ধর্ষণের শিকার দাবি করা নারীর বক্তব্য ওসির মুঠোফোনে ধারণের পর ফেসবুকে, সমালোচনা
Published: 18th, April 2025 GMT
বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ এবং মারধরের অভিযোগে ফেনীর এক বাসিন্দার বিরুদ্ধে জেলার সদর মডেল থানায় মামলা করেন থাইল্যান্ডের নাগরিক এক নারী। মামলায় আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই নারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুলিশের প্রশংসা করেন। প্রশংসাসূচক এই বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করেন ওসি, যা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
নিজেকে ধর্ষণের শিকার দাবি করা একজন নারীর ভিডিও এভাবে ধারণ করা এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ওই নারীর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে বলে দাবি আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওসির কক্ষে বসে পুলিশের প্রশংসা করে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন এক নারী। ফেসবুকে ভিডিওটির মন্তব্যের ঘরে ওই নারীকে কটাক্ষ করে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ফেনী টিমের সদস্য তন্বী সোম বলেন, ওই নারী নিজে ধর্ষণের শিকার এবং নির্যাতিত, এমন অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্যের ভিডিও এভাবে ওসির মুঠোফোনে ধারণ করা এবং তা পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুঃখজনক। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সংবেদনশীল এবং সতর্ক হতে হবে।
ফেনী জজ আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আদালতের অনুমতি ছাড়া পুলিশ এ ধরনের কোনো ভুক্তভোগীর বক্তব্যের ভিডিও ধারণ এবং সেটি কারও কাছে হস্তান্তর করতে পারে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার বিষয়টি তো পুলিশের এখতিয়ারেই নেই। সেটি ধন্যবাদজনিত বিষয় হলেও ভিডিও রেকর্ড করে বিতরণ করা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। পুলিশের এই বিষয়টি মামলার পরবর্তী শুনানিতে আদালতকে অবহিত করা হবে।’
বিদেশি ওই নারীর বক্তব্য নিজের মুঠোফোনে ধারণ করার কথা স্বীকার করেছেন ফেনী মডেল থানার ওসি মো.
গত সোমবার ফেনী সদর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি করা হয়। মামলাটিতে মোখসুদুর রহমান (৪৮) নামের একজন এবং অজ্ঞাতপরিচয় দুজনকে আসামি করেন থাইল্যান্ডের নাগরিক ওই নারী। মামলার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে মোখসুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, থাইল্যান্ডের বাসিন্দা ওই নারী হংকংয়ে ব্যবসা করতেন। এর সূত্রেই সেখানে মোখসুদুরের সঙ্গে পরিচয়। ভিসা জটিলতায় মোখসুদুর গ্রেপ্তার হয়ে হংকংয়ের কারাগারে ছিলেন। তখন তাঁকে কারামুক্ত হতে সাহায্য করেন ওই নারী। কারামুক্ত হয়ে মোখসুদুর রহমান বাংলাদেশে চলে আসেন। বিয়ের আশ্বাসে বাংলাদেশে ডেকে এনে গত বছরের ১২ অক্টোবর ওই নারীকে মোখসুদুর ধর্ষণ করেছেন বলে মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়।
মামলার এজাহারে এ ছাড়া অভিযোগ করা হয়, মোখসুদুরকে ব্যবসার জন্য ২ লাখ ১০ হাজার হংকং ডলার ও বেশ কিছু স্বর্ণালংকার দিয়েছেন ওই নারী। ধর্ষণের ঘটনার পর নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি এসব টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য মোখসুদুরকে বলেন। পুনরায় বাংলাদেশে এসে গত রোববার মোখসুদুরের বাড়িতে গেলে তাঁকে মারধর করে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ সময় ওই নারীর ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৭ মার্চ এক মাদ্রাসাছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে তাঁর মা ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানায় একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন। থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জিজ্ঞাসাবাদের নামে ওই মাদ্রাসাছাত্রীর বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড করেন। পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় সাইবার আইনে মামলা হলে সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের আট বছরের কারাদণ্ড হয়।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনকে ফেসবুকে হুমকি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মুখ্য সংগঠক মোত্তাসিন বিশ্বাস। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে এ হুমকি দেন তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আনোয়ার হোসেন।
ফেসবুক পোস্টে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের দুটি ছবি লাল দাগ দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেন মোত্তাসিন। ক্যাপশনে তিনি আনোয়ার হোসেনের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘....সত্য লিখুন, না হলে আপনিও ছাড় পাবেন না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
মোত্তাসিন বিশ্বাসের পোস্টের পর মন্তব্যের ঘরে আনোয়ার হোসেনকে একাধিক আইডি থেকে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার বেলা ৩টা ১৬ মিনিটে মোত্তাসিনের আইডি থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পর পোস্টটি তাঁর ওয়ালে আবার দেখা যায়। এ হুমকির প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ’।
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে মোত্তাসিন বিশ্বাস আজ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক পোস্টে হলুদ কথাটা লেখা ঠিক হয়নি। এটি গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের শহীদ সাটু অডিটরিয়ামে জেলা পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাধা দিয়ে থামিয়ে দেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘পুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ খবরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েই এমন পোস্ট করেছেন বলে জানিয়েছেন মোত্তাসিন।
তাৎক্ষণিকভাবে লিখে ফেলেছিলেন, পরে মুছে দিয়েছেন। আনোয়ার হোসেনের করা কোন সংবাদটির বিষয়ে পোস্ট করেছেন, জানতে চাইলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাকে বাধা দেওয়ার সংবাদটির কথা জানান।
মোত্তাসিন বিশ্বাস আরও বলেন, প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন চব্বিশের আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু সংবাদটি এভাবে কেন লিখেছেন, তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি তাঁদের এড়িয়ে গেছেন। সে জন্যই তিনি ফেসবুকে লিখেছেন।
আনোয়ার হোসেন জিডিতে উল্লেখ করেছেন, স্ট্যাটাসে তাঁর দুটি ছবি ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই পোস্টে মোত্তাসিনের অনুসারীসহ আরও অনেকে খারাপ মন্তব্য করে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় জিডি করার কথা জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন। এটি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আবদুর রাহিম বলেন, এই পোস্ট দেওয়ার পর রাতে তাঁরা এটি নিয়ে সভা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পোস্টটি ডিলিট করা হবে।
আরও পড়ুনপুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা২৭ এপ্রিল ২০২৫সাংবাদিক সমাজের নিন্দা-প্রতিবাদআনোয়ার হোসেনকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় জরুরি সভা করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ। বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গতকাল মঙ্গলবারের সভায়। অবহিত করার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাবতীয় সংবাদ বর্জন করা হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিটিজেএ) সভাপতি রফিকুল আলম। উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রেসক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিটিজেএর নেতা ও সদস্যরা।
সভার পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশে একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে আপত্তিজনক ও হুমকিস্বরূপ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব অধিকারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বাক্স্বাধীনতার অধিকার। একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে ফেসবুকে এমন পোস্ট সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ, যা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত করেছে।’ অবিলম্বে মোত্তাসিন বিশ্বাস তাঁর দেওয়া পোস্টটি প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ না করলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।