‘নৌকাডুবির সময় আমার বাবার পরনে যে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটা ছিল, ওইটা টরে কাপড়ের। আমার মনে হয় পানিতে ডুবলেও ওই কাপড়টা ১০ বছরেও নষ্ট হবে না। এ জন্য আশায় ছিলাম বাবার লাশের চিহ্ন হিসেবে অন্তত কাপড়টা পাওয়া যাবে। বাবার পাঞ্জাবির এক টুকরা কাপড় খুঁজে পেলেও মাকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। ওই ঘটনায় আমার দুই বোনসহ পাঁচজন স্বজনের লাশ পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে পাইনি। তখন থেকেই মা মাঝেমধ্যে কেমন জানি এলোমেলো কথা বলেন। নিজের হাতে বাবার সৎকারও করতে পারলাম না। তিন বছর হলো, মনে হয় না আর পাওয়া যাবে।’

কথাগুলো বলছিলেন তিন বছর আগে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণের (৬৩) বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ (৪০)। এ সময় তাঁর দুচোখে পানি ছলছল করছিল। পাশে বসে নির্বাক হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন স্বপনের মা শান্তি রানী (৬১)। কথা শুনতে শুনতে একবার বলে উঠলেন, ‘মানুষটাক আর পানোনি বাপু।’ এ সময় তাঁর দুচোখের কোণে পানি ছলছল করছিল।

আরও পড়ুন‘দুইডা বেটির মরা শরীর দেখিনু, কিন্তু ওর বাপের মুখখান আর দেখা পানুনি’২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩আরও পড়ুন‘হামেরা মরে গেলে এই এতিম ছুয়ালার কী হবে’২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

মঙ্গলবার বিকেলে সরেন্দ্র নাথের বাড়ির বাইরের উঠানে বসে কথা হয় তাঁর স্ত্রী ও বড় ছেলের সঙ্গে। নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাই, বেয়াইসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ ওঠায় সাতজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি। মাঝনদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামে তাঁদের এক স্বজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যান অন্যরা। এরপর উদ্ধার অভিযানে বেয়াই, দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাইসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।

নৌকাডুবির তিন বছরেও নিখোঁজ সরেনের জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না স্ত্রী-সন্তানদের। বাবাকে জীবিত অথবা মৃত খুঁজে পেতে এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে ঘোরেন তাঁরা। এমনকি নদীর ধারে গিয়ে একাধিকবার করেছেন গঙ্গাপূজা।

ঘটনার দিন দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর জেলা প্রশাসনের করা নিখোঁজদের তালিকায় ছিলেন এক শিশুসহ তিনজন।

এরপর ঘটনার দেড় মাসের মাথায় নৌকাডুবির স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দক্ষিণে নদীর বালুর নিচ থেকে ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) নামে নিখোঁজ এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪৭ দিনের মাথায় কাছাকাছি স্থানে বালুর নিচ থেকে জয়া রানী (৪) নামের এক শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখন নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন শুধু সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ছয়জন, জীবিত উদ্ধার হন ২৭ জন। এরপর লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭১ জনের এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন।

নৌকাডুবির ঘটনার পর আউলিয়ার ঘাট এলাকায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। মঙ্গলবার বিকেলে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটের নৌকাডুবির স্থান ঘুরে দেখা যায়, ঘটনার দিনের তুলনায় অনেকটাই কম করতোয়ার পানি। নদীর ওপর চলছে দুটি (ওয়াই আকৃতির) সেতু নির্মাণের কাজ। তবে নৌকা দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, আউলিয়ার ঘাটে গত বছরের নভেম্বর মাসে মোট ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। মাড়েয়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় সেতু দুটির সংযোগ সড়কে ওয়াই আকৃতি যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে চপড়ামারী এলাকা এবং অপরটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে নিশানডোবা-বোদেশ্বরীর সঙ্গে যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি ৩৪৫ দশমিক ৪ মিটার এবং অপরটি ৫৪৫ দশমিক ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের হবে। এর চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা।

এলজিইডি পঞ্চগড় জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.

মাহমুদ জামান বলেন, আউলিয়ার ঘাটে দুটি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। সেতু দুটির সংযোগ সড়ক ওয়াই আকৃতির হবে। ১১০ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যে ইতিমধ্যে ৫৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের সময়সীমা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। আশা করা যায়, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শেষ হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ঘটন র দ র ঘটন আউল য়

এছাড়াও পড়ুন:

৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম

গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।

এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’

দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’

ব্যবসার শুরু

রহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।

রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।

হকার থেকে এজেন্ট

কয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।

আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’

পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাস ধুয়েমুছে চালকের সহকারী ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন, ফিরে দেখেন আগুন জ্বলছে
  • ‘বাসটির সঙ্গে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে, এরপর আর কিছু মনে নেই’
  • রেলের ৭ লাখ টাকার যন্ত্র ২৭ হাজারে বানালেন তিনি
  • রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে সাভার-ধামরাইয়ে দুই বাসে আগুন
  • জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর নেশা 
  • ইডেনে স্পিন বিষ, ১৫ উইকেটের দিনে উড়ছে ভারত
  • বিচারকের ছেলে হত্যা মামলার আসামি লিমন পাঁচ দিনের রিমান্ডে
  • বিচারকের ছেলে হত্যা: লিমন ৫ দিনের রিমান্ডে
  • ‘তোকে গুলি করে মারব না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারব’
  • ৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম