গণমানুষের পক্ষে পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্বাধীনতা–উত্তর গ্রুপ থিয়েটার
Published: 12th, August 2025 GMT
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যাঁরা নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন তাঁরা বললেন, শিল্পের জন্য শিল্প নয়। তাঁরা বলতে চাইলেন, শিল্প হবে উদ্দেশ্যমুখী। শিল্প বাঁধনছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত নয়। যেকোনো শিল্পে একটি উপযোগিতা থাকতে হবে। তাঁরা বললেন, শিল্প হোক জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার। নাটক হোক রাজনীতিমুক্ত (Let us depoliticise theatre), এই স্লোগানের প্রবক্তা ফরাসি অ্যাবসার্ড নাটকের নাট্যকার ইউজিন আয়োনেস্কো। এই মতের সঙ্গে মিল রেখে থিয়েটার চর্চাকারীরা বললেন, শিল্পের জন্য শিল্প।
গত শতকের থিয়েটারের প্রধানতম বিকাশ হলো রাজনীতিকে ঘিরে এর ব্যাপক সম্প্রসারণ। বিশ শতকে নাটকের বিষয়ে, প্রযোজনা ভঙ্গিমায়, মঞ্চের নকশায় ও নাট্য নির্মাণশৈলীতে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। জনগণের থিয়েটারের ভাবনা নানাভাবে, নানা চিন্তায় আবর্তিত-বিবর্তিত হতে থাকে। সব ভাবনার শুরু, থিয়েটারকে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
কেউ কেউ এ সময় খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, একটা রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখেই নাট্যকর্ম পরিচালিত হবে আর সে দর্শন হবে মার্ক্সবাদ। সেই বিশ্বাস থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে ছড়াতে থাকে অ্যাজিটপ্রপ (agitprop) নাট্যভাবনা। গণজাগরণ বা অ্যাজিটেশন এবং প্রপাগান্ডা বা প্রচার শব্দ দুটি মিলে জন্ম নেয় অ্যাজিটপ্রপ নাট্যধারা। এই নাট্যভাবনার উদ্দেশ্য ছিল শ্রেণিবিন্যাস, শ্রেণিসংঘর্ষ, শ্রেণিসংগ্রামের কথা তুলে ধরা এবং শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করা। যদিও মার্ক্সবাদীদের ভাবনা শুধু অ্যাজিটপ্রপ ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সে ক্ষেত্রে বলা যায় অ্যাজিটপ্রপ ছিল মূলত রাজনৈতিক নাট্যভাবনার একটি প্রথম ও বিশেষ ধাপ। আমরা এখানে রাজ্যশাসন–সম্পর্কিত নীতিকেই রাজনীতি হিসেবে দেখছি। যেমনটা বলেছে বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান—রাষ্ট্র শাসন বা পরিচালনার নীতি।
স্বাধীনতার পরপরই গণমানুষের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মধ্যে। তবে সেই নাটকে কোনো সামাজিক বিশ্লেষণ দেখা যায়নি। রাজনৈতিক ভাবনা বাদ দিয়ে, রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নাটককে জনগণের বিষয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছিল।স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার বারবার দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে বলেছিল, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার কর্মসূচি নিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছে। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার সেদিনের জনগণের মধ্যে ছিল, তা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত ছিলেন না নাট্যকর্মীরা। তবে এ কথাও সত্য যে সত্যিকার অর্থে শোষণমুক্তির রাজনীতি কী, সে সম্পর্কে তাঁরা বড় একটা সচেতন ছিলেন, এমনটিও মনে হয় না। স্বাধীনতার পর নানা রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে বাংলাদেশের নাট্যধারায় নতুন এক ভাবনার উন্মেষ ঘটে। এই ভাবনায় সম্পৃক্ত ছিলেন রাজনৈতিক দল–বহির্ভূত, সমাজ বিশৃঙ্খলায় বিক্ষুব্ধ, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার তাড়নায় উদ্গ্রীব একদল তরুণ। যাঁরা মঞ্চের আগের সব রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, নতুন নাট্যধারা গড়ে তোলার কথা বলেন, নতুন বিষয় নিয়ে নাটককে জনগণের বিষয় করে তুলতে চান। যাঁরা চেয়েছিলেন নতুন করে কিছু করতে। নিজেরাই তাঁরা নাটক লিখেছেন, নিজেরাই তা মঞ্চস্থ করেছেন, কোনো সুনির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদ ছাড়াই। আর সে পথ ধরেই জন্ম নেয় বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন।
স্বাধীনতার পরপরই গণমানুষের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মধ্যে। তবে সেই নাটকে কোনো সামাজিক বিশ্লেষণ দেখা যায়নি। রাজনৈতিক ভাবনা বাদ দিয়ে, রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নাটককে জনগণের বিষয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছিল। নতুন এই নাট্যধারার প্রবক্তারা সবাই ছিলেন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। মার্ক্সবাদীদের মতে, মধ্যবিত্ত মানেই পাতিবুর্জোয়ার অংশ। পাতিবুর্জোয়া ভাবনার মধ্যে থাকে ভাববাদী ঝোঁক। যার ফলে নানা বিভ্রান্তির জন্ম হয়। পাতিবুর্জোয়ার মানসিকতায় ভাববাদী চিন্তার প্রভাব যে কত রকম নতুন নতুন চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতা–পরবর্তী নাট্যচর্চার মধ্যে, মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা নানাভাবে ধরা পড়ে। তখনকার নাটকগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সামাজিক অঙ্গীকারের প্রশ্নে লক্ষ্যহীনভাবেই বাংলাদেশের নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল। সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ নাটক বলতে আমরা এমন নাটকের কথা বলছি, যা সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে তুলে ধরে এবং জনগণকে জড় অবস্থা বা জড়িমার বিরুদ্ধে ভাবতে শেখায়।
গ্রুপ থিয়েটার উৎসব ’৭৯.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ব ধ নত জনগণ র ভ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
রাষ্ট্র মানে কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক চালানো নয়: ফরহাদ মজহার
গণ-অভ্যুত্থানের পর পতিত সরকারের সংবিধান ও আমলাতন্ত্র রেখে দেওয়ার কড়া সমালোচনা করেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। বর্তমান সরকারের বৈধতা নিশ্চিত না করে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নির্বাচন আয়োজনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র মানে কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক চালানো নয়।
আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ফরহাদ মজহার এ কথা বলেন।
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্ত না হলে নির্বাচন নিয়ে কথা বলার কোনো অর্থ নেই বলে মনে করেন এই চিন্তক। উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনি তো গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এসেছেন, আপনি গণ-অভ্যুত্থানের কেউ নন। আমি আবারও বলছি এখানে ভুল বোঝার কোনো অপশন নেই। তিনি গণ-অভ্যুত্থানের কেউ নন। এখানে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা অনেকে সরাসরি গণ-অভ্যুত্থানে রাস্তায় ছিলেন, বুক পেতে দিয়েছেন। আমরা বছরের পর নির্যাতিত হয়েছি। আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি।’
এরপরও অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং কোনো বিরোধিতা করছেন না উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘কিন্তু তিনি (ইউনূস) গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় বোঝেননি। এখন তিনি যে জায়গায় গিয়েছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাঁর প্রথম ভুল তিনি এসেই তরুণ শিক্ষার্থীদের মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচয় করিয়েছেন। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের সত্তা হচ্ছে জনগণ, কোনো ব্যক্তি নয়। সবাই মিলে এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে।’
সফল নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কাএই চিন্তক বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রথম কাজ হওয়া দরকার ছিল ফ্যাসিস্ট সরকার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করা। তিনি বলেন, এই অভ্যুত্থানে অনেকে শহীদ হয়েছেন এবং অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি তাঁর প্রশ্ন, ‘এত বড় আত্মত্যাগের পরে আপনি কিসের ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা শুরু করলেন?’
নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘সফল নির্বাচনের কোনো লক্ষণ দেখছি না। আপনি কিসের ভিত্তিতে নির্বাচন দিচ্ছেন? দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ফেলে দেবেন না। আপনার যে জনপ্রিয়তার হ্রাস হয়েছে, এটা আমাদের জন্য বিপজ্জনক। আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।’
এই চিন্তক বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক দল মানে যারা জনগণের সেবা করে, জাতিকে যারা পথ দেখায়, নতুন কথা বলে। এখানে যেটা আছে, সেটা লুটেরা শ্রেণি, দুর্নীতিবাজ। তাদের সঙ্গে আপনি কথা বলেছেন, জনগণের সঙ্গে কথা বলতে বলেননি।’
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক দল মানে যারা জনগণের সেবা করে, জাতিকে যারা পথ দেখায়, নতুন কথা বলে। এখানে যেটা আছে, সেটা লুটেরা শ্রেণি, দুর্নীতিবাজফরহাদ মজহার, কবি ও চিন্তকশেখ হাসিনার সংবিধান রেখে সে সংবিধানের অধীনে শপথ নেওয়ার সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আপনি একটা অবৈধ সরকার। তবে অবৈধ সরকার বলার মানে এই না যে আপনাকে আমরা চাই না। এর মানে হচ্ছে, আপনার প্রথম কাজ নিজের বৈধতা নিশ্চিত করা।’
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ‘আমরা অপেক্ষা করেছি আপনার যেন মতি হয়। আপনি যেন রাজনীতি কাকে বলে, এটা বোঝেন; আইন কাকে বলে, বোঝেন। কারণ, রাষ্ট্র মানে কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক চালানো না।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, জনগণ কী চায়, নতুন গঠনতন্ত্র চায় কি না। কিন্তু জনগণকে বঞ্চিত করে মাফিয়া শ্রেণির সঙ্গে কথা বলছেন। বিদেশ থেকে লোক এনে বসানো হয়েছে, যাঁরা বিদেশে কাজ করেছেন করপোরেট স্বার্থ রক্ষার জন্য।
তরুণেরা মন্ত্রণালয় চালাতে পারেনিএই চিন্তক বলেন, কিছু তরুণ ছাত্রদের মন্ত্রণালয়ে নিয়েছেন, এ জন্য অভিনন্দন। কিন্তু মন্ত্রণালয় তারা চালাতে পারেনি। তরুণেরা দেশ চালাবে, এটাই তো স্বপ্ন। কিন্তু তরুণদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা হয়েছে। কারণ, শেখ হাসিনার আমলাতন্ত্র রয়ে গেছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে দলের নাম পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার জানান, জামায়াতের অনেক ইতিবাচক ভূমিকা আছে। কিন্তু এই এক কালো দাগের জন্য আগামী দিনে যে সম্ভাবনা, নতুনভাবে ইসলামের যে পুনর্জাগরণ, তার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সভায় জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) মতো নির্বাচনে উপদেষ্টাদের যুক্ত হতে হয়। যখন ৩০০ আসনে নির্বাচনে হবে, তখন কী হবে?
কল রেকর্ড ফাঁসের ভয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ফোনে কথা না বলে সরাসরি দেখা করে কথা বলেন—এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি কী এমন কথা বলেন। এখানে সন্দেহ করার মতো বিষয় আছে।
সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সাদেক রহমানের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন সাবেক সচিব ও কূটনীতিক আবদুল্লাহ আল মামুন, আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাক, জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মজুমদার প্রমুখ।