‘বাবার পাঞ্জাবির এক টুকরা কাপড় খুঁজে পেলেও মাকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম’
Published: 25th, September 2025 GMT
‘নৌকাডুবির সময় আমার বাবার পরনে যে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটা ছিল, ওইটা টরে কাপড়ের। আমার মনে হয় পানিতে ডুবলেও ওই কাপড়টা ১০ বছরেও নষ্ট হবে না। এ জন্য আশায় ছিলাম বাবার লাশের চিহ্ন হিসেবে অন্তত কাপড়টা পাওয়া যাবে। বাবার পাঞ্জাবির এক টুকরা কাপড় খুঁজে পেলেও মাকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। ওই ঘটনায় আমার দুই বোনসহ পাঁচজন স্বজনের লাশ পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে পাইনি। তখন থেকেই মা মাঝেমধ্যে কেমন জানি এলোমেলো কথা বলেন। নিজের হাতে বাবার সৎকারও করতে পারলাম না। তিন বছর হলো, মনে হয় না আর পাওয়া যাবে।’
কথাগুলো বলছিলেন তিন বছর আগে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণের (৬৩) বড় ছেলে স্বপন চন্দ্র বর্মণ (৪০)। এ সময় তাঁর দুচোখে পানি ছলছল করছিল। পাশে বসে নির্বাক হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন স্বপনের মা শান্তি রানী (৬১)। কথা শুনতে শুনতে একবার বলে উঠলেন, ‘মানুষটাক আর পানোনি বাপু।’ এ সময় তাঁর দুচোখের কোণে পানি ছলছল করছিল।
আরও পড়ুন‘দুইডা বেটির মরা শরীর দেখিনু, কিন্তু ওর বাপের মুখখান আর দেখা পানুনি’২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩আরও পড়ুন‘হামেরা মরে গেলে এই এতিম ছুয়ালার কী হবে’২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩মঙ্গলবার বিকেলে সরেন্দ্র নাথের বাড়ির বাইরের উঠানে বসে কথা হয় তাঁর স্ত্রী ও বড় ছেলের সঙ্গে। নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ বর্মণ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের নগর সাকোয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাই, বেয়াইসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ ওঠায় সাতজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি। মাঝনদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামে তাঁদের এক স্বজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যান অন্যরা। এরপর উদ্ধার অভিযানে বেয়াই, দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাইসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।
নৌকাডুবির তিন বছরেও নিখোঁজ সরেনের জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না স্ত্রী-সন্তানদের। বাবাকে জীবিত অথবা মৃত খুঁজে পেতে এখনো মাঝেমধ্যে নদীর পাড়ে ঘোরেন তাঁরা। এমনকি নদীর ধারে গিয়ে একাধিকবার করেছেন গঙ্গাপূজা।
ঘটনার দিন দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার চতুর্থ দিন পর্যন্ত নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর জেলা প্রশাসনের করা নিখোঁজদের তালিকায় ছিলেন এক শিশুসহ তিনজন।
এরপর ঘটনার দেড় মাসের মাথায় নৌকাডুবির স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দক্ষিণে নদীর বালুর নিচ থেকে ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) নামে নিখোঁজ এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪৭ দিনের মাথায় কাছাকাছি স্থানে বালুর নিচ থেকে জয়া রানী (৪) নামের এক শিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ নিয়ে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখন নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন শুধু সরেন্দ্র নাথ বর্মণ।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ছয়জন, জীবিত উদ্ধার হন ২৭ জন। এরপর লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭১ জনের এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন।
নৌকাডুবির ঘটনার পর আউলিয়ার ঘাট এলাকায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। মঙ্গলবার বিকেলে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটের নৌকাডুবির স্থান ঘুরে দেখা যায়, ঘটনার দিনের তুলনায় অনেকটাই কম করতোয়ার পানি। নদীর ওপর চলছে দুটি (ওয়াই আকৃতির) সেতু নির্মাণের কাজ। তবে নৌকা দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, আউলিয়ার ঘাটে গত বছরের নভেম্বর মাসে মোট ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। মাড়েয়া ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় সেতু দুটির সংযোগ সড়কে ওয়াই আকৃতি যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে চপড়ামারী এলাকা এবং অপরটি মাড়েয়া-ডাঙ্গাপাড়া থেকে নদীর ওপারে নিশানডোবা-বোদেশ্বরীর সঙ্গে যুক্ত হবে। দুটি সেতুর মধ্যে একটি ৩৪৫ দশমিক ৪ মিটার এবং অপরটি ৫৪৫ দশমিক ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের হবে। এর চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ১১০ কোটি টাকা।
এলজিইডি পঞ্চগড় জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঘটন র দ র ঘটন আউল য়
এছাড়াও পড়ুন:
বল হাতে দুর্দান্ত মারুফা, ব্যাট হাতে রুবাইয়া—পাকিস্তানকে উড়িয়ে বিশ্বকাপ শুরু বাংলাদেশের
তিন বছর আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপ অভিষেকে একটিই জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। সেটি এসেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। তিন বছর পর আজ সেই পাকিস্তানকে হারিয়েই ২০২৫ নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরু করল বাংলাদেশ।
কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিয়েছে নিগার সুলতানার দল। গত এপ্রিলে যে পাকিস্তানের কাছে বাছাইপর্বে হেরে শঙ্কার মুখে পড়েছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন, সেই দলটিকেই ১২৯ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ নারী দল ম্যাচ জিতেছে ৭ উইকেটে। ১৩০ রানের লক্ষ্যটা ১৮.৫ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়েই পেরিয়ে যান নিগাররা।
রান তাড়ার শুরুটা অবশ্য শঙ্কা জাগিয়েছিল। ১০ ওভারের প্রথম পাওয়ার প্লেতে ২৩ রান করতেই ১ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। ওপেনার ফারজানা হক ১৭ বলে মাত্র ২ রান করে এলবিডব্লু হয়েছেন ডায়ানা বেগের বলে।
পাওয়ার প্লের পর ১২তম ওভারের শেষ বলে ফিরে যান তিনে নামা শারমিন আক্তার। ১০ রান করতে ৩০ বল খেলতে হয়েছে শারমিনকে। শারমিন ফেরার পর ওপেনার রুবাইয়া হায়দার ও নিগার সুলতানা পরের দুই ওভারে তুলতে পারেন মাত্র ২ রান।
বাংলাদেশ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ১৫তম ওভারে। পাকিস্তান নারী দলের সাদিয়া ইকবালকে চার মেরে আড়মোড়া ভাঙেন অধিনায়ক নিগার সুলতানা। পাকিস্তানি অফ স্পিনার রামিন শামীমের করা পরের ওভারে আসে ১৩ রান, দুই চারে যার ৯-ই নিগারের। রান-উৎসবে এরপর যোগ যেন রুবাইয়াও। বাঁহাতি স্পিনার নাশরা সান্ধুর করা ১৯তম ওভারে তিনটি চার মারেন এদিনই প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলতে নামা রুবাইয়া।
শেষ পর্যন্ত অভিষেকটা ফিফটি করে রাঙিয়েছেন তিনি। ৬২ রানের জুটি গড়ে অধিনায়ক নিগার সুলতানা ফিরে গেলেও ২৮ বছর বয়সী রুবাইয়া ফিরেছেন দলকে জিতিয়ে, সঙ্গে একটা রেকর্ড নিয়েও। ৭৭ বলে ৮ চারে ৫৪ রানে অপরাজিত থেকেছেন এই বাঁহাতি ব্যাটার। মেয়েদের ওয়ানডে অভিষেকে যা বাংলাদেশের ব্যাটারদের সর্বোচ্চ ইনিংস। রুবাইয়া ভেঙেছেন আয়েশা রহমানের রেকর্ড, ২০১১ সালে বিকেএসপিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৩ রান করেছিলেন আয়েশা।
৪৪ বলে ২৩ রান করে নিগারের বিদায়ের পর ব্যাটিংয়ে নামা সোবহানা মোস্তারি ১৯ বলে করেন অপরাজিত ২৪ রান। ৬টি চার ছিল সোবহানার ইনিংসে।
এর আগে বোলিংয়ে বাংলাদেশকে দুর্দান্ত সূচনা এনে দেন পেসার মারুফা আক্তার। প্রথম ওভারের শেষ দুই বলে ওমাইমা সোহেল ও সিদরা আমিনকে ফেরান মারুফা। দুর্দান্ত এক বলে প্রথম উইকেটটি পেয়েছেন তিনি। অফ স্টাম্পের বাইরে পড়া ফুলার লেংথের বলটা বাঁক খেয়ে ভেতরে ঢুকে লেগ স্টাম্পে আঘাত হানে। ‘গোল্ডেন ডাক’ পান পাকিস্তান ওপেনার ওমাইমা। পরের বলে আরেকটি ‘গোল্ডেন ডাক।’ এবারও অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢুকছিল বলটি, সিদরা ড্রাইভ করতে গিয়ে সেটিকে টেনে নিয়ে যান লেগ স্টাম্পে। হ্যাটট্রিক অবশ্য পাননি মারুফা, থেমেছেন এই ২ উইকেট নিয়েই।
তবে ম্যাচ সেরা মারুফার ওই শুরুটাকেই টেনে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের অন্য বোলাররা। তাঁদের মধ্যে আলাদা করেই বলতে হয় লেগ স্পিনার স্বর্ণা আক্তারের কথা। ৩.৩ ওভার বল করে মাত্র ৫ রানে তিনি নেন ৩ উইকেট। তাঁর পুরো করা তিনটি ওভারই ছিল মেডেন।
২ রানে ২ উইকেট খোয়ানোর মুনিবা আলীকে নিয়ে ৪২ রান যোগ করেন পাকিস্তানের রামিন শামীম। পরপর দুই ওভারে এ দুজনকে ফিরিয়ে আবারও পাকিস্তানকে চাপে ফেলেন বাঁহাতি স্পিনার নাহিদ আক্তার। এরপর নিয়মিত বিরতিতেই উইকেট তুলে নিতে থাকেন বাংলাদেশের বোলাররা। ফল, ৩৮.৮ ওভারে ১২৯ রানে অলআউট পাকিস্তানের মেয়েরা।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মেয়েদের বিপক্ষে এটিই কোনো দলের সর্বনিম্ন রান। আগের সর্বনিম্ন ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী দলের করা ৯ উইকেটে ১৪০ রান। ২০২২ সালে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে সেই ম্যাচটি অবশ্য হেরেছিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা। রান তাড়ায় বাংলাদেশ অলআউট হয়েছিল ১৩৬ রানে। আজ এমন কিছুর শঙ্কা দূর হয়েছে অভিষিক্ত রুবাইয়াতের ব্যাটে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ ৭ অক্টোবর, গুয়াহাটিতে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড।
সংক্ষিপ্ত স্কোরপাকিস্তান: ৩৮.৩ ওভারে ১২৯ (রামিন ২৩, সানা ২২, মুনিবা ১৭, ডায়না ১৬*, সিদরা ১৫, আলিয়া ১৩; স্বর্ণা ৩/৫, নাহিদা ২/১৯, মারুফা ২/৩১)।বাংলাদেশ: ৩১.১ ওভারে ১৩১/৩ (রুবাইয়া ৫৪*, সোবহানা ২৪*, নিগার ২৩; ডায়না ১/১৪)।
ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচসেরা: মারুফা আক্তার।