Prothomalo:
2025-11-17@09:17:43 GMT

একবার ভাবলাম, না দেখি

Published: 1st, October 2025 GMT

অতটা পরিচ্ছন্ন নয়, এদিক–সেদিক ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা আর কালো পিচের ওপর ধূসর বালুর ছড়াছড়ি, এত দিন যেমন দেখে আসছিলাম পায়ের তলায় গাঢ় রঙের খয়েরি মাটি, তার চেয়ে এই ভূমি অনেক আলাদা। কখনো আবার ঝুঁকে বসে দেখতে বেশি ভালো লাগত। কী রকম রং, অদ্ভুত গন্ধ… সারা দিন নাকে লেগে থাকে। আঙুলের অগ্রভাগ ঠেকালে একটা ঝাপসা বিন্দুর মতন দাগ হতো; সেখান থেকে কিছুটা টেনে আনলেই দৃশ্যমান হয়ে উঠত একটা রেখা। সেই গন্ধ কখনো কি নাকে টেনে নিয়েছি কি না, স্মরণে আসে না। তবে নাকে লেগে থাকার মতো কিছু ব্যাপার চোখেও যে লেগে থাকে, সেই অভিজ্ঞতা আমার তখনো হয়ে ওঠেনি। এখন বুঝতে পারি দৃশ্যাবলির চোখে লেগে থাকা, তা-ও, স্মৃতির স্তরগুলোয় লেগে থাকা ঘ্রাণের তুলনায় কম ভারী নয়। দেখতে পাই আমার ছোট্ট দুটো পা, যা তখন কোনো সাধারণ আসনে বসলে ঝুলে থাকে, সহজে মাটির নাগাল পাই না… দুটো জুতা পরা থাকত। কেডস। পায়ের দুলুনিতে দোল খেতে থাকত। সেই পা নিয়ে আমি ঝাঁপ দিয়ে নয়, খুব স্বাভাবিকভাবে নেমে আসার চেষ্টা করছি হলুদ সেই পুরোনো ট্রাকের আসন থেকে। দরজার পাশেই বসে ছিলেন মামা, তিনি নিচে নেমে বারবার আমাকে কোলে নিয়ে নামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বৃথাই, ভেবেছিলাম আমি পারব।

শেষমেশ নেমে আসি তার দুই হাতের মাঝখানে আমার শরীরটাকে তুলে দিয়ে। কিছু আগে নিতান্তই চারপাশ দেখে নেওয়ার তাগিদে বার দুই তাকিয়েছিলাম পেছনের দিকে। সেই ধুলামাখানো পিচ, তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এক পলেস্তরা খসে যাওয়া দেয়াল, ইটগুলো দেখা যাচ্ছে কেমন কালচে হয়ে আছে। আর তার সঙ্গেইই ঘেঁষে দাঁড়ানো আমাদের ট্রাক। তারও পেছনে অপরিচিত একটা রাস্তা, সেখানে কী ঘটছে, জানা নেই। তাকিয়ে মালবাহী শরীরটার ও রকম বিশাল লম্বা আকার দেখে খুবই অন্য রকম লাগছিল। সেখান থেকে মালামাল নামানো হবে; নতুন বাসায় উঠতে যাচ্ছি আমরা। আব্বু আর আম্মুকে আশপাশে দেখতে পেলাম না। এতক্ষণ আমার সঙ্গে ছিলেনও না, তাঁদের বেবি ট্যাক্সিতে করে আসার কথা শুনেছি। তখন একটা লম্বা গলিতে ঢুকে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।

তখন তো জানি না। মাত্র দুটো বছর কেটেছে আমি এই আশ্চর্য জগতে এসেছি, পেছন থেকে তাও সেই মাটির দাগ, বিন্দু থেকে রেখা আমার সঙ্গে আলাপ করছিল। আরও ছিল কুয়াশাঘেরা বিরাট রাস্তা, তার ওপর দিয়ে খুবই অল্প গতিতে আব্বু ও আম্মু রিকশায়, আমি যেন কার কোলে ধীরগতিতে কোথাও আগাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার একপাশে পানি, একপাশে বাড়িঘর, সবই রাস্তা থেকে নিচু নিচু, ওইখানে একটা বাঁক এসেছে। আর সেই বাঁকে রহস্যজনক একটা মালবোঝাই বিরাট ট্রাক চাকাগুলো ভাসিয়ে দিয়ে উল্টে পড়ে আছে। আমার জিজ্ঞাসা জমাট বাঁধতে পারে না। সব অস্ফুট লাগতে থাকে। কথায় কথায় (শুনতে শুনতে) জানতে পারি, সেখানে আছে অনেক খেজুর আর জমজমের পানি। আরব থেকে আসা।

রিকশা এগিয়ে চলে যেন সব দৃশ্য পেছনে চলে যায়। সেই নিয়মে সবার সঙ্গে আমাকেও আগাতে হয়। কিন্তু আমার সঙ্গে অকারণ থেকে যায় দৃশ্য, তাকে আমি যতই সেই স্থানে রেখে যেতে চাই। লোকে বলে, ‘এ তো খুবই নগণ্য। এই জীবনে তুমি পেতে পারো আরও কত অপার, কত সুরম্য দৃশ্যাবলি!’ আমি তখনো বুঝেই উঠিনি যে ‘এই জীবন’ বলতে কী বোঝায় মানুষ। ভেবে উঠতে পারিনি যে এতটা কম সময়ের জন্য এসেছি। তাই সেই গলিতে, যেখানে মাত্রই হাঁটতে শুরু করলাম মামার হাত ধরে, সেই গলির দুইপাশের দেয়ালের বিচিত্র বিন্যাস ও লেখাজোকার মাঝখানে দিয়ে খেলতে খেলতে দেখি মামা চলে যায়, দেখি আব্বু চলে যায়, আমিও যাই কখনো কখনো আম্মুর সঙ্গে। একদিন কী ভেবে যেন পা দুটো গলির ভেতরে রেখেই কাঁধটা একটুখানি এগিয়ে দিয়ে বাইরে তাকাই, দেখি অনেকগুলো রিকশা, দুটো–একটা বেবি ট্যাক্সি আর মানুষজন এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। সেই গতি মুগ্ধ করার মতো। তুরাগপাড়ের সেই এলাকা থেকে চলে আসার পর, বাসার এত সামনে পা ফেলার দূরত্বে এ রকম গতি দেখে আমি হয়তো সম্মোহিত ছিলাম। হঠাৎ একটা বড় গাড়ি আমার সামনে দিয়ে আমার গলিটাকে একদম না দেখেই শাঁই করে চলে গেল। সেই শব্দে ও বাতাসে আমি আবারও হেঁচকা সীমানার ভেতরে।

তারপর আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই গলির দুই পাশের দেয়াল ও মাটির সঙ্গেই, হলুদ ট্রাক থেকে এখানে নেমে আসার পর অনেকগুলো দিনও আমার চলে যায়। তখনকার সেই সরু লম্বা গলি, সেইখান দিয়ে নানান মানুষের যাতায়াত আস্তে আস্তে নিয়মিত মনে হতে শুরু করে। বিশেষ করে আমাদের দালানের নিচতলায় কিন্ডারগার্টেনে, অন্য অনেক বাসা থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের যাতায়াত এবং তাদের টিফিনের সময়কার ছোটাছুটি মনের ভেতর নির্দিষ্ট কোনো অর্থ তৈরি করে না ঠিক কিন্তু কেমন যেন বাসনা তৈরি করে; দোলা দিতে থাকে। তারপর অবশ্য খুব বেশিদিন নয়, তাদেরই একজন হয়ে আমিও বাসার সামনের জায়গাটায় একদিন ‘হুই’ বলে দৌড় দেওয়ার উত্তেজনা লাভ করি। তবু আমার গলি আর অতিক্রম করা হয় না। প্রথম দিন এই প্রান্তে পেস্ট কালারের গেটটা দিয়ে যে এক পা এক পা করে মামার হাত ধরে প্রবেশ করেছিলাম, সেটা এখন আমি দুই পা দিয়ে উড়ে গিয়ে অতিক্রম করি শুধু। তাও কদাচিৎ, সব সময় না। আর মাঝেমধ্যে লোহার গেটটাকে খানিক নাড়াবার চেষ্টা করি।

ক্লাস শেষে সবাই যার যার বাসায় চলে যায়, কিন্তু ক্লাসরুম ও প্রাঙ্গণ সারা দিনই আমার নাগালে থাকে। আমি বিকেলবেলায় সেই সব অনুষঙ্গ আবার দেখতে বের হই। যাদের বাসা সেইখানেই কিন্তু পড়তে যায় অন্যখানে, এমন কয়েকজনের সঙ্গেই দেখা হয়, কথা হয়। স্মরণে এলে এখনো অনুভব করি, সকালবেলা সবার সঙ্গেই ভাগ করে নেওয়া জায়গাটা দুপুর গড়াইলেই কত একান্ত মনে হতো আমার! বড় গেটের ভেতরে আমরা যে বাসায় থাকতাম, তার সঙ্গেইই লাগোয়া আরেকটা দালান। কোথাও থেকে যখন আমি আব্বু–আম্মুর সঙ্গে ফিরতি পথে, আমরা রিকশা ঠিক করতাম—‘অ্যাই খালি, ৬৪ নম্বর কদমতলা যাবেন?’ সেই দুই দালানের মাঝখানে একটুখানি জায়গা, ওদিকের এক জানালায় খেলা দেখা যায়। খুব কাছে যাই না, একটু দূর থেকে দেখি কী চলে। তারপর দেখি দেয়াল, কেমন রং উঠে যাওয়া মলিন সাদা! হাত রাখি। তখনই দেখতে পাই সিমেন্ট একটু ফেটে গেছে, তার গহিনে টিকটিকিদের বসবাস। এই রকম আরও অনেকগুলো বসবাস ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে।

একদিন দুপুরবেলায় সবাই চলে গেলে আমি গলির সীমানা পার হই। কাঁধে ছিল ভারী ব্যাগ, বাসায় না উঠে গলির মুখ থেকে বের হয়ে একটু বাঁ পাশে এগিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তা দেখছিলাম। সেদিন অনেক আনন্দ করার পর বিষাদমাখা সময়টা আমার কাছে অন্য রকম লাগছিল। সহপাঠী সানজিদা আমার চেয়ে মেধাস্থানে পিছিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় হয়। সেদিন সে কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। টিফিনের সময় তো আমি মারাত্মক খুশি, সানজিদার দিকে তখন খেয়াল করিনি, ফল প্রকাশের পর আমি দৌড় দিয়ে বাসায় উঠি। আব্বু আদর দেয়, আম্মু আদর করে; খাওয়ায়। নাশতা শেষে সেই খুশিতে আবার নেমে আসি। তারপর আবার বাইরে যাই, আবার ভেতরে ঢুকি! কিন্তু হঠাৎ দেখি, কেউ দেখছে না যে সানজিদা মুখ লুকিয়ে কান্না করছে আর ওর পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুঝলামও যে নাশতাও করেনি। কোনো কথা মুখে এল না। তারপর একটার পর একটা ক্লাস হয়। আমি কিছু না বলে বারবার তাকাই, দেখি সানজিদা কেমন আছে। ছুটির পরও সান্ত্বনার কিছু ওকে আমার বলা হলো না।

গলির বাইরের সেই গতি। তারপর নানান আসা–যাওয়ায় স্বাভাবিক হয়ে আসে। বাচ্চা বাচ্চা আমাদের কথাবার্তায় অনেক বিষয় একে একে আসতে থাকে; ভেতরে নতুন অনেক কিছু দেখার শখ তৈরি হয়। দোকানে সাজানো জিনিসপত্র থেকে শুরু করে দোকানি কারা কী করছে, হাঁ করে দেখি।

রাস্তার ওইপাড়ে গিয়ে আমাদের গলি দেখি, বাসা দেখি।

জানালা দেখি।

দেখি খাম্বায় লাগানো হরেক বিজ্ঞাপন।

দেয়াললিখন দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে দৈনিক পত্রিকা—সেইখানে অনেক সংবাদ।

কিন্তু যেদিন দেখি রাস্তার পাশেই ঝিমাতে থাকা কুকুরটার পেটের ওপর দিয়ে একটা বেবি ট্যাক্সি ঘড়ঘড় করে চলে গেল, তারপর কিছু হাড্ডি হয়তো ভেঙে গিয়ে থাকবে, কারণ তার আর্তচিৎকার ছিল ভয়ানক, আশপাশ থেকে অনেকক্ষণ যাবত বড় কেউ আসছিল না। সেদিন তীব্রভাবে মনে হচ্ছিল, নিজের অনুভূতিকে বাগ মানাতে না পারার এই অসহায়ত্ব বহন করে আমি কতদূরই বা যাব!

রাতের বেলা বারবার শুনছিলাম গুলির শব্দ। কুকুরদের মিছিল। জানালার কাচ ভেদ করে কখন যেন এসে বেঁধে। বালিশ চাপা দিই। তখন মাত্রই আলাদা বিছানায় শোয়ার অভ্যাস শুরু হয়েছিল আমার। সব সাহস একত্র করে দুহাত বালিশের নিচে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকি। একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু স্বপ্নে দেখি, হলুদ ট্রাক আম্মুকে আহত করেছে। আম্মু কথা বলে না। ঘুমের মধ্যে বুক ভার হয়ে আসে। জেগে উঠে আমি ঠিক করি, এই জীবনে এত কিছু আমার আর দেখা লাগবে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র স আম দ র র ভ তর ত রপর র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নামে দেশে থাকা সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই নির্দেশ দেন। 

বিস্তারিত আসছে...

ঢাকা/রায়হান/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ