অবহেলায় শিক্ষা খাত, সংস্কারে কমিশনও করা হয়নি
Published: 11th, August 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি; বরং সিদ্ধান্তহীনতা, প্রশাসনিক জটিলতা, গতিহীনতা শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করেছে। শিক্ষার বিভিন্ন পদে ব্যক্তির বদল হলেও কাজকর্মে তেমন পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায় আগের মতোই।
শিক্ষা বরাবরই বাজেট বরাদ্দে অবহেলার শিকার। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন চলতি অর্থবছরেও শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের শতকরা হার বাড়েনি, বরং প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে। ফলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন বা সংশোধনের কাজও থমকে আছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারে ১১টি কমিশন হলেও শিক্ষা খাতে কোনো কমিশন গঠন করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। প্রাথমিক শিক্ষায় একটি পরামর্শক কমিটি হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি সামান্য।
সব মিলিয়ে খুব কম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা বলা যাবে না। আশা করি, আগামী পাঁচ-ছয় মাসে আমাদের নেওয়া প্রয়াসগুলো আরও বেগবান করতে পারব।সি আর আবরার, শিক্ষা উপদেষ্টাবরং এই কমিটির সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা আবার চালু করা হয়েছে ‘কোটার ভিত্তি’তে। পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে পঞ্চম শ্রেণির ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। প্রাথমিকের পাশাপাশি শিক্ষাবর্ষের সাত মাস পর অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালুর তোড়জোড় চলছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরীর ভাষ্য, গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল শিক্ষা ও চাকরিতে কোটার বৈষম্য থেকে। কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষায় সেই কোটা থাকছে। এর ফলে বিদ্যালয়গুলো নির্ধারিত এসব শিক্ষার্থীর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, যা বৈষম্য তৈরি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে উপাচার্য নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) গঠন। এর মাধ্যমে শুধু গত মাসে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ মাস অচলাবস্থা ছিল।
অনেক আশা-প্রত্যাশা ছিল...শিক্ষা নিয়েও একটা কিছু হবে। কিন্তু শিক্ষা কমিশনই তো হলো না। মনজুর আহমদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব ভাতা বাড়ানোও একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। আগে তাঁরা মূল বেতনের ২৫ শতাংশ বোনাস পেতেন, এখন পাচ্ছেন ৫০ শতাংশ। তবে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বন্ড দিলেও এর সুবিধা পেতে আরও প্রায় ছয় মাস লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ফলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা পেতে ভোগান্তি রয়ে গেছে।
গত মার্চ থেকে শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণ-অভ্যুত্থানে তরুণদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় একটি অস্থিরতার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একটু সময় লেগেছে। এর মধ্যে আবার প্রতিষ্ঠান ভেদে কোথাও কোথাও অতীতের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কোথাও সমস্যা মেটাতে কিছুটা সময় লেগেছে। আবার কোথাও সময় লাগেনি।
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, শিক্ষা কমিশন না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলতে পারবেন না। তবে কিছু বিষয়ে বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষাকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায়, তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে খুব কম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা বলা যাবে না। আশা করি, আগামী পাঁচ-ছয় মাসে আমাদের নেওয়া প্রয়াসগুলো আরও বেগবান করতে পারব।’
নেতৃত্বে পরিবর্তনগত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর শুরুতে শিক্ষার দায়িত্ব ছিল প্রধান উপদেষ্টার অধীনে, পরে ১৬ আগস্ট দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে। দায়িত্ব নিয়েই এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে সংকটে পড়েন তিনি। ২০ আগস্ট একদল শিক্ষার্থী সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে ১৮ তলায় উঠে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে। তখন বিক্ষোভের মুখে স্থগিত কয়েকটি পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয় শিক্ষা বিভাগ। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আবার ফল প্রকাশের পর একদল শিক্ষার্থী নতুন করে ফল প্রকাশের দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করে। তবে সেই দাবি মানা হয়নি।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরেকটি সমস্যা সামনে আসে। গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেন। এ পরিস্থিতিতে এসব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করা ছিল অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সামনে বড় কাজ। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে প্রায় তিন মাস লেগে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জোর করে বা চাপ দিয়ে পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কোথাও কোথাও ‘মব’ তৈরি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সি আর আবরার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত বড় কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। অবশ্য তিনি ১২৩টি পাঠ্যপুস্তক যাচাই ও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০২৭ সাল থেকে মাধ্যমিকে (প্রথমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে) পরিমার্জিত নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা বলা হলেও এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো কমিটিই হয়নি।একই সময়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিকভাবে কিছু অসুবিধায় পড়তে হয়। এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের সব বই পেতে প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অথচ গত মার্চ থেকে প্রতিষ্ঠানটি চলছে চেয়ারম্যান ছাড়াই। সংস্থাটির একজন সদস্য সাড়ে চার মাস ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চেয়ারম্যানের পদ সামলাচ্ছেন।
গত মার্চে নতুন শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সি আর আবরারকে। তখন শিক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম পদত্যাগ করেন। আর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সি আর আবরার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত বড় কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। অবশ্য তিনি ১২৩টি পাঠ্যপুস্তক যাচাই ও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০২৭ সাল থেকে মাধ্যমিকে (প্রথমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে) পরিমার্জিত নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা বলা হলেও এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো কমিটিই হয়নি।
আলোচনা-বিতর্কজুন মাসের গোড়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের একটি বক্তব্য ঘিরে ব্যাপক আলোচনা হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টাকে এক কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি নিজেই সেদিন জানান। ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কথাও জানান তিনি। সেই ব্যক্তিকে পদায়ন করা হয়নি। তবে কে সেই ব্যক্তি এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানানো হয়নি।
গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় পরদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দিন দিবাগত রাত পৌনে তিনটায় ২২ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। শিক্ষার্থীরা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা শিক্ষা উপদেষ্টা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে বিক্ষোভ করে। পরে সরকার সিদ্দিক জোবায়েরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। বর্তমানে পদটি শূন্য, একজন অতিরিক্ত সচিব রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব পদে চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আবদুর রশীদকে। পরে তাঁকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা হলে আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিদ্দিক জোবায়েরকে এই বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা খাতে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি।সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি কমশিক্ষা কমিশন করা না হলেও প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদের নেতৃত্বে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কিছু সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ এখনো নেই। যদিও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ চলছে। শুধু কমিটির সুপারিশ আর আদালতের রায়ের আলোকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড-১০ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সহকারী শিক্ষকেরা রয়ে গেছেন সেই আগের মতোই। বেতন গ্রেড বাড়ানোর দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করছেন।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা খাতে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি।
শিক্ষা খাতের এক বছরের মূল্যায়ন সম্পর্কে অধ্যাপক মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশাভঙ্গ, এটাই মূল কথা। অনেক আশা-প্রত্যাশা ছিল যে নতুন সরকার নানা বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তো শিক্ষা নিয়েও একটা কিছু হবে। কিন্তু শিক্ষা কমিশনই তো হলো না। শুধু প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে একটি কমিটি হলো, সুপারিশও দেওয়া হলো। কিন্তু সেটি নিয়ে ঠিকমতো পরিকল্পনা করে সামগ্রিকভাবে কোনো উদ্যোগ দেখছি না।’
শিক্ষায় সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা দরকার উল্লেখ করে মনজুর আহমেদ বলেন, এখন এই সরকারের সময়ও শেষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে তারা কিছু করতে পারবে কি না, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নত ন শ ক ষ উপদ ষ ট র কর মকর ত আর আবর র উপ চ র য সরক র র হয় ছ ল পর ক ষ প রক শ মন ত র মনজ র প রথম ন হয়ন
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় রায় হলো ৩৯৭ দিনের মাথায়
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা হয়েছিল গত বছরের ১৭ অক্টোবর। তারপর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিচার। সবশেষে রায় হতে সব মিলিয়ে লাগল ৩৯৭ দিন।
আজ সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এর দেওয়া রায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার অন্য দুই আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে।
সময় তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান রয়েছেন ভারতে। তাদের দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম রয়েছে নিষিদ্ধ।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে।
পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
আরও পড়ুনরাষ্ট্র কেন শেখ হাসিনার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিল০৫ নভেম্বর ২০২৫এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। এ বছরের ১৬ মার্চ তাঁর পাশাপাশি সাবেক আইজিপি আল-মামুনকেও আসামি করা হয়।
একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নাম প্রথমবারের মতো আসে গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদনে। সেদিন থেকে এ মামলায় আসামি হন তিনজন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও আল-মামুন।
তাঁদের বিরুদ্ধে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এর মধ্য দিয়ে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়।
এরপর গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই আল–মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন।
গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা।
মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
আরও পড়ুনমানবতাবিরোধী অপরাধে হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড১ মিনিট আগেএ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর।
সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। সব মিলিয়ে ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।
পলাতক শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মো. আমির হোসেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম আগেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সাজা হলে তাঁরা আপিল করতে পারবেন না। এর কারণ তাঁরা পলাতক। আপিল করতে হলে তাঁদের আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।