আমাদের এক পরিচিত বড় ভাই যেকোনো প্রসঙ্গে লইট্টা মাছ নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতেন। হয়তো রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে, বড় ভাই চট করে বলতেন, ‘কথা সেটা নয়। আজ পাঁচ কেজি লইট্টা মাছ কিনলাম। সকালে তোমাদের ভাবি আর আমি মিলে কেটেকুটে রান্না করলাম।’

এখানেই শেষ নয়। রান্নার রেসিপিও গড় গড় করে বলে যেতেন তিনি। ‘পাঁচ কেজি লইট্টা মাছের জন্য কেজিখানেক পেঁয়াজ, অল্প রসুন, টমেটো কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতা লাগবে। প্রথমে তেলে পেঁয়াজ লাল করে ভেজে নিতে হবে। এরপর বাকি মসলা হলুদ, লাল মরিচ, কাঁচা মরিচ দিয়ে কষিয়ে টমেটো দিতে হবে। কষানো শেষ হলে মাছ দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। তেল উঠে এলে মাছ নিচে বসে যাবে। এরপর মাখনের মতো কেটে কেটে খাও।’ এসব বলতে বলতে বড় ভাইয়ের জিবে জল আসত। বারবার ঢোক গিলতে হতো। লোভনীয় লইট্টা মাছ যেন তাঁর সামনেই এনে রাখা হয়েছে।

কেবল এই পরিচিত বড় ভাই নন, চট্টগ্রামের মানুষ হলেই লইট্টা মাছের প্রতি আলাদা টান থাকবে। এ অঞ্চলের জনসংস্কৃতির ও খাদ্যের ইতিহাসের সঙ্গে মাছটি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। পাশাপাশি দেশকালের সীমানা ডিঙিয়ে ভিনদেশিদের পাতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে লইট্টা।

চাটগাঁইয়া মাইনষে খায়

চট্টগ্রামের লোকগীতি রচয়িতা প্রখ্যাত বাউলশিল্পী আব্দুল গফুর হালীর একটা গান আছে এমন, ‘চাটগাঁইয়া মাইনষে খায় দে/ আউল্লা চইলর ভাত/ লইট্টা মাছর নরম কেডা/ ন বাজে গলাত।’

লইট্টা মাছের শুঁটকি চাটগাঁয় যাকে ফুনি বলা হয়, তা আলু দিয়ে কিংবা কচুর লতি দিয়ে রান্না করলে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। তাজা মাছের পাশাপাশি লইট্টা শুঁটকিও সারা বছরই খাওয়া হয়। লইট্টা মাছের নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নেই। তবে বর্ষার পর শীতের শুরুতে বেশি ধরা পড়ে বলে জেলে জানান। এ সময় দামও কিছুটা কম থাকে এ মাছের।

চট্টগ্রামে লইট্টা মাছ ভুনা অথবা রসা রান্না দুটোরই প্রচলন আছে। ভুনা মাছে কোনো ধরনের ঝোল থাকে না। অপর দিকে রসা রান্নায় ঝোল থাকবে। তবে সব ধরনের রান্নায় পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, টমেটো, আদাবাটা, মরিচ ও হলুদ আবশ্যক।

অনেককে বলতে শুনেছি, কাঁচাবাজার একটা অঞ্চলের মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। বাজার ঘুরেই বোঝা যায় মানুষগুলো কেমন। চট্টগ্রামের বাজারে গেলেও এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, লইট্টা মাছ নিয়ে যাঁরা বসেন, তাঁদের অনেকেই ক্রেতাদের বিচিত্র কথায় প্রলুব্ধ করেন। একবার এক মাছওয়ালাকে বলতে শুনেছি, ‘ওবা লই য, রসগুল্লা রসগুল্লা।’

এই রসগোল্লার লোভে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ভুনা বা রসা রান্না কিংবা ঝুরি ভাজি সব রকমেই লইট্টা অতুলনীয়। আবার দামটা সস্তার পাঙাশ মাছের চেয়েও কম।

চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক গানে পাওয়া গেল, ‘ইলিশ মাছর তিরিশ কেডা/ লইট্টা মাছর লাল দাঁড়ি/ আঁর ভাবিয়ে মরিচ বাডের/ কেইল লাড়ি লাড়ি।’ লইট্টা মাছের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দৈনন্দিন জীবনের এই ছবিই বলে দেয় মাছটি চট্টগ্রামের আবহমান খাদ্য সংস্কৃতিতে কত বড় জায়গা ধারণ করে আছে।

চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারের ব্রিজঘাটের মাছ বাজারে আসা লইট্টা মাছ। সম্প্রতি তোলা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বড় ভ ই লইট ট

এছাড়াও পড়ুন:

৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম

গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।

এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’

দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’

ব্যবসার শুরু

রহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।

রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।

হকার থেকে এজেন্ট

কয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।

আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’

পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাস ধুয়েমুছে চালকের সহকারী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন, ফিরে দেখেন আগুন জ্বলছে
  • ‘বাসটির সঙ্গে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে, এরপর আর কিছু মনে নেই’
  • রেলের ৭ লাখ টাকার যন্ত্র ২৭ হাজারে বানালেন তিনি
  • রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার-ধামরাইয়ে দুই বাসে আগুন
  • জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর নেশা 
  • ইডেনে স্পিন বিষ, ১৫ উইকেটের দিনে উড়ছে ভারত
  • বিচারকের ছেলে হত্যা মামলার আসামি লিমন পাঁচ দিনের রিমান্ডে
  • বিচারকের ছেলে হত্যা: লিমন ৫ দিনের রিমান্ডে
  • ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’
  • ৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম