিদ্ধান্তের পাশে। সে জানে, এটা বাস্তব নয়। এটা তার মানসিক ছায়া। কখনো কখনো সে কল্পনা করে যদি বাচ্চাটা থাকত? যদি কায়েস পাশে থাকত? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে ভয় পায়। এই কল্পনা যেন তার স্বাধীন জীবনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। সে বিছানার কিনারায় বসে থাকে, জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের আলো দেখে। কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই, কেউ তার চোখে চোখ রাখছে না। সে একা। তবু তার ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা জন্ম নেয়। এই একাকিত্বই তার স্বাধীনতার মূল্য।

কায়েসের কথা মনে পড়ে। তার সঙ্গে পরিচয়, কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতির একটা বড় অংশ রুমানার।

রুমানা প্রেমে যেমন ডুবেছে, তেমনি উঠে এসেছে। তার কাছে প্রেম মানেই শুধুই আবেগ ছিল না, শরীরও একটা বাস্তবতা। বহু সম্পর্কের পর এক বিয়েতে কায়েসের সঙ্গে দেখা। হঠাৎ করে যেন সম্পর্কের মানেটাই বদলে যায়। কায়েস তার ভেতরের ছায়াগুলোও বুঝে ফেলতে থাকে।

তাদের প্রেম জমে ওঠে ক্যামেরার লেন্সের পেছনে, ভ্রমণের পথে, মুভির আলো-আঁধারিতে, হঠাৎ রুমানার হাসিতে। কিন্তু কায়েস জানে না, রুমানা আজও তার অতীতের প্রেমগুলোর ছায়া টেনে নিয়ে বেড়ায়। সম্পর্ক গভীর হয়, আবার ভয়ের দেয়াল ওঠে।

বিয়েবাড়ির দুপুরটা একটু আলাদা ছিল। ব্যান্ড বাজছিল, পনির কাবাবে লুকোনো দারুচিনি, আর এক টেবিলে বসে কায়েস হাসছিল একঝাঁক বন্ধুর সঙ্গে। রুমানা তখন পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে ক্যামেরা, ফোকাস ঠিক করছিল প্যান্ডেলের গ্লিটারিং লাইটে। তাদের চোখাচোখি হয় এক হালকা হেসে ওঠা মুহূর্তে।

‘আপনি কি ফটোগ্রাফার?’

‘না, শুধু ছবির মাধ্যমে সময়টা থামিয়ে রাখতে চাই কখনো কখনো।’

রুমানার উত্তর ছিল সহজ, কিন্তু থেমে গিয়েছিল কায়েসের ভেতরে কিছু একটা।

সম্পর্ক শুরু হয় ইনস্টাগ্রামে। ছবি, কমেন্ট, কিছু হেসে ওঠা রাত। এরপর একদিন তারা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়। ঋত্বিক ঘটকের, ‘মেঘে ঢাকা তারা।’ ছবির শেষে রুমানা কাঁদছিল। কায়েস পাশে বসে শুধু বলেছিল, ‘কাঁদলে ভালো লাগে না, কিন্তু কাঁদলে তোমাকে আরও সুন্দর দেখায়।’

রুমানা বুঝতে পারে, এ প্রেমটা আলাদা। আগের প্রেমগুলো ছিল ত্বকের, মুহূর্তের। এই প্রেম মনকে ধাক্কা দেয়। ফেলে আসা দিনগুলো যেন আবার ফিরে আসে চোখের সামনে। কিন্তু সম্পর্ক কখনোই একপথে চলে না। রুমানা ভয় পায়। নিজেকে খুলে দিতে চায়, আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কায়েস চায় বিশ্বাস। রুমানা চায় স্বাধীনতা।

একদিন তারা বেড়াতে যায় বান্দরবান। ঝরনার পাশে কায়েস ছবি তোলে। রুমানা পেছনে দাঁড়িয়ে, চুল উড়ছে হাওয়ায়, চোখে জ্যোৎস্নার শূন্যতা। ছবিটা কায়েসের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছবি হয়ে ওঠে। তবে রুমানা জানে, সেই ছবিতে তার সব আবেগ নেই। কিছু লুকানো গল্প, কিছু ভুল, কিছু শরীরের ক্লান্তি—সব লুকিয়ে থাকে ছবির ফ্রেমের বাইরে।

তার পরের সপ্তাহে কায়েস ছবি দিয়ে লেখে ইনস্টাগ্রামে, ‘এই ছবিটার পেছনে অনেক গল্প। সবাই বলে, প্রেম চোখে থাকে। আমি বলি, প্রেম থাকে না বলা ছবির কোনায়।’ রুমানা সেটা দেখে না। তারপর তো গর্ভে ভ্রূণের জন্ম, গর্ভপাত, সম্পর্কের সমাপ্তি...।

একদিন হঠাৎ রুমানার শরীর খারাপ হয়। প্রচণ্ড জ্বর। বমি হচ্ছে বারবার। অফিসে কাউকে জানাতে ইচ্ছা করে না। প্রেমিক? এখন তো কেউ নেই। শেষজন চলে গেছে এক মাস আগে, আর ফিরে আসেনি।

ফোনটা হাতে নিয়ে এক এক করে নামগুলো দেখে—রিয়াজ, কামরুল, আরিফ, মাহিন, আনোয়ার, শফিক, রাহাত...।

কাউকে কল করতে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করলেও যেন জানে, কেউ আসবে না। মা–বাবা গ্রামে, দুই দিন আগে কথা হয়েছে। তারা জানেও না মেয়েটা এত অসুস্থ।

রুমানা একা পড়ে থাকে। শরীরের পাশাপাশি মনেও যেন এক বিষাক্ত নিঃসঙ্গতা চেপে বসে।

তিন দিন পরে তার প্রতিবেশী রুবেল, যে প্রায়ই তাকে লিফটে দেখত, হঠাৎ তার দরজা বন্ধ দেখে উদ্বিগ্ন হয়। কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পর কোনো সাড়া না পেয়ে সে আধবোজা জানালার ভেতর দিয়ে চোখ রাখে, দেখে রুমানা অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে।

রুবেলই ডাক্তার ডাকে, ওষুধ আনে। হাসপাতালে নিতে চায়, কিন্তু রুমানা অজ্ঞান থাকায় সেনেটারিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে কিছুটা মানসিক চিকিৎসাও হয়।

চিকিৎসক বলেন, এটা সিম্পটমেটিক ডিপ্রেশন। দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, শূন্যতা, আত্মভ্রান্তি এবং সম্পর্কের জটিলতা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছে।

রুমানা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়। কিন্তু তার চোখের চাহনি বদলে গেছে। আগের মতো জ্বলজ্বলে নয়, বরং অনেক শান্ত, অনেক ক্লান্ত।

সে এখন অনেক কথা ভাবে। ভাবে সেই সব পুরুষের কথা, যাদের সে একসময় কাছে টেনেছিল আবার দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ভাবে, তারা কেউই কি তাকে ভালোবাসেনি?

তার মনে পড়ে তারা কেউই তো তাকেও নিজের করে নেয়নি। সময় পেলে এসেছিল, আবার চলে গিয়েছিল। একধরনের অদৃশ্য লেনদেন ছিল সম্পর্কগুলোতে। কেউই কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেনি। রুমানা জানে, সে–ও কাউকে ভালোবাসা দেয়নি। সে শুধু পেয়েছে। নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দেওয়ার মতো কিছু ছিল না হয়তো। সেনেটারিয়ামের জানালার পাশের চেয়ারে বসে রুমানা আকাশের দিকে তাকায়। সেখানে এখন মেঘ, সূর্য, আলো সবই আছে। কিন্তু তার চোখে সবই এখন নিষ্প্রভ।

তার চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার বলেন, রুমানার মধ্যে এখনো আশার আলো আছে। সে লিখছে, ডায়েরি রাখছে। পুরোনো দিনের কিছু গল্প লিখে ফেলেছে, যেন নিজেকে বোঝার চেষ্টা করছে।

একদিন সে ডায়েরিতে লেখে, ‘আমার চারপাশে অনেক মানুষ ছিল, আমি তাদের শরীর ছুঁয়েছি, কিন্তু আত্মা? সেটি কখনো ছুঁতে পারিনি। আমি কাউকে ভালোবাসিনি, তারাও আমাকে নয়। এই শহর, এই সম্পর্কগুলো সব যেন অস্থায়ী আবরণ। শেষ পর্যন্ত, আমি একাই ছিলাম। এখন হয়তো শুরু করতে পারি নিজেকে ভালোবেসে।’

সেনেটোরিয়ামের শেষ বিকেলে ঝরা পাতার নিচে বসে রুমানা একটি চিঠি খোলে। সেই চিঠি কায়েসের লেখা নয়, চিঠিটি তার নিজেরই, তিন বছর আগের, একটি থেরাপি সেশনের সময় লিখে রাখা। তাতে সে নিজেকে বলেছিল, ‘তুমি মা হতে চাও বা না চাও, শুধু মানুষ হয়ে বেঁচে থেকো। এটাই যথেষ্ট।’

রুমানা এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। কিন্তু সে চেষ্টা করছে। সে জানে, মানুষ ভুল করে। ভালোবাসা না পেলে, কখনো কখনো সেটা খোঁজে ভুল জায়গায়। হয়তো সে ভুল করেছে, হয়তো প্রতারিতও হয়েছে।

কিন্তু এখন সে আর কারও প্রেমে পড়ে না, কারও সঙ্গে বিছানায় যায় না। এখন সে কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে ভালোবাসতে শিখছে। সে জানে, এই ভালোবাসা থেকেই হয়তো একদিন সত্যিকারের সম্পর্কের শুরু হতে পারে।

সেই সন্ধ্যায়, সে সিদ্ধান্ত নেয় সে মাতৃত্ব বরণ করবে। এটি করবে একটি পরিত্যক্ত কন্যাশিশু হোমের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে। সেখানে সে হয়ে উঠবে বহু কন্যাশিশুর মা। রুমানা তাদের শেখাবে কীভাবে প্রথমে নিজেকে ভালোবাসতে হয়।

রুমানা ভাবতে থাকে, আমার শরীর কি আমার না? আমি যদি দশটা পুরুষের চোখে নিজেকে দেখতে দিই, তাতে কি আমি দশ ভাগ হয়ে যাই? আমার শরীর বিছানায় গেলে মন কি একসঙ্গে যায়?...না। মন পড়ে থাকে খালি জানালার গ্রিলে, একটা গাছের পাতায়, একটা অসমাপ্ত কবিতার লাইনে। আমি সন্তান চাই না, এই কথায় কি আমি কম নারী? এই জরায়ুর জন্য আমি দায়ী নই। সমাজ তো চায় আমার ডিম্বাণু দিয়ে ভালোবাসা বানাতে, আর আমি চেয়েছি শুধু একটুখানি নিশ্বাস।

কায়েসের কথা মনে পড়ে। কায়েস বলেছিল, ‘তুমি নারী নও, তুমি শুধু একটা মানুষ। নারীরা সন্তান জন্ম দিতে ভালোবাসে, কারণ সে রেখে যেতে চায় তার উত্তরাধিকার।’

এখন এই সন্ধ্যায়, যখন চারদিক নিস্তব্ধ, রুমানা বোঝে, ভালোবাসা সন্তান আর সংসার না, ভালোবাসা হলো নিজেকে আরেকটু সময় দেওয়া। ভালোবাসা মানে, যে হাতটা এত দিন শুধু অন্য কারও হাতে রাখতে চেয়েছিল, সেটা এবার নিজের গালে রাখার সাহস।

এই প্রথমবার রুমানার মনে হয়, সে কাউকে ভাবছে না। না কায়েস, না তার আগের প্রেমিকেরা, না কোনো ফেলে আসা শরীর, এবার সে ভাবছে শুধু নিজেকে। সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে। চোখের নিচে কালি, ঠোঁটে আর আগের মতো রং নেই, তবু এই মুখটাই তার। এই মুখেই সে কেঁদেছে, হেসেছে, চুমু খেয়েছে, গালি দিয়েছে, প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে। এই মুখটাকেই আজ সে ছুঁতে চায়, নতুন করে, আলতো করে, সম্মানের সঙ্গে। সে বলে ফেলে একটানা, ‘আমি প্রেম করেছি, শরীর দিয়েছি, গর্ভপাত করেছি, কেঁদেছি, পালিয়েছি, ভেঙেছি। ভেবেছিলাম, প্রেম মানে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। ভেবেছিলাম, যে আমাকে জিতিয়ে নেবে, তাকেই ভালোবাসা বলা যায়। কিন্তু না। ভালোবাসা আসলে জেতা নয়, হারানোও নয়। ভালোবাসা হলো নিজেকে একটু ধৈর্য দিয়ে দেখা, নিজের ভাঙা জায়গাগুলোকে ছুঁয়ে বলা, ‘ঠিক আছে, তুই এই রকমই, তবু তুই আমার।’ এই যে নিজেকে আবার বুঝে ওঠা, এই যে নিজের শরীরকে দোষ না দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরা, এটাই তো জোড়া লাগানো। ভালোবাসা এবার শুধু খুনসুটি নয়, শরীরও নয়, ভালোবাসা হলো নিজের সঙ্গে শান্তিতে বসে চা খাওয়া, পুরোনো চিঠিগুলো না পুড়িয়ে, বাক্সে তুলে রাখা, নিজের নামটা ডায়েরিতে লিখে দেখা, যেভাবে একসময় কাউকে লিখত, ‘প্রিয় কায়েস...’

এবার সে লিখবে, প্রিয় রুমানা, আজ তুই ভালোবাসা শিখছিস নিজের কাছেই।

এটাই তো জোড়া দেওয়ার গল্প, যেখানে প্রেমিক নেই, সন্তান নেই, সংসার নেই, তবু প্রেম আছে, আছে একজন নারী, নিজের ভেতরেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শূন্যতার ঠিকানা