মফস্সলের স্কুলের বিদেশি হেডমাস্টার
Published: 27th, September 2025 GMT
আমাদের স্কুলের নাম বরিশালের উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন একজন বিদেশি। নব্বইয়ের দশকে বরিশালের মতো মন্থর মফস্সলে সুদূর কানাডা থেকে আসা প্রধান শিক্ষক ছিলেন এক বিস্ময়! বিশেষ করে আমাদের মতো শিশুদের কাছে। আমাদের বেশ গর্ব হতো যে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক একজন বিদেশি, ব্রাদার এ্যালবারিক, সিএসসি।
ব্রাদারের চুল ছিল ধবধবে সাদা। হাফহাতা চেক শার্ট, ঢোলা ফরমাল প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল, চোখে চশমা আর হাতে চিকন একটা বেত, এই ছিল তাঁর ইউনিফর্ম। শীতকালে শার্টের ওপর একটা জ্যাকেট চাপাতেন। হাতে বেত নিয়ে দুই হাত পেছনে রেখে গম্ভীরভাবে হাঁটতেন তিনি। তবে বেত দিয়ে মারতেন না, শুধু ভয় দেখাতেন। পেটের চামড়া টেনে ধরে দুই আঙুল দিয়ে চাপ দিতেন। এটা ছিল তাঁর শাস্তি দেওয়ার স্টাইল।
কথা বলতেন খুব মৃদু স্বরে। দুপুর ১২টার দিকে রাউন্ডে বের হতেন ব্রাদার। পুরো স্কুল হেঁটে হেঁটে চক্কর দিতেন। কোন ক্লাসে কী হচ্ছে দেখতেন। ক্লাসের সামনে কাউকে কান ধরে দাঁড়ানো দেখলে কাছে গিয়ে কথা বলতেন, কেন শাস্তি পেয়েছে শুনতেন। কারও পেটে চিমটি কাটতেন। কাউকে আবার হালকা বকা দিয়ে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিতেন।
আমাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করত আব্বু। একদিন দুপুরে বের হয়ে দেখি আব্বু আসেনি। স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশ দ্রুত খালি হয়ে গেল, গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুর। হঠাৎ মনে হলো আজকে আর আব্বু আসবে না। আমি বাসায় যেতে পারব না। ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি।
স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে কাঁদছি দেখে স্কুলের শিক্ষক দানিয়েল স্যার জানতে চাইলেন, কেন কাঁদছি। আমি বললাম, আব্বুর আমাকে নিতে আসার কথা, তিনি আসেননি। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, বাসার ফোন নম্বর আছে কি না? আমি কাঁদতে কাঁদতে আমার খাতায় লেখা বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিলাম।
দানিয়েল স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টার ব্রাদার এ্যালবারিকের রুমে। তখন বেলা আড়াইটা বাজে। স্কুল ছুটি হয় বেলা দেড়টায়। ব্রাদার তখনো অফিসে কাজ করছেন। দানিয়েল স্যার ব্রাদারকে আমার বিষয়টা বললেন। ব্রাদার আমার দিকে তাকালেন। ইশারায় হাত দিয়ে চেয়ার দেখিয়ে আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম।
ব্রাদারের রুমে থাকা ল্যান্ডফোন থেকে দানিয়েল স্যার আমার নানার বাসায় ফোন করলেন। ফোন রেখে আমাকে বললেন, ‘টেনশন কোরো না। তোমার বাসা থেকে লোক আসছে, তোমাকে নিয়ে যাবে।’ তারপর তিনি বের হয়ে গেলেন।
আমি চুপচাপ বসে আছি ব্রাদারের রুমে। তিনি উঠে এসে আমার হাতে একটা চকলেট দিলেন। তাকিয়ে দেখি এ তো আমার পরিচিত কোনো চকলেট নয়, বিদেশি চকলেট! ব্রাদার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট ওরি, সন।’ ব্রাদার তাঁর ফাইলপত্র নিয়ে কাজ করতে থাকলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম, তিনি খুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাজ করেন। এর আগে তাঁকে শুধু দূর থেকে দেখেছি। সেই প্রথম এবং শেষ এত কাছ থেকে দেখা।
আধা ঘণ্টা পর আমার মামা এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। ব্রাদারকে অশেষ ধন্যবাদ জানালেন তিনি। বিনিময়ে ব্রাদার মৃদু হাসলেন। এগিয়ে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন, বললেন, ‘গুড বয়।’ আমি বাসায় ফিরে এলাম। এমনিতে তাঁকে ভয় পেতাম। তবে সেদিনের পর ভয় কেটে গিয়েছিল।
বরিশালের উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ব্রাদার দায়িত্ব পালন করেন ১ আগস্ট ১৯৮২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৭ পর্যন্ত, দীর্ঘ ১৫ বছর। ব্রাদার থাকতেন স্কুল লাগোয়া গির্জার কোয়ার্টারে। সকাল আটটায় স্কুল শুরু হতো। বেলা দেড়টায় ছুটি। তারপর আর ব্রাদারের দেখা পাওয়া যেত না। আমি কখনো উদয়ন স্কুলের কম্পাউন্ডের বাইরে ব্রাদারকে দেখিনি।
অবসরে যাওয়ার পর আর ব্রাদারের সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি আমাদের স্মৃতিতে রয়ে গেছেন, মফস্সলের স্কুলের বিদেশি হেডমাস্টার হিসেবে।
ফাহিম ইবনে সারওয়ার, রিং রোড, শ্যামলী, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র র আম র বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিপাইনে ৬ দশমিক ৯ তীব্রতার ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৯
ফিলিপাইনের মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৯ তীব্রতার শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে ৬৯ জন হয়েছে। দেশটির দুর্যোগ-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আজ বুধবার এ খবর জানান। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা ও পানি-বিদ্যুতের সংযোগ আবার চালু করার চেষ্টা করছে ফিলিপাইন সরকার।
দেশটির সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তা রাফি আলেজান্দ্রো সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার আগে সেবু প্রদেশের উত্তরে বোগো শহরের কাছে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়। স্থানীয় হাসপাতালগুলো আহত মানুষের ভিড়ে রীতিমতো উপচে পড়ছে।
আঞ্চলিক সিভিল ডিফেন্স দপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা জেন আবাপো বলেন, সেবুর প্রাদেশিক দুর্যোগ দপ্তরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে নিহত হওয়ার সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৬৯ জন। অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, আহত হয়েছেন ১৫০ জনের বেশি।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দ্রুত সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি জানান, মন্ত্রিপরিষদ সচিবেরা ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রিয়জন হারানো ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।
সেবু ফিলিপাইনের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর একটি। সেখানে প্রায় ৩৪ লাখ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ম্যাকতান-সেবু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম চালু রয়েছে। এটা ফিলিপাইনের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর।
ভূমিকম্পে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সান রেমিগিও শহরটিও। উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তার জন্য এ শহরে ‘দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা’ ঘোষণা করা হয়েছে। শহরের ভাইস মেয়র আলফি রেইনেস বলেন, উদ্ধারকর্মীদের জন্য খাবার ও পানি, সেই সঙ্গে ভারী সরঞ্জাম প্রয়োজন।
স্থানীয় ডিজেডএমএম রেডিওকে আলফি রেইনেস বলেন, ‘ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। আমাদের সত্যিই সহায়তা দরকার। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ভূমিকম্পে সেখানে সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আরও পড়ুনফিলিপাইনে শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহত অন্তত ২৬, চলছে উদ্ধারকাজ৫ ঘণ্টা আগে