সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন ন্যায্য হিস্যা পাবে না
Published: 11th, August 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা সামনের মুখ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের প্রান্তিক করে তোলার একটি চেষ্টা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। নারীর অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। সংসদে নারী আসন ও নারীর মনোনয়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে অবস্থান নিয়েছে, সেটা শুধু দুঃখজনকই নয়, সমাজের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বিকাশের পথেও বড় একটি ধাক্কা। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের জন্য আগের মতোই ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য।
বাংলাদেশের জন্মের ৫৩ বছর পার হয়ে গেলেও রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব একেবারে তলানিতে রয়ে গেছে, আর সেই প্রতিনিধিত্বটাও আবার মোটাদাগে আলংকারিক। মুখে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে চিন্তার দিক থেকে চরম রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক—এই বাস্তবতা তারই প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক কম।
রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণীর জায়গায় যে নিরঙ্কুশ পুরুষ আধিপত্য চলে আসছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটা বড় সুযোগ ও পরিসর তৈরি করে দিয়েছিল চব্বিশের অভ্যুত্থান। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, নারীদের কথা না শুনেই নারীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যে কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে, সেখানে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা নগণ্য। এমনকি ঐকমত্য কমিশনে কোনো নারী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতি কোনো অর্থেই গণতান্ত্রিক নয়। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটি একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে।
এটা ঠিক যে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এই হতাশাজনক অবস্থানের মূল দায় রাজনৈতিক দলগুলোর পশ্চাৎপদ ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং প্রথাগত চর্চা। তারা কোনোভাবেই নারীর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে নারাজ। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন কেন রাজনৈতিক দলের অবস্থানকেই শেষ কথা বলে মনে করবে? আমরা মনে করি, এখানে ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল এবং সেই সুযোগ এখনো আছে।
আমরা দেখছি যে রাজনীতি ও সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন সংস্কার কমিশন আলাদা প্রস্তাব দিয়েছিল। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবকে ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজের পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করেনি। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন কমিশন পৃথক প্রস্তাবে নারীর জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসন ও সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সরাসরি ভোটে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে।
সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫১ শতাংশ নারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও নারী কেন ক্ষমতার ন্যায্য হিস্যা পাবে না? গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলগুলো আসলে কী চর্চা করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? গত শনিবার প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে বয়েজ ক্লাব হিসেবে পার করে দেব, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, সেটা যথার্থ বলে মনে করি।
গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা শুধু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই জানাননি, তাঁরা সুস্পষ্টভাবে নারী আসন ও মনোনয়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কথাও বলেছেন। তাঁরা আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে ঐকমত্য কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আমরাও মনে করি, নারী আসন ও নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে অধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে তা নিরসন করতে হবে। নারী প্রতিনিধিদের যুক্ত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনকে আবারও আলোচনায় বসতে হবে। নীতিনির্ধারণীতে নারীকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণ থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি—কোনোটাই টেকসই হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে পুরুষতান্ত্রিক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ব র র জন র জন য আসন ও
এছাড়াও পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ জাতির সঙ্গে প্রতারণা: বাম জোট
জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে জাতির সঙ্গে প্রতারণা বলে আখ্যা দিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। এই ভাষণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ঠেলে দেবে বলেও মন্তব্য করেছেন তাঁরা।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বাম জোটের নেতারা এমন মন্তব্য করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) একমত হওয়াকেই যদি সবার ঐকমত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তা এত দিন ধরে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠককেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।’
বাম জোটের নেতারা বলেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য ঐকমত্য কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণেও একই কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত মতামত উঠে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের যে ন্যূনতম সংস্কারটুকু করার সুযোগ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল, তা–ও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৮০ দিন জাতীয় সংসদ দ্বৈত সত্তা নিয়ে চলবে অর্থাৎ একই সঙ্গে সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করার যে কথা বলা হয়েছে; এটাও সংবিধান পরিপন্থী। এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো ঐকমত্য হয়নি।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিয়ে যে কথা প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে বলেছেন, তা একদেশদর্শী ও সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধানে আদেশ জারি বা গণভোটের কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি কেবল অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে সংবিধান পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে।
বাম জোটের নেতারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গণভোট ও আদেশ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তাতে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টের (দ্বিমতের) উল্লেখ থাকছে না। ঐকমত্য কমিশনে সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ৩০টিতে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন—এ তথ্যও সঠিক নয়। ৩০টি প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, এ রকম প্রস্তাব ১১টির বেশি নয়।
এ ছাড়া বিবৃতিতে লালদিয়ার চরে ডেনমার্কের কোম্পানিকে বন্দর নির্মাণ এবং পানগাঁও টার্মিনাল সুইজারল্যান্ডের কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের উদ্যোগে আগামী রোববার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে কেন সরকার একের পর এক আমাদের লাভজনক বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে অতি তৎপর হয়ে উঠেছে, তা দেশবাসীর মনে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করছে। এ ধরনের প্রকল্পে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক নানা ঝুঁকি থাকে। দেশের নানা মহল থেকে বারবার সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হলেও সরকার সেদিকে কর্ণপাত না করে আগের স্বৈরাচার সরকারের বন্দর ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।’
বাম জোটের নেতাদের বিবৃতিতে উঠে আসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি। তাঁরা বলেন, মব সন্ত্রাস লাগামছাড়া, নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে, উগ্র মৌলবাদী তৎপরতা সমাজজীবনকে বিষিয়ে তুলছে, দিনদুপুরে ফিল্মি কায়দায় গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, মানুষের বেঁচে থাকার উপায়ের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। আর এই সুযোগে পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি নানা ধরনের গুপ্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে জনজীবনে এক চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সরকারের গত ১৫ মাসের কর্মকাণ্ডই এই পতিত শক্তিকে জনপরিসরে স্থান করে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ বাম জোটের নেতাদের।
গণভোট ও উচ্চকক্ষ অপ্রয়োজনীয় এবং জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে—এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে বাম জোটের নেতারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কেবল একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদেরই। তাই কালবিলম্ব না করে দ্রুত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করুন। দেশের বন্দরসহ জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ থেকে বিরত থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো প্রতিকারে উদ্যোগ নিন।’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলীর পক্ষ থেকে বিবৃতিটি পাঠানো হয়েছে।