বীর উত্তম মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন: একজন নিভৃত নায়কের বিদায়
Published: 17th, August 2025 GMT
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানায়ক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম) ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম সিএমএইচে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে অনেকটাই নিভৃতে চলে গেলেন একজন ‘নিভৃত নায়ক’ জিয়াউদ্দিন। এর সঙ্গে শেষ হলো একজন অসমসাহসী সেনা কর্মকর্তার জীবন, যাঁকে ঘিরে ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব, সেনাজীবনের কিংবদন্তি, সততা-সাহসিকতা-আত্মমর্যাদা-আপসহীনতার উদাহরণ, বিপ্লবের রোমান্টিকতা, রহস্যময়তা ও কিছু বিতর্ক।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের মধ্যম পহরচাঁদা গ্রামে ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউদ্দিন। ১৯৬২ সালের ২২ জুলাই তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির (পিএমএ) ২৫তম পিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে ১ ইস্ট বেঙ্গল (খেমকরন সেক্টরে) অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। জিয়াউদ্দিন ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে তখন অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউদ্দিন পরবর্তী সময়ে (১৯৬৭-৬৯) পিএমএর প্রশিক্ষক বা ‘প্লাটুন কমান্ডার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা ছিল বাঙালি অফিসারদের মধ্যে বিরল কৃতিত্ব। উল্লেখ্য, এই সময় মেজর জিয়াউর রহমানও (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, বীর উত্তম, সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট) সগৌরবে পিএমএতে প্রশিক্ষক বা প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে জিয়াউদ্দিন রাওয়ালপিন্ডির সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টারের ‘মিলিটারি সেক্রেটারিয়েট’ শাখায় কর্মরত ছিলেন।
জেনারেল এম এ জি ওসমানী স্নেহভরে জিয়াউদ্দিনকে ‘দালাই লামা’ বলে ডাকতেন। এভাবে জিয়াউদ্দিন তাঁর পেশাগত দক্ষতা, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, ক্যারিশমা ও সাহসের ফলে অল্প বয়সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন আলোচিত সামরিক কর্মকর্তায় পরিণত হয়েছিলেন। তাঁকে ঘিরে সেই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কিছু লিজেন্ড, মিথও প্রচলিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনে জিয়াউদ্দিন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই মেজর আবু তাহের (পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল), মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল) ও ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারীর (পরে কর্নেল) সঙ্গে গোপনে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে শিয়ালকোট হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন জিয়াউদ্দিন। এ যাত্রা ছিল যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি রোমাঞ্চকর।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে সে এক অদ্ভুত ও অস্থির সময়। একদিকে নতুন দেশ গড়ার অযুত স্বপ্ন, অন্যদিকে ভারতীয় আধিপত্যের মেঘ, নৈরাজ্য, রক্ষী বাহিনী গঠন, শাসক দলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড, হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার...। সমাজের এই অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও হতাশা জিয়াউদ্দিনকেও স্পর্শ করেছিল।
এরপর তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্সের অধীন থাকা প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় জিয়াউদ্দিনকে। কামালপুরের দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধ, শ্রীমঙ্গলের কেজুরিছড়া ঘাঁটি, ফুলতলা ঘাঁটি, ধলই বিওপি, আটগ্রাম, কানাইঘাট এবং শেষে সিলেটের এমসি কলেজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীকে ধরাশায়ী করে সিলেটের উপকণ্ঠে পৌঁছান। তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। উল্লেখ্য, ১ ইস্ট বেঙ্গলের সাহসী সৈনিক ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান’ ধলই বিওপির যুদ্ধে শহীদ হন।
স্বাধীনতার পর ১ ইস্ট বেঙ্গল সিলেট থেকে ঢাকা সেনানিবাসে চলে আসে। কিছুদিন পর জিয়াউদ্দিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং ১৯৭২ সালের এপ্রিলে ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) নিয়োজিত হন। মার্চ মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে জিয়াউদ্দিন তাঁকে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়েছিলেন। ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিমানবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল সেনার বিদ্রোহ দমন করেন এবং যুদ্ধোত্তর সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রশিক্ষণে গঠিত অস্থায়ী ‘ব্যাটেল স্কুল’ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে সে এক অদ্ভুত ও অস্থির সময়। একদিকে নতুন দেশ গড়ার অযুত স্বপ্ন, অন্যদিকে ভারতীয় আধিপত্যের মেঘ, নৈরাজ্য, রক্ষী বাহিনী গঠন, শাসক দলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড, হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার...। সমাজের এই অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও হতাশা জিয়াউদ্দিনকেও স্পর্শ করেছিল।
১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি’ শিরোনামে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি সই করেন। সে সময় অনেকে এ চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী মনে করতেন। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন জিয়াউদ্দিন।
১৯৭২ সালের ২০ আগস্টে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় ‘হিডেন প্রাইজ’ (লুকানো মূল্য) নামে তাঁর একটা লেখা ছাপা হলে জিয়াউদ্দিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন, যেখানে তিনি তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণ ও ভারতের সঙ্গে ‘গোপন চুক্তির’ বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনা করেন। এ লেখা প্রকাশের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে ডেকে পাঠান এবং ক্ষমা চাইতে বলেন। জিয়াউদ্দিন সরাসরি এমন প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পরে এ জন্য জিয়াউদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাকরি হারানোর পর জিয়াউদ্দিন আত্মগোপনে চলে যান। শুরু হয় তাঁর গোপন বিপ্লবী জীবন।
১৯৭৩ সালে জিয়াউদ্দিন আত্মগোপনে গিয়ে সিরাজ সিকদারের ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে’ যোগ দেন এবং সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নানা ঘটনার পরে সিরাজ সিকদার নিহত হলে সর্বহারা পার্টি দুই ভাগ হয়। কর্নেল জিয়াউদ্দিন তখন একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
জিয়াউদ্দিনের গোপন বিপ্লবী জীবনের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম (বান্দরবান) ও তৎসংলগ্ন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জেলার পূর্বাংশে বিস্তৃত ছিল। সর্বহারা পার্টির অনেক সদস্য ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্য-পাহাড়বেষ্টিত দুর্গম অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে পাহাড়ে সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ড্রাগন ড্রাইভ’ পরিচালনা করেছিল। জিয়াউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কমান্ডার। অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কাজ করছিল। পাহাড়ে এ ধরনের পরিস্থিতি পরেও হয়েছে।
দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে জিয়াউদ্দিন ১৯৮৯ সালে সর্বহারা পার্টি ত্যাগ করে সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। তাঁর চিন্তাভাবনায় বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান (১৯৯৩-৯৬) নিযুক্ত করেন। চট্টগ্রাম শহরের ‘মাস্টার প্ল্যান’ তাঁর সময়ই তৈরি হয়েছিল। জিয়াউদ্দিন উন্নত ও সুন্দর একটি মহানগরীর স্বপ্ন দেখতেন।
সরাসরি রাজনীতিতে আবারও যোগদানের নানা সুযোগ থাকলেও জিয়াউদ্দিন তা করেননি। তবে নানা সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে স্পষ্টভাষী অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৎ জীবন যাপন করতেন এবং কঠিন নীতিমান ছিলেন। জিয়াউদ্দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর জাহানারা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বলা যায়, মমতাময়ী ও ধৈর্যশীল এই নারী হয়ে ওঠেন জিয়াউদ্দিনের জীবনে আল্লাহর পাঠানো একটি শ্রেষ্ঠ উপহার। তাঁদের দুই ছেলে এক মেয়ে।
জিয়াউদ্দিন ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই স্কুলটি চট্টগ্রাম মহানগরীর অন্যতম সেরা স্কুলে পরিণত হয়। তিনি এই স্কুলে উন্নত মানের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভালো মানুষ হওয়ার বিষয় ও নৈতিকতার উৎস হিসেবে ধর্মের গুরুত্ব দিতেন।
৭ আগস্ট বিকেলে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সামরিক কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় জিয়াউদ্দিনের দাফনের আয়োজন করা হয়। মরদেহ কবরে নামানো ও দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর ১৮ বীরের চৌকস একটি সেনাদল কর্তৃক ‘ভলি ফায়ার’ (গান স্যালুট) প্রদান করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের পক্ষে স্থানীয় জিওসি ও এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মীর মুশফিকুর রহমান কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর সেনাবাহিনী সম্মান গার্ড মরণোত্তর সালাম (আর্মস ডাউন) প্রদান করে। বিউগলের করুন সুরে এভাবেই জিয়াউদ্দিনকে শেষবিদায় জানানো হয়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে চরম নৈতিক অধঃপতন হয়েছে। আমি ভাবি, ভোগবাদিতা ও আত্মসর্বস্বতায় মগ্ন এই সমাজে কীভাবে জিয়াউদ্দিন এত সাহসী, নির্মোহ, নির্লোভ, আপসহীন ও প্রতিবাদী থাকতে পেরেছিলেন?
১৯৭১ সালে দেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য চরম ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুবক জিয়াউদ্দিন। এই অকুতোভয় বীরযোদ্ধা আমাদের স্মৃতিতে চির অম্লান হয়ে রইবেন। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সম্মান ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বিভিন্ন কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জিয়াউদ্দিনের মতো সাহসী, আপসহীন, দেশপ্রেমিক ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বীরদেরই খুঁজে নেবে অবলীলায়। স্যালুট টু ইউ জিয়াউদ্দিন স্যার। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
মো. বায়েজিদ সরোয়ার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ য় উদ দ ন র ন জ য় উদ দ ন কর ন ল জ য় কম ন ড র উদ দ ন ত স ব ধ নত তৎক ল ন র রহম ন ন কর ন কর ছ ল ঙ গল র র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
সংবেদনশীল না হলে কেউ ভালো শিল্পী হতে পারে না: জুয়েল আইচ
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো ‘লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় একাদশতম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘শিল্প, মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতার সংমিশ্রণে গঠিত এক অনন্য লিগ্যাসি’।
‘মানুষ তার আশার সমান সুন্দর, বিশ্বাসের সমান বড় এবং কাজের সমান সফল। কাজই মুক্তি। তবে আশাও বড় রাখতে হবে। আশা না থাকলে কাজ হবে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেন জুয়েল আইচ। পডকাস্ট শোর এ পর্ব প্রচারিত হয় গতকাল শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
পডকাস্টের শুরুতেই সঞ্চালক জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে প্রথম যেদিন জাদু দেখালেন, সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সব বাদ দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিই। আমরাই খুব সম্ভবত প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করি। আমি শৈশব থেকেই জাদু দেখাই। তবে মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীশিবিরে জাদু দেখানোর সেই অনুভূতিটি ছিল একেবারেই ম্যাজিক্যাল।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, শিল্পকে সাহস করে অস্ত্রতে পরিণত করার এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এল?
জুয়েল আইচ বলেন, ‘এটা আত্মবিশ্বাস নয়। আমি অসম্মান সহ্য করতে পারি না। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছিলাম, তারা (পাকিস্তান) আমাদের বিভিন্নভাবে অসম্মান করে আসছে। কখনো গানে, কখনো ছবি এঁকে কিংবা কবিতার ভাষায় আমরা সব সময় এর প্রতিবাদ করে এসেছি। এভাবে করেই শেষ পর্যন্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধে নেমে গেলাম।’
জুয়েল আইচকে কেউ বলেন ম্যাজিশিয়ান, আবার কেউ বলেন মিউজিশিয়ান। তবে জুয়েল আইচ একজন দার্শনিকও বটে। জাদুর মোহনীয়তা আর বাস্তবতার যে রূঢ় চিত্র—এই দুটো আপনার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে জুয়েল আইচ বলেন, ‘বাস্তবতাকে আমরা বলে থাকি “কঠিন” আর স্বপ্ন তো আমরা আকাশসমান ভাবতে পারি। একদম রংধনুর মতো সাত রং। এই দুটোকে যদি কেউ আয়ত্ত না করতে পারে, তবে তার জীবন কিন্তু সেখানেই শেষ। সে বেঁচে থাকবে কিন্তু মরার মতো।’ তিনি বলেন, ‘সে জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দরকার। যেমন আপনি কোনোভাবেই আমাকে দুঃখী বানাতে পারবেন না। আমি দুঃখ পাই না, তবে বারবার আমাকে খ্যাপাতে থাকলে আমি রুখে দাঁড়াই।’
জুয়েল আইচ কখনোই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া স্টেজে ওঠেন না। সঞ্চালক জানতে চান, এর পেছনে কারণ কী?
জুয়েল আইচ বলেন, প্রস্তুতি ছাড়া কোনো কাজ সুন্দরমতো হয় না। প্রস্তুতি ছাড়া যদি কেউ কিছু করে, তবে সেগুলো অনেক নিম্নমানের হবে। তিনি বলেন, ‘আমি একটি বাঁশি দিয়ে সব রাগ বাজাতে পারি। এটা কি এক দিনেই সম্ভব!’
আপনার পারফরম্যান্সের সময় আপনি মাঝেমধ্যে নিঃশব্দ হয়ে যান। যেখানে কোনো উদ্যম নেই। এই ‘সাইলেন্স’-এর কারণটা কী?
সঞ্চালক জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, শব্দের চেয়ে নিঃশব্দের ভাষা বেশি গভীর। একটি পেইন্টিং, যেখানে কোনো শব্দ থাকে না কিন্তু কত কিছু বলে দেয়! দেখবেন কেউ অনেক খেপে গেলে নীরব হয়ে যায়। আসলে শব্দে যা বলা যায়, নিঃশব্দে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব।
বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে সবকিছুই হাতের নাগালে, এমনকি জাদুও। জাদু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আসার পর এর আবেদন কিছুটা কমে যাচ্ছে কি না? জানতে চাইলে জুয়েল আইচ বলেন, খালি চোখে দেখলে তা আসলেই কমে যাচ্ছে। কারণ, এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে যে জাদুগুলো দেখানো হচ্ছে, তা দেখে মানুষ বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘তারা ভাবছে, আমরা আগে যেসব জাদু দেখেছি, এগুলো তো তার থেকেও বিস্ময়কর। কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারছে না, এখন সবকিছুর সঙ্গে মিশে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’
সঞ্চালক এরপর প্রশ্ন করেন, আপনি একসময় ‘পালস স্টপিং’ ধরনের ইলিউশন বন্ধ করেছিলেন। এর পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল?
জুয়েল আইচ বলেন, ‘এই পালস স্টপিংয়ের মাধ্যমে আমি পুরো দেশজুড়ে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলাম। দলে দলে মানুষ এটি দেখতে আসত। কিন্তু এসব দেখে মানুষ অনেক বেশি আতঙ্কিত হতো, অনেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ত। একবার একজন অনেক বড় পালোয়ান এটি দেখতে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সেদিন শো শেষ করেই আমি আমার টিমকে বলি, এই ম্যাজিক আর হবে না। কারণ, এই ম্যাজিক এত এত মানুষকে ডেকে আনছে বটে কিন্তু এটি মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে। যা মোটেও ঠিক নয়।’
প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক জানতে চান, তাহলে কি একজন শিল্পীকে সংবেদনশীলও হতে হয়?
‘অবশ্যই।’ জুয়েল আইচ বলেন, একজন শিল্পীকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। সংবেদনশীল না হলে তিনি ভালো শিল্পী হতে পারবেন না।
আপনি যেমন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের সামনে পারফর্ম করেছেন, তেমনি এমন শিশুদের জন্যও জাদু দেখিয়েছেন, যারা কখনো টিকিট কিনে শো দেখতে পারে না। আপনার চোখে আসল মর্যাদা কোথায়—বৃহৎ মঞ্চে, নাকি একটিমাত্র বিস্মিত মুখে?
সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল আইচ বলেন, ‘আসলে মঞ্চ ব্যাপার নয়। আমি আমার জাদুতে বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়ে থাকা দেখতে ভালোবাসি। শুধু বিস্ময় নয়, বিস্ময়ের সঙ্গে মুগ্ধতা আমার ভালো লাগে।’
আরও পড়ুননীতি আর মূল্যবোধ শক্ত থাকলে কেউ থামাতে পারবে না: রুবাবা দৌলা১২ অক্টোবর ২০২৫পডকাস্টের শেষ পর্যায়ে সঞ্চালক জানতে চান, আমরা আরেকজন জুয়েল আইচ কবে পাব?
মুচকি হেসে জুয়েল আইচ বলেন, ‘যখন সেই উদ্যম নিয়ে কেউ কাজ করবে, ঠিক তখন। সে হয়তো আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। শুধু ম্যাজিকে নয়, সব দিক দিয়েই।’
আরও পড়ুনবাবা প্রথমে আমাকে অফিস সহকারীর কাজ দিয়েছিলেন: হাতিলের চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান০৫ অক্টোবর ২০২৫