ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের এই হঠাৎ-ঘনিষ্ঠতা কেন
Published: 15th, August 2025 GMT
যদি কখনো জানতে চান, দুটি দেশ আসলে কী নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত থাকে, তবে তাদের বক্তব্য শোনার দরকার নেই। বরং খেয়াল করুন, কোন কোন শব্দ তারা আলাদা করে বলতে চায় না। ইরান ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একটি শব্দ বারবার আরেকটির সঙ্গে সন্দেহজনকভাবে অবিচ্ছেদ্য জুটিতে হাজির হয়—‘বাণিজ্য’ ও ‘নিরাপত্তা’। আর যখন ‘বাণিজ্য’-এর ঠিক পরেই সব সময় ‘নিরাপত্তা’ আসে, তখন ধরে নেওয়া যায় যে প্রকৃত চালিকা শক্তি বাণিজ্য নয়।
কাগজে-কলমে তেহরান ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বড় জোট হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। দুটি বড় মুসলিম দেশ, প্রায় ৯০০ কিলোমিটারের একটি যৌথ সীমান্ত, একই ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং আংশিক মিল থাকা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বন্ধন। বাস্তবে তাদের ইতিহাস হলো দূরত্ব, মাঝেমধ্যে সন্দেহ আর ‘সহযোগিতা’ কেবল তখনই হয়, যখন কোনো সাধারণ সমস্যা মেটাতে হয় অথবা কোনো সাধারণ হুমকি এড়াতে হয়।
তবু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পর্যবেক্ষকেরা অদ্ভুত কিছু লক্ষ করেছেন: বছরের পর বছর ধরে সবচেয়ে প্রো-ওয়াশিংটনপন্থী পাকিস্তানি সামরিক শাসন, যার নেতৃত্বে আছেন চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল আসিম মুনির, তিনি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে উষ্ণ হাসি বিনিময় করছেন। ফেব্রুয়ারিতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনার সময় ইরান দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সরব হয়ে নিন্দা করে ইরানের ওপর ইসরায়েলের ১২ দিনের সামরিক হামলার। কোনো সাধারণ পর্যবেক্ষকের কাছে এটি দীর্ঘদিনের প্রাপ্য ভ্রাতৃসুলভ আলিঙ্গনের মতো মনে হতে পারে। আসলে তা নয়।
বালির ওপর দাঁড়ানো সম্পর্ককেন এমনটা হয়েছে তা বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭৯ সালে—যে বছর মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াকে এমনভাবে বদলে দিয়েছিল, যার প্রভাব আজও চলছে। সেই বছর ইরানের ইসলামি বিপ্লব শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ওয়াশিংটনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং এক বিপ্লবী মতাদর্শসম্পন্ন শিয়া ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্য মিত্র ও সুন্নি ইসলামের স্বঘোষিত অভিভাবক সৌদি আরব ইরানের প্রভাব প্রতিহত করার জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সুন্নি ধর্মীয় আন্দোলনে অর্থায়ন শুরু করে।
এর অংশ হিসেবে সৌদি-ইরানি প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় পাকিস্তান। ইসলামাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়াদ ও তেহরান উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও বাস্তবতা ছিল অনেক বেশি জটিল এবং রক্তাক্ত।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হঠাৎ বেড়ে যায়। সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত অনেক উগ্র সুন্নি গোষ্ঠী শিয়া সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু বানায়। এর জবাবে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারা পাকিস্তানে শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করছে। তথাকথিত ‘ভ্রাতৃত্ব’-এর গল্পটি ক্রমেই এক ভদ্র মুখোশের মতো মনে হতে থাকে, যার আড়ালে পাকিস্তানের মাটিতে এক বিপজ্জনক প্রক্সি যুদ্ধ চলছিল।
ফলাফল ছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, সামাজিক আস্থার ক্ষয় এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদের স্থায়ী গভীরতা—যা আজও পূর্ণাঙ্গভাবে নিরাময় হয়নি। ইসলামাবাদ ও তেহরানের মধ্যে যে কোনো ‘উষ্ণ’ সম্পর্ক প্রায় সব সময়ই ছিল লেনদেনভিত্তিক—যখন নিরাপত্তার কারণে দুই দেশ একে অপরের প্রয়োজন অনুভব করত, তখনই সেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতো, মুসলিম ঐক্যের কোনো যৌথ স্বপ্ন থেকে নয়।
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার তাফতান সীমান্ত.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।
প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।
প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।
অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।
সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়