পাকিস্তানে ট্রেন অপহরণে জড়িত কারা এই সশস্ত্র যোদ্ধারা
Published: 13th, March 2025 GMT
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সাম্প্রতিক ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। মঙ্গলবার জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটি কোয়েটা থেকে পেশাওয়ার যাওয়ার পথে বেলুচিস্তানের একটি পাহাড়ি টানেলের কাছে সশস্ত্র বিএলএ যোদ্ধারা ট্রেনটি হাইজ্যাক করে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কয়েক ঘণ্টার সামরিক অভিযানের পর ট্রেনের ৩৪৬ যাত্রীকে উদ্ধার করে এবং ৩৩ জন হামলাকারীকে হত্যা করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জেনারেল আহমেদ শরীফ জানায়, এই অভিযানে ২৭ জন সাধারণ নাগরিক, ট্রেনের চালক এবং একজন আধা-সামরিক বাহিনীর সেনা সদস্য নিহত হন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএলএ তাদের হামলার মাত্রা ক্রমাগত বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে সংগঠনটি ১৫০টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ও চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে করা হয়েছে। তবে এই ট্রেন হাইজ্যাক ছিল সংগঠনটির অন্যতম বড় ও প্রকাশ্য হামলা।
বিএলএ কী এবং কেন এই হামলা?
বেলুচিস্তান,পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কিন্তু সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ প্রদেশ যা বহু বছর ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রদেশটি খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে কয়লা, সোনা, তামা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। তবুও এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর একটি।
বিএলএ পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যা সম্পূর্ণ স্বাধীন বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। সংগঠনটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে আত্মপ্রকাশ করে এবং ২০০০-এর দশকে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের দাবি, পাকিস্তান রাষ্ট্র বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে এবং স্থানীয় জনগণকে বঞ্চিত করছে।
বিএলএ-এর মূল দাবি ও লক্ষ্য
বিএলএ বরাবরই বলেছে যে তারা পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। যেখানে অন্যান্য বেলুচ জাতীয়তাবাদী দল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চায় সেখানে বিএলএ সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে।
পাকিস্তান সরকারের কাছে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন বেলুচিস্তান দাবি করে। তারা চায় পাকিস্তানের অধীন থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করতে।
প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা। সংগঠনটির মতে, বেলুচিস্তানের বিপুল খনিজ সম্পদ যেমন তামা, সোনা, গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বেলুচ জনগণের হাতে থাকা উচিত।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) ও গওয়াদার প্রকল্পের বিরোধিতা করেও তারা কাজ করছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের যৌথ উন্নয়ন প্রকল্প বিএলএ-এর অন্যতম প্রধান শত্রু। তারা মনে করে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে বেলুচিস্তানের সম্পদ লুট করছে।
এবং পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের প্রতিশোধ নিতেও তারা বদ্ধ পরিকর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে, যার ফলে অনেক বেলুচ নাগরিক নিখোঁজ বা নিহত হয়েছে। বিএলএ এই দমননীতির জবাব সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে দিচ্ছে।
কারা দিচ্ছে বিএলএ-এর নেতৃত্ব?
প্রথম দিকে বিএলএ-এর নেতৃত্ব ছিল বেলুচ উপজাতির মাররি গোষ্ঠীর হাতে। তবে বর্তমানে সংগঠনটি শিক্ষিত বেলুচদের নেতৃত্বে চলছে। বিএলএ বর্তমান প্রধান বশির জায়ব বালোচ। যিনি ২০১৮ সালে আসলাম বালোচ নিহত হওয়ার পর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর যার নাম জানা যায় তিনি হলেন হাম্মাল রেহান। তিনি মজিদ ব্রিগেড নামক আত্মঘাতী ইউনিটের প্রধান, যা চীনা নাগরিক ও পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনা করে।
এবং রেহমান গুল যিনি বালোচ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। রেহমান বিদ্রোহীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেন এবং তাদের আক্রমণের কৌশলগত দক্ষতা বাড়ান।
বিএলএ-এর অর্থায়নের মূলে কারা?
বিএলএ-এর অর্থায়নের মূল উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। মাদক পাচার ও চোরাচালান, কয়লা খনির থেকে অবৈধ টোল আদায়, বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচ অভিবাসীদের অনুদান, চীনা প্রকল্পের ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়।
তবে পাকিস্তান সরকার বারবার অভিযোগ করেছে যে ভারত বিএলএ-কে সমর্থন ও অর্থায়ন করে। যদিও এই দাবির পক্ষে শক্ত কোন প্রমাণ নেই।
কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই বিএলএ?
বিএলএ স্বাভাবিকভাবে তরুণ বেলুচদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তারা উচ্চশিক্ষিত বেলুচদের সংগঠনে যুক্ত করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানি সরকারের অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেলুচ জনগণের প্রতি বঞ্চনামূলক নিপীড়ননীতি এই সংগঠনের প্রতি বেলুচদের সমর্থন বৃদ্ধি করছে। যদিও বেলুচ নিখোঁজ ব্যক্তিদের আন্দোলনের ফলে অনেক তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাচ্ছে। বিএলএ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়ভাবে প্রচার চালায় এবং তাদের হামলার ভিডিও ও বিবৃতি প্রকাশ করে তরুণদের মধ্যে নিজেদের সংগঠনের শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
কেমন হতে পারে বিএলএ-এর ভবিষ্যৎ?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএলএ বিচ্ছিন্নভাবে হামলা করেই চলেছে বাড়িয়েছে। তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ছাড়াও চীনা প্রকল্পগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিএলএ দমনে কঠোর অভিযান চালাচ্ছে, যার ফলে সংগঠনটির অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠছে। তবে, পাকিস্তান সরকারের দমনমূলক নীতি অব্যাহত থাকলে এবং বেলুচিস্তানের জনগণের জন্য প্রকৃত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে, বিএলএ-এর মতো সংগঠনের প্রতি সহানুভূতি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিএলএ বর্তমানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। এর আগে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিএলএ বিদ্রোহীরা এক বাস থামিয়ে সাতজন পাঞ্জাবি যাত্রীকে হত্যা করে। ২০২৩ সালে সংগঠনের চালানো সমন্বিত হামলায় অন্তত ৩৯ জন নিহত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই জাতিগত পাঞ্জাবি ছিলেন। গত নভেম্বরে কোয়েটার প্রধান রেলস্টেশনে এক বোমা হামলার দায়ও বিএলএ স্বীকার করেছিল, যেখানে ১৪ জন সেনাসদস্যসহ মোট ২৬ জন নিহত হন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা এখন আরও সংগঠিত ও দক্ষতার সাথে হামলা চালাচ্ছে এবং চীনা নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কঠোর অভিযানের মাধ্যমে সংগঠনটিকে নির্মূল করতে চাইছে। সেনাবাহিনীর দাবি তারা বিএলএ-এর শক্তি দুর্বল করতে সক্ষম হচ্ছে।
তবে যদি পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানের উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা এবং বেলুচ জনগণের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে বিএলএ-এর মতো সংগঠন আরও শক্তিশালী হতে পারে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সশস ত র স গঠন প ক স ত ন সরক র প রকল প ব এলএ ব সশস ত র ব এলএ স স গঠন র স গঠনট জনগণ র
এছাড়াও পড়ুন:
গণতন্ত্রের গভীর অসুখ!
প্রায় এক শ বছর আগে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার কবি জীবনানন্দ দাশের কলমে ঝরে পড়েছিল পৃথিবীর গভীরতম ক্ষতের চিহ্ন, ‘সুচেতনা’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;’ যে গভীর গভীরতর অসুখের কথা কবিতার আখরে উঠে এসেছিল, পৃথিবীর সেই অসুখ কি সেরেছে? হয়তো সারেনি, বরং ডালপালা মেলে সেই সব অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পথে পথে। এই লেখার বিষয়বস্তু গণতন্ত্র, তাই একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পেরিয়ে এসে পৃথিবীর গণতন্ত্রের দিকে তাকালে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেন নবরূপে অনুরণিত হয়, ‘গণতন্ত্রের গভীর গভীরতর অসুখ এখন;’
গণতন্ত্র; যে শব্দ একদিন মানুষের অধিকার, সমতা ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, আজ তা যেন ক্রমেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ অভিঘাতে। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র এখন এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ছদ্মবেশী কর্তৃত্ববাদ, লোকরঞ্জনবাদ, গুজব-প্রচারণা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা যেন আজ এই শাসনব্যবস্থার প্রাণশক্তিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলছে! এই অসুখ শুধু রাষ্ট্রের কাঠামোতেই নয়, আমাদের সমাজের গভীরে, আমাদের চেতনার মূলে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মাটিতে, যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় এখনো সুদৃঢ়ই হয়নি, এই অসুখের প্রভাব আরও তীব্র। তবু প্রশ্ন জাগে, এই অসুখ কি নিরাময়যোগ্য? আমরা কি এখনো চেষ্টা করলে সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি না?
আরও পড়ুননেতারা দেশে গণতন্ত্র চান, দলে চান না০১ মার্চ ২০২৫আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বৈশ্বিক সূচকগুলো বলছে, পৃথিবীর ৭১% জনগণ এখন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাস করছে, যা এক দশক আগেও ছিল মাত্র ৪৮% (ভি-ডেম, ২০২৪)। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতার পালাবদলের সময় ক্যাপিটল হিলে কলঙ্কিত হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রথমবারের মতো ‘ব্যাকস্লাইডিং ডেমোক্রেসি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া)। সাম্প্রতিক কালেও ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আবার নির্বাচিত হয়ে এসে একের পর এক নির্বাহী আদেশে যেভাবে তাঁর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করে চলেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসেই বিরল। ট্র্যাম্প অবশ্য এবার শুধু নিজ দেশেই থেমে নেই, বাকি বিশ্বের ওপর ইচ্ছেমতো ট্যারিফ বসিয়ে প্রায় অর্থনৈতিক যুদ্ধই বাধিয়ে দিতে চলেছেন।
ফ্রিডম হাউস, ভি-ডেম ইনস্টিটিউট, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে নিয়মিতই উঠে আসছে নাগরিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার ও আইনের শাসন—সবই ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত। উন্নত ও ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্রও এই পতনের বাইরে নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কৌশলী ক্ষমতা দখল, জনতুষ্টিবাদ, তথ্য বিকৃতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করাই এসব সংকটের মূল কারণ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনোই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দলীয় সংঘাতের ছায়ায় গণতন্ত্রের স্বপ্ন যেভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ব্যক্তিপূজা, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলান্ধতা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছে।গণতন্ত্রের সুলুক সন্ধানে যাওয়ার আগে একটা মজার গল্প শোনা যাক। ‘একটি ছাগল শহরের চত্বরে ঘাস খেতে পারবে কি না’ তা নির্ধারণে দূরদেশ আইসল্যান্ডের ছোট্ট শহরে একবার অদ্ভুত এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের জোর কদম প্রচারণা শেষে ভোট গণনা করে দেখা গেল, ছাগলের পক্ষেই বেশি ভোট পড়েছে! অভাবনীয় সেই ছাগল–কাণ্ড শেষে স্থানীয় এক বাসিন্দা নাকি মন্তব্য করেছিল, ‘এটাই গণতন্ত্র, কখনো কখনো ছাগলও জিতে যায়’!
গণতন্ত্র কী? এই প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের গোলকধাঁধায় নিয়ে যায়। এটি কি কেবল ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া? নাকি এটি একটি জীবনদর্শন, যেখানে প্রত্যেক মানুষের কণ্ঠস্বর সমান গুরুত্ব পায়? গণতন্ত্রের সূতিকাগার প্রাচীন গ্রিসের অনেক দার্শনিকের কাছেই গণতন্ত্র ছিল একটি সন্দেহজনক ধারণা। সক্রেটিস, প্লেটো, এমনকি অ্যারিস্টটলও বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, নীতিবোধ ও প্রজ্ঞা। তাঁদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রায়ই জনতুষ্টিবাদের ফাঁদে পড়ে, যেখানে ছলাকলা আর প্রোপাগান্ডা সত্যের ওপর বিজয়ী হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা সব সময় রাষ্ট্রের মঙ্গল বয়ে আনে না। প্লেটোর মতে, গণতন্ত্র মানুষের আবেগনির্ভর, অগভীর সিদ্ধান্তে গড়া এক অবয়ব। অ্যারিস্টটল তো আরেক ধাপ এগিয়ে গণতন্ত্রকে বলেছিলেন ‘গরিবতন্ত্র’! তাঁর মতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণের হাতে ক্ষমতা গেলে শাসন হবে আত্মকেন্দ্রিক, নীতিকেন্দ্রিক নয়। যদিও বর্তমান সময়ের উদার গণতন্ত্র মোটেও এতটা সরল নয়।
আরও পড়ুনযেখানেই বৈষম্য বাড়ছে, সেখানেই গণতন্ত্র মার খাচ্ছে১৪ জুলাই ২০২৪আধুনিক গণতন্ত্র এই প্রাচীন সমালোচনাকে অনেকাংশে অতিক্রম করেছে। আজকের উদার গণতন্ত্র কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, এটি সংখ্যালঘুদের অধিকারের নিশ্চয়তা, প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি জটিল কাঠামো। ফরাসি দার্শনিক আলবের কাম্যু বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠদের আইন নয়, বরং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা’। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে এই আদর্শ বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা।
গণতন্ত্রের সংকট এককভাবে কোনো জাতিরাষ্ট্রের সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক। তবে সমস্যার রূপ ও গভীরতা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনোই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দলীয় সংঘাতের ছায়ায় গণতন্ত্রের স্বপ্ন যেভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ব্যক্তিপূজা, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলান্ধতা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছে।
আরও পড়ুন‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নয়, সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করাই লক্ষ্য০৫ মে ২০২৫ব্যক্তিপূজার রাজনীতি এদেশীয় গণতন্ত্রের এক গভীরতর অসুখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে বাঙালির এই প্রবৃত্তির কথা লিখেছিলেন। আমরা প্রায়ই ব্যক্তিকে দেবত্ব দিয়ে ফেলি, তাঁর কথাকে অলঙ্ঘনীয় সত্য মনে করি। ব্যক্তিপূজা থেকেই উৎপত্তি হয় বংশপরম্পরার নেতৃত্বের। রাজনৈতিক দলগুলোয় যোগ্যতার চেয়ে বংশগত উত্তরাধিকার বেশি গুরুত্ব পায়। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিপরীত। এর ফলে নেতৃত্বের গুণাবলি, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নীতিবোধ প্রভৃতির মূল্যায়ন হয় না। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো নেতৃত্ব পরিবর্তনের সুযোগ, জবাবদিহিতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা। যখন একজন নেতা তাঁর কাজ নয়, বরং পরিচয় বা বংশের কারণে অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠেন, তখন সেখানে গণতন্ত্র কেবল নামেই টিকে থাকে।
আজকের বাস্তবতায় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মধ্যে অন্যতম জনতুষ্টিবাদ, মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ও গুজব। নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যম যাদের নিয়ন্ত্রণে, জনমতও তাদের নিয়ন্ত্রণে’। এই যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার নতুন করে গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন একটি মিথ্যা খবর কয়েক মিনিটেই লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।
অন্যদিকে জনতুষ্টিবাদী নেতারা জনতার মন পেতে দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের কথা না ভেবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেন, যেমনঃ ভর্তুকি, সাময়িক সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ ইত্যাদি। যেসব দেশে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী নয়, সেখানে এই জনতুষ্টিবাদ আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। তখন নেতারা জনতার পক্ষের দাবি নিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তারপর নিজেদের সুবিধামতো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে ফেলেন। জনতুষ্টিবাদ শুধু নীতিহীনতাকেই উৎসাহিত করে না, বরং জনগণের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তার অভাবকেও তীব্র করে।
সমকালীন বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এর চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উত্থান, মব সহিংসতা এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু সামনেই যেহেতু নির্বাচন, জনতুষ্টিবাদের ফাঁদে পড়া নতুন-পুরোনো অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই এসব বিষয়ে বেশ মৌন। গণমানুষের কাছে অপ্রিয় হতে পারে, এমন কোনো কথা বললে পাছে তাঁদের ভোট কমে যায়, অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচিত হয়ে পড়েন!
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দল থেকে কেন সংস্কার শুরু করা জরুরি০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—আব্রাহাম লিংকনের এই সংজ্ঞা সর্বজনীনভাবে গণতন্ত্রের শেষ কথা। লিংকনকে নিয়ে বিখ্যাত একটি কৌতুক স্মরণ করা যেতে পারে। যখন কেউ একজন তাঁকে গণতন্ত্র কী, জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি লেজকে পা বলি, তাতে কুকুরের কয়টি পা হবে?’ প্রশ্নকারী বললেন, ‘পাঁচটি।’ লিংকন বললেন, ‘না, লেজকে পা বললেও লেজ লেজই থাকে, পা হয়ে যায় না!’ লিংকন বোঝাতে চেয়েছিলেন যে গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং সত্যের অনুসন্ধান। বিষয়টা নিয়ে আমাদের জনগণ ও রাজনীতিবিদদের বিস্তর ভাবনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই গণতন্ত্র বলতে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসনই বুঝে থাকেন। আধুনিক উদার গণতন্ত্র মোটেই কেবল ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসন’ নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
গণতন্ত্র রক্ষার দায় শুধু শাসকের নয়, নাগরিকদেরও। জনগণ যদি দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে ‘ভোটতন্ত্র’ হয়ে যাবে। অথচ গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়, এটি অংশগ্রহণ, জবাবদিহি, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা; সব মিলিয়ে এক সম্মিলিত চেতনা। গণতন্ত্র কারও একার যাত্রাও নয়, এটি আমাদের সবার। এখানে একযোগে কাজ করতে হবে সবাইকে। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের আজকের চর্চার ওপর। গণতন্ত্র এক দিনে তৈরি হয় না। এটি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, প্রশ্নে প্রশ্নে, প্রতিবাদে, আলোচনায়, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধায়।
আমাদের সমাজ, আমাদের শিক্ষা, আমাদের রাজনীতি; সবকিছুর কেন্দ্রে যদি থাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হতে পারে একটি প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের পথ কঠিন, কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্যনীয় নয়। এটা অনেকটা নদীর মতো, কখনো তীর ভাঙে, কখনো গতি মন্থর হয়। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা আর সমষ্টিগত প্রচেষ্টা যদি আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, এই নদী একদিন নিশ্চয়ই সমুদ্রে গিয়ে মিশবে!
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র নিখুঁত তো নয়ই, এমনকি সবচেয়ে খারাপ ধরনের সরকার ব্যবস্থা। তবে বাকি যেসব ব্যবস্থা এর আগে ছিল বা আছে, সেগুলোর চেয়ে তুলনামূলক ভালো’! জীবনানন্দের যেই ‘সুচেতনা’ কবিতা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই কবিতার আরেকটি পঙ্ক্তি দিয়েই লেখাটা শেষ করা যাক, “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে!’
আশিনুর রেজা লেখক ও গবেষক
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব