উকবা ইবনে নাফে: উত্তর আফ্রিকা জয়ের নায়ক
Published: 15th, August 2025 GMT
উকবা ইবনে নাফে ছিলেন আফ্রিকায় মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার প্রতিনিধি। মহান এই সেনাপতির ওপরই মুয়াবিয়া (রা.) আফ্রিকা বিজয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মিসর থেকে পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর হাতেই কায়রোয়ান শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বস্ততা, নেতৃত্বগুণ এবং নির্ভীক যোদ্ধা ও দ্বীনদার ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবিশেষ খ্যাত ছিলেন।
তাঁর পিতা নাফে ইবনে আবদুল কায়েস ছিলেন একজন সাহাবি। উকবা ছিলেন আরেক বীর সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.
উকবা জন্মগ্রহণ করেন মহানবীর (সা.) হিজরতের এক বছর আগে। নবীজির সঙ্গে তাঁর সরাসরি সাক্ষাৎ প্রমাণিত নয়। তবে কারও কারও ধারণা, সাক্ষাৎ হয়েছে। কেননা কোনো তাবিয়ির নেতৃত্বে সাহাবি কাজ করবেন, তা পছন্দ করতেন না বলে উমর (রা.) সাহাবি ছাড়া অন্যদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতেন না। কিন্তু উকবাকে তিনি নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন। সাহাবিদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ মরক্কোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
উকবা (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগের পরিবেশে গড়ে ওঠায় ছোটবেলা থেকেই ইমান, সাহস ও নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করেন। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল সামরিক গুণাবলির ঝলক। তিনি জিহাদকে শুধু লড়াই নয়; বরং আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ ও দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন।
আফ্রিকা, ত্রিপোলি, বারকা ও উত্তর-আফ্রিকার আবহওয়া, প্রকৃতি, স্থানীয় ব্যক্তিদের আচার-ব্যবহার, অভ্যাস ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে উকবার যথেষ্ট জানাশোনা ছিল। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) আফ্রিকা বিজয়ের সর্বশেষ অভিযানে নেতৃত্বের জন্য হাতেগোনা যে কজন সামরিক কমান্ডারকে বিবেচনা করছিলেন, উকবা ছিলেন তাঁদের একজন।
আরও পড়ুনসাহসী সাহাবি হজরত যুবাইর (রা.)০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫যুদ্ধজীবনউকবা (রা.) প্রথমে আমর ইবনুল আস (রা.)-এর সঙ্গী হিসেবে মিসর বিজয়ে অংশ নেন। ২১ হিজরিতে বারকা ও জুওয়াইলার মধ্যবর্তী অঞ্চলের পুরোটাই উকবার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ বছরই আমর (রা.) তাঁকে নুবিয়ায় পাঠান এবং ভবিষ্যতে নুবিয়া বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ পট তৈরিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
কোনো তাবিয়ির নেতৃত্বে সাহাবি কাজ করবেন, তা পছন্দ করতেন না বলে উমর (রা.) সাহাবি ছাড়া অন্যদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতেন না। কিন্তু উকবাকে তিনি নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন।উকবা (রা.) বারকা সেনানিবাসের জেনারেল ছিলেন। তিনি মিসরের পশ্চিম সীমান্ত এলাকার প্রহরী ছিলেন। চরম ভয়াবহ ও সংকটময় মুহূর্তেও তিনি ওই অঞ্চল আগলে রাখেন। মিসরের পশ্চিম সীমান্তে তাঁর উপস্থিতি ছিল রোমানদের জন্য এক ভয়ানক আতঙ্ক। এখান থেকেই তাঁরা আফ্রিকা অভিযানে যেতেন।
উমরের খিলাফতকালে উকবা প্রতিরক্ষাদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। উসমান (রা.)-এর শাসনামলের শুরুর দিকে এবং আলী ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর যুগেও তিনি এই উভয় দায়িত্ব পালন করেন।
আমিরুল মুমিনিন মুয়াবিয়া তাঁর ওপর আফ্রিকা বিজয়ের দায়িত্ব অর্পণ করে ১০ হাজার অশ্বারোহীর একটি শক্তিশালী বাহিন পাঠিয়ে দেন। এরপর আফ্রিকার বার্বার জনগোষ্ঠী ইসলামের ছায়াতলে চলে এলে তাঁর শক্তি আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। (আল-কামিল ফিত তারিখ: ২/৪৮৩)
এ ছাড়া মিসর ও ত্রিপোলি অভিযানে আমর ইবনুল আসের মতো বিজ্ঞ সেনাপ্রধানের সঙ্গী ছিলেন তিনি। অনুরূপভাবে আফ্রিকা অভিযানে আবদুল্লাহ ইবনু আবিস সারহ ও মুয়াবিয়া ইবনে হুদাইজের সান্নিধ্যও গ্রহণ করেন। সর্বশেষ নিজেই উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন বিজয়ে নেতৃত্ব দেন।
এ ছাড়া ত্রিপোলি অঞ্চলে উকবা (রা.) একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেন। আফ্রিকার স্থানীয় বার্বারদের ইসলামের আলোয় নিয়ে আসেন। গাদামিস, লাওয়াতা, ওয়াদ্দান, সিরত, মিগদাশ প্রভৃতি শহর ও দুর্গ তিনি জয় করেন। এরপর সেসব এলাকায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। মুয়াবিয়া (রা.)-এর আমলে তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে সমুদ্রপথে যুদ্ধেও অংশ নেন। (আল-আলামুল ইসলামি ফিল আসরিল উমাবি: ২৯৬)
দ্বীনের প্রচার-প্রসারের সুবিধার্থে তিনি বিজিত অঞ্চলে অনেক মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কায়রোয়ান: ইসলামি সভ্যতার সূতিকাগারমুয়াবিয়া ইবনে হুদাইজ (রা.) এ শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন; কিন্তু উকবার কাছে ইবনে হুদাইজের নির্মিত শহরের কৌশলগত অবস্থান পছন্দ হয়নি। ফলে শহরের সম্ভাব্য এই জায়গা কিছুটা স্থলভাগে নিয়ে আসেন। উকবার সবচেয়ে বড় কীর্তি ছিল কায়রোয়ান শহরের প্রতিষ্ঠা। এটি ছিল একটি সুসংগঠিত সামরিক শহর, যা পরবর্তী সময়ে উত্তর আফ্রিকার ইসলামি দাওয়াত, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
এই সমুদ্র না থাকলে যারা আপনাকে অস্বীকার করে, তাদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে দেশের পর দেশ অতিক্রম করতাম, যাতে আপনি ছাড়া আপনার দুনিয়ায় অন্য কারও উপাসনা না হয়।আটলান্টিক উপকূলে দাঁড়িয়ে উকবা ইবনে নাফেএই শহর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি মুসলিমদের জন্য একটি নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করেন, যেখানে সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত এবং স্থানীয় জনগণ ইসলামের ছায়ায় জীবন গড়ত। এখান থেকেই তিনি তাঁর পরবর্তী বৃহৎ অভিযানগুলো পরিচালনা করেন।
এভাবে কায়রোয়ান হয়ে ওঠে আফ্রিকার ইলমের প্রাণকেন্দ্র। এখানে জন্ম নেন বড় বড় ফকিহ, মুহাদ্দিস ও কারি। মরক্কো ও স্পেনের (আন্দালুসিয়া) অনেক ইলমপিপাসুও দলে দলে এখানে এসে ভিড় জমাতেন। (মাদরাসাতুল হাদিস ফিল কায়রোয়ান: ১/৫৫)
আরও পড়ুনআবু মুসা (রা.) ছিলেন জ্ঞানী সাহাবি০১ ডিসেম্বর ২০২৪শেষ ভাষণকায়রোয়ান শহর প্রতিষ্ঠার পর উকবা (রা.) বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেন। তিনি সেনাবাহিনীকে ইসলামি বিজয়াভিযানের জন্য আবারও প্রস্তুত করেন। শহরের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন জুহায়ের ইবনে কায়েস বালাবিকে। তবে এ অভিযানের শুরুতেই তিনি অনুভব করেন, এটা তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
সব শেষে উকবা তিয়ারেতের দিকে রওনা হন। সেখানে তীব্র লড়াই হয়। তবে লড়াইয়ের আগে তিনি মুজাহিদদের সামনে এক অগ্নিঝরা ভাষণ দেন। ভাষণের পর মুসলিমরা শত্রুদের মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে আল্লাহ তাঁদের বিজয়ী করেন। তারপর তিনি তানজিয়ার আসেন এবং আন্দালুস জয়ের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এগিয়ে যান মালিয়ানের দিকে। তবে সামনে আটলান্টিক মহাসাগর দেখে বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, এই সমুদ্র যদি না থাকত, আমি তোমার পথে জিহাদ করে দেশের পর দেশে অতিক্রম করতাম।’
তারপর বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি আমার চেষ্টার সবটুকু করেছি। এই সমুদ্র না থাকলে যারা আপনাকে অস্বীকার করে, তাদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে দেশের পর দেশ অতিক্রম করতাম, যাতে আপনি ছাড়া আপনার দুনিয়ায় অন্য কারও উপাসনা না হয়।’ (আল-বয়ানুল মাগরিব: ১/১১০-১১১)
কায়রোয়ান ত্যাগের আগে সন্তানদের একত্র করে বলেন, হে আমার সন্তানেরা, তোমাদের তিনটি উপদেশ দিচ্ছি, এগুলো পালন করলে তোমরা কখনো ধ্বংস হবে না।অশ্রুসজল অসিয়ততাহুদাযুদ্ধের আগে উকবা ইবনে নাফে (রা.) যখন নিজের অন্তিম সময় চলে আসার বিষয়টি অনুধাবন করেন, তখন কায়রোয়ান ত্যাগের আগে সন্তানদের একত্রিত করে বলেন, হে আমার সন্তানেরা, তোমাদের তিনটি উপদেশ দিচ্ছি, এগুলো পালন করলে তোমরা কখনো ধ্বংস হবে না।
প্রথমত, কোরআন ত্যাগ করে কবিতায় মন দিয়ো না। কোরআনই প্রকৃত পথপ্রদর্শক। আরবদের সেই কথা গ্রহণ করো, যা দিয়ে জ্ঞানীরা সঠিক পথ পায়। উত্তম চরিত্রের জন্য কোরআনই যথেষ্ট। কোরআন ব্যতীত অন্য সবকিছু থেকে দূরে থাকো।
দ্বিতীয়ত, পশমের কাপড় পরবে, তবু ঋণ করবে না। কেননা, ঋণ হলো দিনের জন্য অপমানের আর রাতের জন্য উদ্বেগের কারণ। ঋণ তোমার ইজ্জত-সম্মান ক্ষুণ্ণ করবে।
তৃতীয়ত, অহংকারী ও দাম্ভিকদের থেকে ইলম নিয়ো না। দ্বীন শিখো শুধু খোদাভীরু ও মুত্তাকিদের কাছ থেকে। এটাই নিরাপদ পথ।
এরপর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। জিহাদকে তোমার দয়া ও জান্নাত লাভের মাধ্যম বানিয়ে দাও। হে আল্লাহর ঘোড়া, চলো, এগিয়ে যাও।’ (আল-বয়ানুল মাগরিব: ১/২৩)
শাহাদাতউকবা ইবনে নাফে (রা.) শহীদ হন ৬৩ হিজরিতে, তাহুদার যুদ্ধে। উকবা যখন প্রায় হাজার মাইলের জিহাদি অভিযাত্রা সম্পন্ন করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে গিয়েছিল। ওই বয়সেই আল্লাহর পথে লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে তিনি শাহাদাতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। (তারিখুল ইসলামি: ২৩/৩৬৫)
আরও পড়ুনসাহাবিরা কেন এত সাহসী ছিলেন০৩ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ রহণ কর ন আটল ন ট ক করত ন ন ইসল ম র র জন য ব জয় র আল ল হ শহর র র ইবন
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের কাছে হারের কারণ ব্যাখ্যায় যা বললেন রশিদ খান
এশিয়া কাপের পর দ্বিপক্ষীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচেও বাংলাদেশের কাছে হারল আফগানিস্তান। কাল শারজাতে বাংলাদেশের কাছে ৪ উইকেটে হেরেছে রশিদ খানের দল। এই হারে দলের ব্যাটিং ও বোলিং দুই বিভাগকেই দুষছেন আফগান অধিনায়ক রশিদ খান।
আফগানিস্তানের ১৫১ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ উদ্বোধনী জুটি তুলেছে ১০৯ রান। তখন জয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু আচমকাই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে বড় ধস নামে। ১১.৪ ওভার থেকে ১৫.৪ ওভারের মধ্যে ২৪ বলে বাংলাদেশ ৯ রানে ৬ উইকেট হারালে ম্যাচে ফেরে আফগানিস্তান। কিন্তু এভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি তারা।
আফগানিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানোয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল রশিদের। ১৮ রানে ৪ উইকেট নেন এই লেগ স্পিনার। এর মধ্য দিয়ে দারুণ এক কীর্তিও গড়েন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে এ নিয়ে পঞ্চমবার ইনিংসে ৪ উইকেট নিলেন রশিদ।
টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর অধিনায়কদের মধ্যে টি–টোয়েন্টিতে আর কোনো অধিনায়ক এতবার ইনিংসে ৪ উইকেট নিতে পারেননি। বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান ও শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা দুবার করে ইনিংসে ন্যূনতম ৪ উইকেট নিয়েছেন।
কাল ৪ উইকেট নিয়েছেন রশিদ