মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখায় সংস্কৃতির মূল্য
Published: 22nd, September 2025 GMT
যে জগৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ এবং যে জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য, সেই জগৎকেন্দ্রিক মানবজীবনের সাধনাই ইহজাগতিকতা। মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ইহজাগতিকতার প্রধান লক্ষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়েছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের আবির্ভাবের কারণে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার রেনেসাঁস বলে যে কালপর্ব চিহ্নিত হয়ে আছে, সেই কাল যুক্তিবাদী ও রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উত্তেজনায় পূর্ণ। তৎকালীন শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত মনীষীদের জাগরণ ও যুক্তির পক্ষে যেতে হয়েছিল গোঁড়া হিন্দুদের ধর্মীয় প্রাচীরকে ডিঙিয়েই। বাংলার মুসলমানদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। শতবর্ষ আগে ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ যুক্তিবর্জিত ধর্মমোহ ও কুসংস্কার। এ অঞ্চলে যুক্তিবাদের প্রসারে তাঁদের মুখপত্র শিখা হয়ে উঠেছিল এক অনন্য স্মারক। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’—এই ছিল শিখার মুখবাণী। বুদ্ধির মুক্তির মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের ইহাজাগতিক কল্যাণ ঘটানোই ছিল শিখাগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। পরিসর কিংবা প্রভাব যতই সীমিত হোক না কেন, এ অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রসারে শিখাগোষ্ঠীর অবদান অনস্বীকার্য। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়ে যাঁরা যৌক্তিক ও প্রেরণাসঞ্চারী বক্তব্যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকে বিস্তৃত করেছিলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁদের অন্যতম।
শতবর্ষ আগে ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ যুক্তিবর্জিত ধর্মমোহ ও কুসংস্কার। এ অঞ্চলে যুক্তিবাদের প্রসারে তাঁদের মুখপত্র শিখা হয়ে উঠেছিল এক অনন্য স্মারক।মোতাহের হোসেন চৌধুরী সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। কিছু গানও তিনি রচনা করেন। এসব কবিতা ও গানে এক সৌন্দর্যপিপাসু ও প্রেমিক হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন সংস্কৃতি কথা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। অন্নদাশঙ্কর রায় এ বইকে বাংলা ভাষায় একটি ‘বাতিঘর’ হিসেবে অভিহিত করেন। মোতাহের হোসেনের মতে, ‘এ জীবনে যা না হলে আমরা বাঁচি না, তা–ই আমাদের সভ্যতা, আর যার জন্য বাঁচি তাই সংস্কৃতি।’ এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ক্লাইভ বেলের সিভিলাইজেশন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস বই দুটির বাংলা অনুবাদ করেন।
রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য উদার মানবতাবাদ, সৌন্দর্যপ্রীতি, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ। মোতাহের হোসেনের চিন্তাবিশ্বে এসব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন মনীষীর রচনা তাঁর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সদ্য প্রয়াত প্রাবন্ধিক ও লেখক যতীন সরকারের ভাষায়, ‘শিখাগোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের মতো মোতাহের হোসেন চৌধুরীও ছিলেন প্রমথ চৌধুরী–অনুরাগী। প্রমথ চৌধুরীর বৈদগ্ধ্য ও মুক্তবুদ্ধি তাঁর চেতনাকে যেমন গভীরভাবে আলোকিত করেছিল, প্রমথ চৌধুরীর রচনারীতির প্রভাবও তাঁর ওপর তেমনভাবেই পড়েছিল। ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রান্ড রাসেলের চিন্তাধারা তাঁর মনমানসে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে তিনি আহরণ করেছিলেন উদার বিশ্ববোধ ও সৌন্দর্যচেতনা। কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িকতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল।’
রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য উদার মানবতাবাদ, সৌন্দর্যপ্রীতি, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ। মোতাহের হোসেনের চিন্তাবিশ্বে এসব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন মনীষীর রচনা তাঁর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।রেনেসাঁসের মধ্যে মোতাহের হোসেন সংস্কৃতিমনস্ক মানবতাবাদের বিকাশ লক্ষ করেন। তাঁর চিন্তাচর্চার ভরকেন্দ্র ছিল সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সাধনাকে তিনি মনুষ্যত্বের সাধনা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ইহজাগতিকতা, সৌন্দর্য, আনন্দ, প্রেম সর্বোপরি সংস্কৃতি ছিল তাঁর চির আরাধ্য বিষয়। তিনি যেমন সৌন্দর্যপ্রেমিক ও ইহাজাগতিক, তেমনি প্রেমময়, আনন্দপূর্ণ জীবনের অনুরাগী ও সংস্কৃতিমান। রেনেসাঁসের প্রতি অনুরাগের জন্যই যুক্তির প্রতি তাঁর ছিল আন্তরিক নিষ্ঠা। যুক্তির অনুবর্তিতা তাঁর বক্তব্যকে অধিক প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য তিনি দেখেননি। মূল্যবোধকে যাচাই করে নেওয়ার পদ্ধতিই তাঁর কাছে যুক্তিবিচার। যুক্তিবিচারের আলোকে তিনি নিজের মননকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ‘যুক্তিবিচার অথবা বুদ্ধির শান্ত আলোকেই আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি, আবেগের উসকানিতে নয়। বুদ্ধিই বলে, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েই আমাদের আনন্দ, আলাদা হয়ে নয়। আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহতা বুদ্ধির ইঙ্গিতে উপলব্ধি হয়।’
যুক্তিবাদের সঙ্গে অচ্ছেদ্যরূপে যুক্ত বিজ্ঞানমনস্কতা। বিজ্ঞানবিমুখতা মানুষকে অতীতচারী করে জন্মসূত্রে অর্জিত সম্পদ ও বিশ্বাস নিয়ে তৃপ্ত থাকতে প্ররোচিত করে। তাই বিজ্ঞানবিমুখতা মানুষের অগ্রগামিতার পক্ষে প্রধান প্রতিবন্ধক এবং আলোর পরিবর্তে অন্ধকারের দিকেই তার পক্ষপাত। যুক্তিবাদী মোতাহের হোসেন চৌধুরী খুব সহজেই মানব বিকাশের অন্যতম শর্ত বিজ্ঞানমনস্কতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। প্রগতি ও পশ্চাৎপদতা একসঙ্গে চলতে পারে না। তাই তাঁর চেতনায় ধরা পড়েছে—
‘পিতৃপুরুষের দেশ ঠিক আমাদের দেশ নয়, আমাদের দেশ নিজেদের সৃষ্টি করে নিতে হবে। সে জন্য অন্ধকার দেওয়াল ভেঙ্গে মানুষে মানুষে মিলনের পথ খোলাসা করা দরকার এবং সর্বপ্রকার অভিমান ত্যাগ করে বিজ্ঞানাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন।’
যুক্তিবাদী তথা বিজ্ঞানাশ্রয়ী চেতনা মোতাহের হোসেন চৌধুরী আজীবন লালন করেছেন। তাঁর খুব কাছের মানুষদের একজন আবুল ফজল ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী স্মরণে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মোতাহের যুক্তিবাদী ছিলেন। ইংরেজিতে যাকে র্যাশনালিজম বলে, তিনি ছিলেন তার ভক্ত ও অনুসারী। তখনকার দিনে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ বুদ্ধির মুক্তি তথা যুক্তিবাদ প্রচারে অগ্রণী হন। তাই সহজেই সাহিত্য সমাজের কর্মীদের সঙ্গে মোতাহেরের এক আত্মিক সংযোগ স্থাপিত হয়।’ কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্য নেতাদের সংস্পর্শে মোতাহের হোসেন মননশীল প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ১৯৩১, ১৯৩২ ও ১৯৩৪ সালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সমাজের তিনটি অধিবেশনে তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন: ‘আমাদের দৈন্য’, ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী’ এবং ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা’। শিখা পত্রিকায় তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৈরাগ্যবিলাস’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
যুক্তিবিচার অথবা বুদ্ধির শান্ত আলোকেই আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি, আবেগের উসকানিতে নয়। বুদ্ধিই বলে, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েই আমাদের আনন্দ, আলাদা হয়ে নয়। আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহতা বুদ্ধির ইঙ্গিতে উপলব্ধি হয়।মোতাহের হোসেন চৌধুরীসমাজ নয়, ব্যক্তিই মোতাহের হোসেন চৌধুরীর আরাধ্য। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবল চেতনা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে এবং তাঁর জীবনদর্শন ছিল উদার মানবতাবাদ। সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যটি তো প্রবাদতুল্য খ্যাতি লাভ করেছে—‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে মহৎভাবে বাঁচা;.
এই সংস্কৃতি ব্যাখ্যার মধ্যে শুধু সৌন্দর্য নয়, জীবনসংগ্রামেরও ইঙ্গিত রয়েছে। অথচ সংগ্রাম বা বিপ্লবী দর্শনের প্রতি তাঁর কোনো অনুরাগ ছিল না। ধর্মের মতো মতবাদকেও তিনি ব্যক্তির বিকাশের পরিপন্থী মনে করতেন। কারণ, ‘ধর্মের মতো মতবাদও মনের জগতে লেফট–রাইট করতে শেখায়।’ তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত-মার্জিত লোকের ধর্ম।’ তাঁর দৃষ্টিতে ধর্মের চেয়ে কালচার বড় ও মহৎ। ধর্ম ব্যক্তিকে বিকশিত করে তুলতে চায় না, বিকাশকে বড় করে দেখে না বলেই ধর্ম ইন্দ্রিয়সাধনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তির বিকাশের জন্য তিনি কালচারের সাধনার তাগিদ দিয়েছেন।
শ্রেণিবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামকে তিনি সংস্কৃতিচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। মোতাহের হোসেন চৌধুরী সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই তিনি বুঝতেন, সমাজের প্রত্যেক মানুষের ন্যূনতম জীবনযাত্রা ও অন্নসংস্থান নিশ্চিত করা ছাড়া মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা কিংবা কালচার্ড হওয়ার সাধনা অসম্ভব। ‘কালচার সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক’ এ কথা বলে তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি। আরও বলেছেন, ‘নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো—এ-ই কালচারের আদেশ এবং এই আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র তার কাছে লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ।’
শিক্ষা সম্পর্কে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বক্তব্য চিন্তা–উদ্দীপক। মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করে জীবসত্তাকে সেই ঘরের নিচের তলা এবং মানবসত্তা বা মনুষ্যত্বকে ওপরতলা হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিক্ষার আসল কাজ যে মূল্যবোধ সৃষ্টি, সে কথা জোর দিয়ে বলেছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীই সম্ভবত একমাত্র লেখক, যিনি লেখাকে জীবনের প্রার্থনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সাহিত্যচর্চাকে তিনি অর্থোপার্জনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবিকাকে জীবনের চেয়ে বড় করে তুললে জীবনের ‘সূক্ষ্মচেতনাটিই’ নষ্ট হয়ে যায়, যে ‘সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা।’ প্রাবন্ধিক ও গবেষক আনিসুজ্জামান মনে করেন, ‘তাঁর (মোতাহের হোসেন চৌধুরী) আদর্শ সমাজ সব সময়েই ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ফসল—সে সমাজে জীবনপ্রীতির গভীরতা আছে, সৌন্দর্যকল্পনার অবারিত সুযোগ আছে, বিচারবুদ্ধির অব্যাহত অনুশীলন আছে, হৃদয়ধর্মের স্বীকৃতি আছে, মুক্তবুদ্ধির সাধনা আছে।’
নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা। হিন্দুর ঐতিহ্যে নজরুল তথা মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে, কিন্তু মুসলমানের ঐতিহ্যে রবীন্দ্রনাথের তথা হিন্দুর উত্তরাধিকার নেই।মোতাহের হোসেন চৌধুরীমোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রতিটি রচনায় রেনেসাঁস চেতনার উজ্জ্বল ছাপ লক্ষণীয়। তবে ‘রেনেসাঁস: গোড়ার কথা ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রবন্ধে তাঁর রেনেসাঁস ভাবনার সবচেয়ে নান্দনিক প্রকাশ ঘটেছে। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘রেনেসাঁস কথাটার শব্দগত অর্থ পুনর্জন্ম, অর্থাৎ পুরাতনে ফিরে যাওয়া, অথবা পুরাতনকে ফিরে পাওয়া; কিন্তু ভাবগত অর্থ নবজন্ম, মানে মানবমহিমা তথা বুদ্ধি ও কল্পনার পুনঃ প্রতিষ্ঠা। রেনেসাঁসের ইতিহাস তাই জীবন-সূর্যের পুনরোদয়ের ইতিহাস—বুদ্ধি ও কল্পনার জয়যাত্রার ইতিহাস।’
মোতাহের হোসেন সচেতন ছিলেন যে পুরাতনে ফিরে যাওয়াই রেনেসাঁস নয়, জীবনপ্রীতি তথা বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনাপ্রীতিই রেনেসাঁস। তিনি যথার্থই বলেছেন, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ মানবমহিমারই কাব্য। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পটভূমিতে তাঁর বিশ্লেষণ অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত:
‘নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা। হিন্দুর ঐতিহ্যে নজরুল তথা মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে, কিন্তু মুসলমানের ঐতিহ্যে রবীন্দ্রনাথের তথা হিন্দুর উত্তরাধিকার নেই। প্রাণের যোগ নেই বলে বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য, কিন্তু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি একপ্রকার জলবায়ুর মতোই সহজ।’
মুসলিম সাহিত্য সমাজের চিন্তকদের মধ্যে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রেনেসাঁস চেতনা ছিল খুব স্পষ্ট ও সাহসী। উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা যে রেনেসাঁসের শত্রু, তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘রেনেসাঁসে বড় হয়ে উঠেছিল যে জীবন—পরকালমুখী ধর্মসাধনা নয়, ইহকালমুখী জীবনসাধনা, মানে জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের প্রয়াস, সাহিত্য সমাজেরও লক্ষ্য ছিল তা–ই।’ নানা প্রতিকূলতার কারণে সে লক্ষ্য পূর্ণতা পায়নি। এ সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন—‘মুসলিম সমাজে যদি কখনো সত্যিকারের রেনেসাঁসের আবির্ভাব হয়, তবে উপলব্ধ হবে যে তার প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেছিল “মুসলিম সাহিত্য সমাজ”।’
১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের শতবর্ষ পূর্তির প্রাক্কালে ‘সত্যিকারের রেনেসাঁসের’ স্বপ্ন দেখা কি দুরাশা?
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম নবত ব দ ম সলম ন র ত কর ছ ল কর ছ ল ন স ন দর য আম দ র দ প রবন ধ উপলব ধ র অন য অন র গ র জন য জ বন র জ গত ক আনন দ নজর ল
এছাড়াও পড়ুন:
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখায় সংস্কৃতির মূল্য
যে জগৎ জীবন ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ এবং যে জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য, সেই জগৎকেন্দ্রিক মানবজীবনের সাধনাই ইহজাগতিকতা। মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ইহজাগতিকতার প্রধান লক্ষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়েছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের আবির্ভাবের কারণে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার রেনেসাঁস বলে যে কালপর্ব চিহ্নিত হয়ে আছে, সেই কাল যুক্তিবাদী ও রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উত্তেজনায় পূর্ণ। তৎকালীন শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত মনীষীদের জাগরণ ও যুক্তির পক্ষে যেতে হয়েছিল গোঁড়া হিন্দুদের ধর্মীয় প্রাচীরকে ডিঙিয়েই। বাংলার মুসলমানদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। শতবর্ষ আগে ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ যুক্তিবর্জিত ধর্মমোহ ও কুসংস্কার। এ অঞ্চলে যুক্তিবাদের প্রসারে তাঁদের মুখপত্র শিখা হয়ে উঠেছিল এক অনন্য স্মারক। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’—এই ছিল শিখার মুখবাণী। বুদ্ধির মুক্তির মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের ইহাজাগতিক কল্যাণ ঘটানোই ছিল শিখাগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। পরিসর কিংবা প্রভাব যতই সীমিত হোক না কেন, এ অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রসারে শিখাগোষ্ঠীর অবদান অনস্বীকার্য। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়ে যাঁরা যৌক্তিক ও প্রেরণাসঞ্চারী বক্তব্যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকে বিস্তৃত করেছিলেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁদের অন্যতম।
শতবর্ষ আগে ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ যুক্তিবর্জিত ধর্মমোহ ও কুসংস্কার। এ অঞ্চলে যুক্তিবাদের প্রসারে তাঁদের মুখপত্র শিখা হয়ে উঠেছিল এক অনন্য স্মারক।মোতাহের হোসেন চৌধুরী সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। কিছু গানও তিনি রচনা করেন। এসব কবিতা ও গানে এক সৌন্দর্যপিপাসু ও প্রেমিক হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন সংস্কৃতি কথা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। অন্নদাশঙ্কর রায় এ বইকে বাংলা ভাষায় একটি ‘বাতিঘর’ হিসেবে অভিহিত করেন। মোতাহের হোসেনের মতে, ‘এ জীবনে যা না হলে আমরা বাঁচি না, তা–ই আমাদের সভ্যতা, আর যার জন্য বাঁচি তাই সংস্কৃতি।’ এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ক্লাইভ বেলের সিভিলাইজেশন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস বই দুটির বাংলা অনুবাদ করেন।
রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য উদার মানবতাবাদ, সৌন্দর্যপ্রীতি, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ। মোতাহের হোসেনের চিন্তাবিশ্বে এসব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন মনীষীর রচনা তাঁর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সদ্য প্রয়াত প্রাবন্ধিক ও লেখক যতীন সরকারের ভাষায়, ‘শিখাগোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের মতো মোতাহের হোসেন চৌধুরীও ছিলেন প্রমথ চৌধুরী–অনুরাগী। প্রমথ চৌধুরীর বৈদগ্ধ্য ও মুক্তবুদ্ধি তাঁর চেতনাকে যেমন গভীরভাবে আলোকিত করেছিল, প্রমথ চৌধুরীর রচনারীতির প্রভাবও তাঁর ওপর তেমনভাবেই পড়েছিল। ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রান্ড রাসেলের চিন্তাধারা তাঁর মনমানসে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে তিনি আহরণ করেছিলেন উদার বিশ্ববোধ ও সৌন্দর্যচেতনা। কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িকতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল।’
রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য উদার মানবতাবাদ, সৌন্দর্যপ্রীতি, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ। মোতাহের হোসেনের চিন্তাবিশ্বে এসব বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন মনীষীর রচনা তাঁর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।রেনেসাঁসের মধ্যে মোতাহের হোসেন সংস্কৃতিমনস্ক মানবতাবাদের বিকাশ লক্ষ করেন। তাঁর চিন্তাচর্চার ভরকেন্দ্র ছিল সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সাধনাকে তিনি মনুষ্যত্বের সাধনা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ইহজাগতিকতা, সৌন্দর্য, আনন্দ, প্রেম সর্বোপরি সংস্কৃতি ছিল তাঁর চির আরাধ্য বিষয়। তিনি যেমন সৌন্দর্যপ্রেমিক ও ইহাজাগতিক, তেমনি প্রেমময়, আনন্দপূর্ণ জীবনের অনুরাগী ও সংস্কৃতিমান। রেনেসাঁসের প্রতি অনুরাগের জন্যই যুক্তির প্রতি তাঁর ছিল আন্তরিক নিষ্ঠা। যুক্তির অনুবর্তিতা তাঁর বক্তব্যকে অধিক প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য তিনি দেখেননি। মূল্যবোধকে যাচাই করে নেওয়ার পদ্ধতিই তাঁর কাছে যুক্তিবিচার। যুক্তিবিচারের আলোকে তিনি নিজের মননকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ‘যুক্তিবিচার অথবা বুদ্ধির শান্ত আলোকেই আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি, আবেগের উসকানিতে নয়। বুদ্ধিই বলে, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েই আমাদের আনন্দ, আলাদা হয়ে নয়। আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহতা বুদ্ধির ইঙ্গিতে উপলব্ধি হয়।’
যুক্তিবাদের সঙ্গে অচ্ছেদ্যরূপে যুক্ত বিজ্ঞানমনস্কতা। বিজ্ঞানবিমুখতা মানুষকে অতীতচারী করে জন্মসূত্রে অর্জিত সম্পদ ও বিশ্বাস নিয়ে তৃপ্ত থাকতে প্ররোচিত করে। তাই বিজ্ঞানবিমুখতা মানুষের অগ্রগামিতার পক্ষে প্রধান প্রতিবন্ধক এবং আলোর পরিবর্তে অন্ধকারের দিকেই তার পক্ষপাত। যুক্তিবাদী মোতাহের হোসেন চৌধুরী খুব সহজেই মানব বিকাশের অন্যতম শর্ত বিজ্ঞানমনস্কতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। প্রগতি ও পশ্চাৎপদতা একসঙ্গে চলতে পারে না। তাই তাঁর চেতনায় ধরা পড়েছে—
‘পিতৃপুরুষের দেশ ঠিক আমাদের দেশ নয়, আমাদের দেশ নিজেদের সৃষ্টি করে নিতে হবে। সে জন্য অন্ধকার দেওয়াল ভেঙ্গে মানুষে মানুষে মিলনের পথ খোলাসা করা দরকার এবং সর্বপ্রকার অভিমান ত্যাগ করে বিজ্ঞানাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন।’
যুক্তিবাদী তথা বিজ্ঞানাশ্রয়ী চেতনা মোতাহের হোসেন চৌধুরী আজীবন লালন করেছেন। তাঁর খুব কাছের মানুষদের একজন আবুল ফজল ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী স্মরণে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মোতাহের যুক্তিবাদী ছিলেন। ইংরেজিতে যাকে র্যাশনালিজম বলে, তিনি ছিলেন তার ভক্ত ও অনুসারী। তখনকার দিনে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ বুদ্ধির মুক্তি তথা যুক্তিবাদ প্রচারে অগ্রণী হন। তাই সহজেই সাহিত্য সমাজের কর্মীদের সঙ্গে মোতাহেরের এক আত্মিক সংযোগ স্থাপিত হয়।’ কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্য নেতাদের সংস্পর্শে মোতাহের হোসেন মননশীল প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ১৯৩১, ১৯৩২ ও ১৯৩৪ সালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সমাজের তিনটি অধিবেশনে তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন: ‘আমাদের দৈন্য’, ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী’ এবং ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা’। শিখা পত্রিকায় তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৈরাগ্যবিলাস’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
যুক্তিবিচার অথবা বুদ্ধির শান্ত আলোকেই আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি, আবেগের উসকানিতে নয়। বুদ্ধিই বলে, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েই আমাদের আনন্দ, আলাদা হয়ে নয়। আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহতা বুদ্ধির ইঙ্গিতে উপলব্ধি হয়।মোতাহের হোসেন চৌধুরীসমাজ নয়, ব্যক্তিই মোতাহের হোসেন চৌধুরীর আরাধ্য। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবল চেতনা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে এবং তাঁর জীবনদর্শন ছিল উদার মানবতাবাদ। সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যটি তো প্রবাদতুল্য খ্যাতি লাভ করেছে—‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে মহৎভাবে বাঁচা;...প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা;...নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা;...বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা;... প্রচুরভাবে গভীরভাবে বাঁচা, বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।’
এই সংস্কৃতি ব্যাখ্যার মধ্যে শুধু সৌন্দর্য নয়, জীবনসংগ্রামেরও ইঙ্গিত রয়েছে। অথচ সংগ্রাম বা বিপ্লবী দর্শনের প্রতি তাঁর কোনো অনুরাগ ছিল না। ধর্মের মতো মতবাদকেও তিনি ব্যক্তির বিকাশের পরিপন্থী মনে করতেন। কারণ, ‘ধর্মের মতো মতবাদও মনের জগতে লেফট–রাইট করতে শেখায়।’ তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত-মার্জিত লোকের ধর্ম।’ তাঁর দৃষ্টিতে ধর্মের চেয়ে কালচার বড় ও মহৎ। ধর্ম ব্যক্তিকে বিকশিত করে তুলতে চায় না, বিকাশকে বড় করে দেখে না বলেই ধর্ম ইন্দ্রিয়সাধনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তির বিকাশের জন্য তিনি কালচারের সাধনার তাগিদ দিয়েছেন।
শ্রেণিবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামকে তিনি সংস্কৃতিচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। মোতাহের হোসেন চৌধুরী সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই তিনি বুঝতেন, সমাজের প্রত্যেক মানুষের ন্যূনতম জীবনযাত্রা ও অন্নসংস্থান নিশ্চিত করা ছাড়া মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা কিংবা কালচার্ড হওয়ার সাধনা অসম্ভব। ‘কালচার সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক’ এ কথা বলে তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি। আরও বলেছেন, ‘নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো—এ-ই কালচারের আদেশ এবং এই আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র তার কাছে লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ।’
শিক্ষা সম্পর্কে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বক্তব্য চিন্তা–উদ্দীপক। মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করে জীবসত্তাকে সেই ঘরের নিচের তলা এবং মানবসত্তা বা মনুষ্যত্বকে ওপরতলা হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিক্ষার আসল কাজ যে মূল্যবোধ সৃষ্টি, সে কথা জোর দিয়ে বলেছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীই সম্ভবত একমাত্র লেখক, যিনি লেখাকে জীবনের প্রার্থনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সাহিত্যচর্চাকে তিনি অর্থোপার্জনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবিকাকে জীবনের চেয়ে বড় করে তুললে জীবনের ‘সূক্ষ্মচেতনাটিই’ নষ্ট হয়ে যায়, যে ‘সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা।’ প্রাবন্ধিক ও গবেষক আনিসুজ্জামান মনে করেন, ‘তাঁর (মোতাহের হোসেন চৌধুরী) আদর্শ সমাজ সব সময়েই ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ফসল—সে সমাজে জীবনপ্রীতির গভীরতা আছে, সৌন্দর্যকল্পনার অবারিত সুযোগ আছে, বিচারবুদ্ধির অব্যাহত অনুশীলন আছে, হৃদয়ধর্মের স্বীকৃতি আছে, মুক্তবুদ্ধির সাধনা আছে।’
নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা। হিন্দুর ঐতিহ্যে নজরুল তথা মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে, কিন্তু মুসলমানের ঐতিহ্যে রবীন্দ্রনাথের তথা হিন্দুর উত্তরাধিকার নেই।মোতাহের হোসেন চৌধুরীমোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রতিটি রচনায় রেনেসাঁস চেতনার উজ্জ্বল ছাপ লক্ষণীয়। তবে ‘রেনেসাঁস: গোড়ার কথা ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রবন্ধে তাঁর রেনেসাঁস ভাবনার সবচেয়ে নান্দনিক প্রকাশ ঘটেছে। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘রেনেসাঁস কথাটার শব্দগত অর্থ পুনর্জন্ম, অর্থাৎ পুরাতনে ফিরে যাওয়া, অথবা পুরাতনকে ফিরে পাওয়া; কিন্তু ভাবগত অর্থ নবজন্ম, মানে মানবমহিমা তথা বুদ্ধি ও কল্পনার পুনঃ প্রতিষ্ঠা। রেনেসাঁসের ইতিহাস তাই জীবন-সূর্যের পুনরোদয়ের ইতিহাস—বুদ্ধি ও কল্পনার জয়যাত্রার ইতিহাস।’
মোতাহের হোসেন সচেতন ছিলেন যে পুরাতনে ফিরে যাওয়াই রেনেসাঁস নয়, জীবনপ্রীতি তথা বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনাপ্রীতিই রেনেসাঁস। তিনি যথার্থই বলেছেন, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ মানবমহিমারই কাব্য। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পটভূমিতে তাঁর বিশ্লেষণ অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত:
‘নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা। হিন্দুর ঐতিহ্যে নজরুল তথা মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে, কিন্তু মুসলমানের ঐতিহ্যে রবীন্দ্রনাথের তথা হিন্দুর উত্তরাধিকার নেই। প্রাণের যোগ নেই বলে বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য, কিন্তু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি একপ্রকার জলবায়ুর মতোই সহজ।’
মুসলিম সাহিত্য সমাজের চিন্তকদের মধ্যে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রেনেসাঁস চেতনা ছিল খুব স্পষ্ট ও সাহসী। উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা যে রেনেসাঁসের শত্রু, তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘রেনেসাঁসে বড় হয়ে উঠেছিল যে জীবন—পরকালমুখী ধর্মসাধনা নয়, ইহকালমুখী জীবনসাধনা, মানে জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের প্রয়াস, সাহিত্য সমাজেরও লক্ষ্য ছিল তা–ই।’ নানা প্রতিকূলতার কারণে সে লক্ষ্য পূর্ণতা পায়নি। এ সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন—‘মুসলিম সমাজে যদি কখনো সত্যিকারের রেনেসাঁসের আবির্ভাব হয়, তবে উপলব্ধ হবে যে তার প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেছিল “মুসলিম সাহিত্য সমাজ”।’
১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের শতবর্ষ পূর্তির প্রাক্কালে ‘সত্যিকারের রেনেসাঁসের’ স্বপ্ন দেখা কি দুরাশা?