বাবাকে দাফন করে গরু নিয়ে হাটে যাওয়া সেই আরিফুলের ধানও বন্যায় তলিয়ে গেছে
Published: 14th, August 2025 GMT
গত কোরবানির ঈদের আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বাবার লাশ দাফন করে আবার ঢাকায় গরুর হাটে গিয়েছিল যে আরিফুল, তাদের এক বিঘা আউশ ধানের খেত বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। আরিফুলের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পলাশী ফতেপুর গ্রামে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে আরিফুল সেই ধান গলাপানি থেকে কেটে তুলছিল। খেতের এক পাশে একটি টিনের কড়াইয়ে ধান কেটে রাখছিল। আরেক পাশে রাখা নৌকায় করে সেগুলো বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির বাইরের আঙিনা ডুবে গেছে, ভিটাটুকু ভেসে আছে, সেখানেই ধান রাখা হচ্ছিল।
আরিফুল জানায়, ধান এখনো পুরোপুরি পাকেনি। হয়তো তিন ভাগের এক ভাগ ধান পাওয়া যাবে। একজন শ্রমিকের খরচ পড়ে ৮০০ টাকা। নিজেদের ধান ডুবে যাচ্ছে, সহ্য করা যাচ্ছে না বলে কেটে ফেলছে। শ্রমিকদের খরচ মেটাতে গেলে হয়তো তেমন কিছুই থাকবে না, তাই নিজেই এ কাজে লেগে পড়েছে।
চকরাজাপুর ইউনিয়নের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইউনিয়নের পলাশী ফতেপুর গ্রামের ২০০ বাড়ি, কালিদাসখালীর ২০০ ও আতারপাড়ার ১০০, চৌমাদিয়ার ও দিয়াড়কাদিরপুরের ১০০ বাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া চকরাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়সহ এর চারপাশে ৫০টি পরিবার পদ্মা নদীভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। ইউনিয়নের ৫০ বিঘা পেয়ারাবাগান, ৩০০ বিঘা কাউন, ৪০০ বিঘা আউশ ধান, ২০০ বিঘা ভুট্টাখেত, ৫০০ বিঘা পেঁপে ও ২০০ বিঘা কলাবাগান জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
আরিফুলের বাড়িতে যাওয়ার পথে দেখা গেল, গ্রামের দুজন নারী-পুরুষ প্রায় গলাপানিতে নেমে ধান কাটছিলেন। বন্যায় ধানখেতের সঙ্গে গোচারণভূমিও ডুবে গেছে। তাই তাঁরা নিজের জমির কাঁচা ধান গরুকে খাওয়ানোর জন্য কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের সব মাঠের ফসল গত চার দিনের বন্যার পানিতে এভাবেই ডুবে গেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে প্রায় ৬০০ পরিবার।
এই দুই নারী-পুরুষ হলেন চায়না বেগম (৩৫) ও তাঁর স্বামী সমশের আলী (৪০)। তাঁরা ২৫ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে জমি ইজারা নিয়ে পাঁচ বিঘা আউশ ধান চাষ করেছিলেন। প্রতি বিঘা ধান চাষে তাঁদের খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা করে। সমশের আলী বলেন, ‘কাঁচা ধান গরুর লাইগি কাটতিচি, এবার আমরা কী খাইয়া বাঁচমু, হেই চিন্তায় মরতিচি।’
লক্ষ্মীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে গিয়ে দেখা গেল, বিদ্যালয়ের বেড়ার অর্ধেক পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। পাশেই বাথরুমের গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
চনকা মিস্ত্রির বাড়ির মেঝে পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। তাঁর স্ত্রী সালমা বেগম (৩৫) ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, রান্নাবান্না করা যাচ্ছে না। চারদিক থেকে পোকা পানিতে ভেসে বাড়িতে চলে আসছে। তাই অন্য জায়গা থেকে রান্না করে এনেছেন।
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাম্মী আক্তার বলেন, তাঁরা প্রায় ২২০টি পরিবার পানিবন্দী হওয়ার খবর পেয়েছেন। গতকাল বুধবার তাদের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আর ফ ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘বিষ খাওয়াইয়া হাঁসগুলা মারিয়া আমারে পথে বসাই দিল’
সবে সকাল হয়েছে। বাড়ির পাশের জলমগ্ন জমিতে এদিক-ওদিকে ভাসছিল মৃত হাঁস। খামারি চেরাগ আলী ও তাঁর স্বজনেরা পানিতে নেমে সেই মৃত হাঁসগুলো তুলে জমির আলে জমা করছিলেন। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন চেরাগ আলী। তিনি বলেন, ‘এই হাঁসগুলাই আমার সম্বল আছিল। কত যত্ন করি এইগুলারে পালছি। বিষ খাওয়াইয়া হাঁসগুলা মারিয়া আমারে পথে বসাই দিল। আমি নিঃস্ব হই গেলাম।’ তাঁর কান্নায় পাশে থাকা কয়েকজন প্রতিবেশীরও চোখ ভিজে ওঠে।
চেরাগ আলীর (৬৫) বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর ধরে তিনি হাঁস পালন করছেন। তাঁর খামারে দেশি প্রজাতির ৫০০ হাঁস ছিল—কিছু ডিম দিত আর কিছু অচিরেই ডিম পাড়া শুরু করার কথা ছিল। জলমগ্ন জমিতে খাবার খেতে নেমে গতকাল মারা গেছে ৩৩৫টি হাঁস।
আজ শুক্রবার সকালে গোবিন্দপুরে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পাশে নিচু কয়েকটি জমিতে পানি আটকানো আছে। স্থানীয়ভাবে জলমগ্ন সেই স্থান ‘গোবিন্দপুরের জাওর’ নামে পরিচিত।
চেরাগ আলী জানান, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার সকালে তিনি হাঁসগুলো ওই স্থানে ছেড়ে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজে দূরের জমিতে চলে যান। বিকেলে এসে দেখেন, অনেক হাঁস মৃত অবস্থায় ভাসছে। জমির আলে ছড়ানো-ছিটানো ধান দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। দ্রুত জীবিত হাঁসগুলো বাড়িতে নিয়ে আসেন। আলো কমে যাওয়ায় মৃতগুলো তুলতে পারেননি। বাড়িতে নেওয়ার পর আরও চার-পাঁচটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি জানান, তেঁতুলের রস খাইয়ে সেগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তাঁর ধারণা, জলমগ্ন স্থানের আশপাশে ছড়ানো বিষ মেশানো ধান খেয়েই হাঁসগুলো মারা গেছে।
চেরাগ আলী আরও বলেন, ‘প্রায় ১৪ বছর ধরি হাঁস পালি। ডিম বেচিয়া সংসার চালাই। পাঁচ মাস আগে কিশোরগঞ্জ থাকি ৪০০ বাচ্চা কিনি আনি বড় করি তুলছিলাম। কিছুদিন পরেই এইগুলা ডিম পাড়া শুরু করি দিত। সব মরিয়া শেষ হই গেল।’
চেরাগ আলী জানান, জলমগ্ন স্থানটিতে এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির জমি আছে। বর্ষায় জমিগুলো দীর্ঘ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে এবং মাছের আবাসস্থল হয়। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখে সেই জলাশয় মাছ ধরার জন্য ইজারা দেওয়া হয়। এবার পশ্চিম গোবিন্দপুরের মফিজ আলীসহ কয়েকজন এটি ইজারা নিয়েছেন। মাছ ধরা শেষ হলে বোরো ধানের মৌসুমে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়।
খামারি চেরাগ আলী ও তাঁর স্বজনেরা পানিতে নেমে সেই মৃত হাঁসগুলো তুলে জমির আলে জমা করছিলেন। আজ শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে