কূটনীতিকে যদি খেলার প্রতীক ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে অনায়াসেই বলা যায়, আলাস্কায় অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে এক গোলে জিতেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। শূন্য হাতে ঘরে ফিরেছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প নিজেকে বিশ্বের সেরা ‘ডিল মেকার’ হিসেবে পরিচয় করাতে ভালোবাসেন। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় বসামাত্রই তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। ছয় মাস চলে গেছে, যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। শুরুতে দোষ দিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে, হোয়াইট হাউসে ডেকে এনে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, এই যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে খেলার মতো কোনো তাসই তাঁর হাতে নেই। পরে মস্কোর আগ্রাসী বিমান হামলা থামাতে ব্যর্থ হয়ে চোখ ফেরালেন পুতিনের দিকে, বললেন লোকটা অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, কিন্তু সে সবই ফালতু। খেপে গিয়ে এমন কথাও বললেন, আগামী ১০–১২ দিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি না মেনে নিলে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।

আরও পড়ুনপুতিন না ট্রাম্প— কে কাকে আসলে ফাঁদে ফেলছেন১৩ আগস্ট ২০২৫

অথচ নিষেধাজ্ঞা নয়, অতিরিক্ত বাণিজ্যশুল্ক নয়, উল্টো কোনো আগাম শর্ত ছাড়াই পুতিনের সঙ্গে তিনি আলাস্কায় শীর্ষ বৈঠকে সম্মত হয়ে গেলেন। আলোচনার বিষয়—ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি। অথচ সেই বৈঠকে ইউক্রেনের কোনো প্রতিনিধি নেই। নিউইয়র্ক টাইমস টিপ্পনী কেটে বলেছে, পুরো ব্যাপারটাই দুই পরাশক্তির মধ্যে আপসে দুনিয়া ভাগাভাগির মতো, ঠিক যেভাবে একসময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে দুই-তিনটি ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল।

ট্রাম্প অবশ্য আশ্বাস দিয়েছিলেন, ইউক্রেনের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো চুক্তি হবে না। আলাস্কাতেই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ডেকে এনে ত্রিমুখী বৈঠক হবে, এমন কথাও বলেছিলেন। তা হয়নি, সম্ভবত পুতিনের অনাগ্রহেই জেলেনস্কির নাম বাদ যায়। তবে নিজের দুই সহকারী—বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে সঙ্গে নিয়ে পুতিনের দুই সহকারীর সঙ্গে মুখোমুখি বসেছিলেন ট্রাম্প। মাঝখানে কোনো টেবিল নেই, মুখোমুখি তিনখানা করে চেয়ার বিছিয়ে বৈঠক। ট্রাম্প হয়তো বিশ্বাস করতেন, তিনি একবার যদি পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে বসতে পারেন, তাহলে যুদ্ধবিরতিতে তাঁকে সম্মত করাতে সক্ষম হবেন। এর আগে একই কথা বলেছিলেন উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং-উন সম্বন্ধে। সেখানে চিড়ে ভেজেনি। একই ফলাফল পুতিনের সঙ্গে বৈঠকেরও।

যাঁরা পুতিনকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, তাঁরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি আলাস্কার বৈঠকে আসেননি। এই মুহূর্তে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনারা স্বস্তিকর অবস্থায় আছেন। মস্কো বলছে, যুদ্ধে তারাই জিতছে। অতএব এই সময়ে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে পুতিন আলাস্কায় এসেছিলেন কেন?

ইউক্রেনে হামলার জন্য পুতিন বিশ্বের অধিকাংশ দেশে অনাহূত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সেই পুতিনকে ট্রাম্প এঙ্কোরেজের বিমানবন্দরে লালগালিচা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করলেন। শুধু তা–ই নয়, পুতিন বিমান থেকে নামতে না নামতে তিনি দূর থেকে হাততালি দেওয়া শুরু করলেন। এমন দৃশ্য আগে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প তাঁর সরকারি গাড়ি ‘বিস্ট’-এ পুতিনকে নিজের পাশে বসালেন। সেটাও অভিনব। সেখানে তাঁদের দুজনের একান্তে কী কথা হলো, আমরা জানি না। পুতিন ভালোই ইংরেজি জানেন। অনেকেই বলছেন, গাড়িতেই ট্রাম্পকে খুশি করার মতো যা বলার তিনি বলে দিয়েছেন।

ট্রাম্প বলেছিলেন, প্রথম দুই-চার মিনিটের মধ্যেই তিনি বুঝে যাবেন যুদ্ধবিরতি অর্জন সম্ভব হবে কি না। যদি দেখেন, না, কোনো আশা নেই; তাহলে নিজেই সভা থেকে বেরিয়ে যাবেন। তিন-চার মিনিট নয়, আড়াই ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি জানালেন, খুব ভালো আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনো ‘ডিল’ হয়নি। অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি অর্জিত হয়নি। এমনিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে ট্রাম্পকে থামানো কঠিন। কিন্তু এদিন ঘরভর্তি সাংবাদিক থাকলেও তাঁদের কারও কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়েই মঞ্চের পেছনে প্রস্থান করলেন।

আরও পড়ুনপুতিন যে দুই জায়গায় ট্রাম্পকে পাত্তা দেন না২৯ মে ২০২৫

যাঁরা পুতিনকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, তাঁরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি আলাস্কার বৈঠকে আসেননি। এই মুহূর্তে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনারা স্বস্তিকর অবস্থায় আছেন। মস্কো বলছে, যুদ্ধে তারাই জিতছে। অতএব এই সময়ে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে পুতিন আলাস্কায় এসেছিলেন কেন?

তিনি আসলে বিশ্বমঞ্চে আবার প্রবেশের এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। অন্য কেউ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁকে সমান মর্যাদা দিয়ে নিজ দেশে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছেন। এটাই তাঁর জন্য মস্ত কূটনৈতিক জয়। ট্রাম্প যাতে অতিরিক্ত শুল্ক না বসায় বা অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি না করে, সে জন্য কিছু বাড়তি সময় সংগ্রহ তাঁর অন্য উদ্দেশ্য।

পুতিনের অন্য বড় জয় ছিল, এই যুদ্ধ বন্ধে কী কী শর্ত রয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধ শুরুর ‘মূল কারণ’গুলোর সমাধান করতে হবে। এ জন্য যা করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ, তার ন্যাটো জোটে অংশগ্রহণ না করার নিশ্চয়তা এবং সেখানে নতুন নির্বাচন। অনুমান করা হচ্ছে, অপর যে শর্তটি তিনি ট্রাম্পকে জানিয়েছেন, তা হলো, এরই মধ্যে পূর্বাঞ্চলের যে এলাকাগুলো মস্কো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, রাশিয়ার সীমানা হিসেবে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

আরও পড়ুনপুতিন এখন কেন আগের চেয়েও শক্তিশালী২৬ মে ২০২৪

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ট্রাম্প নিজেই ইউক্রেনের দখলকৃত এলাকা রাশিয়ার দখলে রাখার ব্যাপারে নিজের সম্মতির কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, যুদ্ধরত দুই দেশকে একে অপরের সঙ্গে জায়গা বদল করে নিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ জমি নিজের দখলে নিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বড়জোর ৪ শতাংশ ইউক্রেনের জমি। তাহলে একে অপরের সঙ্গে কী বদলাবদলি হবে?

ইউক্রেনের শাসনতন্ত্রে বলা আছে, কোনো অবস্থাতেই দেশের কোনো জমি অন্যের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। জেলেনস্কিও মুখে বলেছেন, ইউক্রেনের ‘দ্বিতীয় দেশভাগ’ মেনে নেওয়া হবে না। ইউক্রেনের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো শান্তিচুক্তি হবে না, জেলেনস্কি সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন।

ইউক্রেনে যুদ্ধ থামুক, তা যে শর্তেই হোক, এটা সম্ভবত ট্রাম্প চান। তিনি আশায় আছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি অর্জন সম্ভব হলে তিনি নির্ঘাত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাবেন। এরই মধ্যে ইসরায়েল, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সরকার তাঁকে মনোনয়ন দিয়ে নোবেল কমিটির কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। ট্রাম্প নিজেও এখানে–সেখানে ফোন করে নিজের হয়ে লবিং করেছেন। সম্প্রতি জানা গেছে, নরওয়ের অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে নোবেল পুরস্কারের বিষয়ে কথা বলেছেন।

হাসান ফেরদৌস লেখক ও প্রাবন্ধিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র আল স ক য় বল ছ ল ন

এছাড়াও পড়ুন:

জাবিতে ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ‘কনজ্যুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ (সিওয়াইবি)' এর উদ্যোগে ভোক্তা অধিকার বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এছাড়া সেমিনারে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের জন্য খাদ্য অধিকার আইন, সিভি রাইটিং ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত সেশন আয়োজন করা হয়।

শনিবার (১৬ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে উক্ত সেশনটি অনুষ্ঠিত হয়।

আরো পড়ুন:

জাবিতে পোষ্য কোটা বহাল, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

জাবিতে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু ২১ সেপ্টেম্বর

এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ, সহকারী প্রক্টর ও ১৬ নম্বর ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ শামীমা নাসরিন জলী, সহকারী প্রক্টর ও ১০ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল রকিব, মীর মশাররফ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, সিওয়াইবি জাবি শাখার সভাপতি জিএম তাজমুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক হোসনী মোবারক, সাবেক সভাপতি মো. আরিফ সেনা, ইখতিয়ার মাহমুদ ও মো. নাঈম ইসলাম।

প্রাধ্যক্ষ শামীমা নাসরিন জলী বলেন, “অসৎ ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে খাদ্যে ভেজাল দিবে কিন্তু আমাদেরও উচিত এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে ছেলে-মেয়েরা অল্পতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলছে। এজন্য পরিমিত খাদ্য, অনর্থক খাবারে ভুল না ধরা, সঠিক সময়ে ঘুমানো ও কাচা ফল খাওয়া প্রয়োজন।”

প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল রকিব বলেন, “আমরা সচেতনভাবেই নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য খাদ্যে ক্ষতিকর ভেজাল দেই, যা আমাদের উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সিওয়াইবি জাবি শাখা ক্যাম্পাসের ভেতরে ভেজালমুক্ত খাদ্য ও নির্ধারিত মূল্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেন। যখন যেখানে আমাদের সহযোগিতা কামনা করেন, তখন সেখানেই আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি‌।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ বলেন, “আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে নির্দিষ্ট সময় ঘুম ও স্বাস্থ্যকর খাবার প্রয়োজন। ক্যাম্পাসের ১৩ হাজার শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব এবং আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।আশা করি, সিওয়াইবি বিগত দিনের মতো শিক্ষার্থীদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে আরো সচেতন করবে এবং ভেজালমুক্ত খাদ্য ও নির্ধারিত মূল্য নিশ্চিতে আগামী দিনেও আমাদেরকে সহযোগিতা করবে।”

কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, “সিসিএস এর যাত্রা শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়। এখন বাংলাদেশের ৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৫০টি উপজেলায় আমাদের কমিটি আছে, যেখানে প্রায় ২ লাখ ভলান্টিয়ার রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের খাদ্য ভেজাল ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতন করে সামাজিক পরিবর্তন সাধন করা। সে লক্ষ্যেই সিসিএস ও এর যুব শাখা সিওয়াইবি কাজ করে যাচ্ছে।”

জাবি/আহসান/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ