নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই প্রান্তে আতঙ্কে মানুষ, ঘরছাড়া অনেকে, শিশুরা কাঁদছে
Published: 10th, May 2025 GMT
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার পর গত তিন দিনে নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই পাশের গ্রাম-শহরগুলোর বাসিন্দাদের দিন-রাত কাটছে আতঙ্কে। সীমান্ত এলাকার বহু মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শিশুরা কান্নাকাটি করছে।
বিবিসির সংবাদদাতারা দুই দেশের গ্রাম-শহরগুলোতে দেখেছেন, বসতবাড়ির মধ্যে গোলা পড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক বাড়ি। কোথাও আবার গোটা শহরই প্রায় খালি করে পালিয়েছে মানুষ।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি আর কুপওয়ারায় গিয়েছিলেন বিবিসির আমীর পীরজাদা। তিনি বলেন, ওই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ সীমান্তের অপর দিক থেকে গোলাগুলির ঘটনায় অভ্যস্ত।
তবে কুপওয়ারা ক্রালপোরা গ্রামের মানুষ কখনও দেখেননি যে, তাদের গ্রামে গোলা এসে পড়েছে। ‘জীবনে এই প্রথম আমাদের গ্রামে গোলা এসে পড়ল’, বিবিসিকে বলেছেন গ্রামটির বাসিন্দা তানভির আহমেদ।
গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে তার বাড়িতে একটা গোলা এসে পড়ে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার একটা ট্রাক ও মাটি কাটার যন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন, কারণ, পরিবারের সবাই মাত্র ৫০০ মিটার দূরে একটা আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গিয়েছিল। তাদের গ্রামে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য কোনো বাঙ্কার বানানো হয়নি।
উরি যেন এক ভূতুরে শহর
উরি শহরের বাসিন্দারাও বলছেন, এত বেশি সংখ্যায় গোলা পড়তে তারা কখনও দেখেননি। বিবিসিকে পাঠানো এক টেলিফোন ভয়েস মেসেজে উরির বাসিন্দা নিসার হুসেইন বলছেন, ‘আমরা একটা মসজিদের বেজমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এটা বছর দশেক আগে বানানো হয়েছে। সকালে যখন বাড়ির দিকে যাই; দেখতে পাই, আমার বাড়ির আশপাশেই তিনটা গোলা পড়েছে। বাড়ির কিছুটা অংশ ভেঙ্গে গেছে।’
একই দৃশ্য দেখেছেন বিবিসির আরেক সংবাদদাতা ডেভিনা গুপ্তা। তিনি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার সুরানকোটে গিয়েছিলেন। তিনি বলছেন, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ব্যাপক গোলাবর্ষণের ফলে পুঞ্চ জেলার বহু মানুষ এখন ঘরছাড়া।
বুধবার মাঝরাতের পরে পাকিস্তানে ভারতীয় হামলার পর থেকে গোলাবর্ষণ বহুগুণ বেড়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সোবিয়া নামের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেছেন, ‘হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে একমাসের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াই আমি। এতে শিশুটি কান্নাকাটি করছে, তাকে থামানো যাচ্ছে না।’
সুরফিন আখতারের বাড়ির সামনেই একটা গোলা এসে পড়েছিল। তারপরেই ঘর থেকে পালিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ‘একটাও গাড়ি পাওয়া যায়নি। বহুদূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়েছে। এত গোলাবর্ষণ হচ্ছিল যে, পুরো রাস্তা আমি ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটেছি। নিজেও কেঁদেছি, সঙ্গে শিশুও।’
অন্য প্রান্তেও একই চিত্র
নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারতীয় অংশে যেমন সুরফিন আখতার সারা রাস্তা কেঁদেছেন, পাকিস্তানের দিকে চাকোঠি গ্রামের বেশিরভাগ কমবয়সী নারী আর শিশুরা সারা রাত কেঁদেছেন। বিবিসির তাবান্ডা কোকাবকে বলছিলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা কিফায়াত হুসেইন। তিনি বলেন, ‘ওরা তো জীবনে এত বেশি গোলাবর্ষণ দেখেনি। এর আগে এত বেশী গোলাবর্ষণ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, তখন তো শিশুরা কেউ জন্মায়নি।’
৬ মে রাতটা তিনি পরিবারকে নিয়ে একটা সিমেন্ট ঢালাই করা বাথরুমে বসে কাটিয়েছেন কিফায়াত।
চাকোঠিসহ পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বেশিরভাগ গ্রামের বাড়িতে ২০০৫ সালে ভূমিকম্পর পর থেকেই টিনের ছাদ দেওয়া হয়। ওই সব ছাদ গোলাগুলি একেবারেই আটকাতে সক্ষম নয়। কিফায়াত বলছিলেন, ‘গোলাগুলি শুরু হতেই সব বাসন আর অন্যান্য জিনিসপত্র মাটিতে আছড়ে পড়তে শুরু করল; আর শিশুরা খুব জোরে কাঁদতে শুরু করল।’
বাজারেও যাচ্ছি না
পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজফ্ফরাবাদে রয়েছেন বিবিসির ফারহাত জাভেদ। নিয়ন্ত্রণ রেখার ধারে নীলম উপত্যকা থেকে সম্প্রতি মুজফ্ফরাবাদ শহরে পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন মুহাম্মদ শাগির। বাড়ির সামনে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার পরেই তিনি পরিবারকে নিয়ে সরে আসেন। তিনি বলছিলেন, ‘বাচ্চারা, বিশেষ করে শিশুরা ব্যাপক ভয় পেয়ে গিয়েছিল।’
মুহাম্মদ শাগির বলেন, ‘আমরা ওদের শুধু বোঝাচ্ছিলাম যে, একটা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাব। রাতটা খুব ভয়াবহ ছিল। পরের দিন সকালেই আমি বাচ্চাদের নিয়ে পাশের শহরে বোনের বাড়িতে চলে যাই।’
মুহাম্মদ শাগির অবশ্য এখনও শহর ছেড়ে যাননি, তবে তার পরিবার ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখেছে, যদি কিছু হয় তাহলে যাতে সঙ্গে সঙ্গেই পালাতে পারেন তারা। তার কথায়, ‘আগে থেকে তো বলা যায় না কখন কী হয়। আমরা শহরে থাকি; আর চারদিকে প্রচুর সামরিক স্থাপনা রয়েছে। আমরা তো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি না, এমনকি বাজারেও যাচ্ছি না।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
থ্যালাসেমিয়া কী জানে না ৮১.৬ শতাংশ মানুষ
থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। দেশের ১১.৪ শতাংশ মানুষ এ রোগের বাহক। তবে দেশের ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের এই রোগ সম্পর্কে ধারণা নেই। এমনকি ৯৬ শতাংশ মানুষ জীবনে কখনও এই রোগ শনাক্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় থ্যালাসেমিয়া জরিপ ২০২৪-এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে সারাদেশের ৮ হাজার ৬৮০ মানুষের সাক্ষাৎকার ও রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে।
রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগে অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় বলে লোহিত রক্তকণিকা সময়ের আগেই ভেঙে যায়। ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী এক কথা নয়। মা-বাবা দু’জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার পরামর্শ তাদের। সচেতন হলে এই রোগ প্রতিরোধ সহজ।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণগুলো হলো– ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ঘন ঘন রোগ সংক্রমণ, শিশুর ওজন না বাড়া, জন্ডিস, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি। থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, বছরে এ রোগ নিয়ে সাত হাজার শিশুর জন্ম হয়। তবে জন্মের এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন) করে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব।
এ অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীদের অধিকার নিশ্চিত করি’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসকারিভাবে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
জাতীয় থ্যালাসেমিয়া জরিপ বলছে, থ্যালাসেমিয়া রোগের বিষয়ে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের ধারণা কম। গ্রামের ৮৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এই রোগের বিষয়ে জানে না এবং শহরে এ হার ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিভাগের দিক থেকে থ্যালাসেমিয়া রোগের বিষয়ে ধারণা কম ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষের। এই বিভাগের ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ এই রোগের বিষয়ে কিছুই জানে না।
জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই রোগ শনাক্তে দেশের ৯৬ শতাংশ মানুষ জীবনে একবারও পরীক্ষা করায়নি। ৪ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন রোগের প্রয়োজনে এই পরীক্ষা করিয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিক দিয়ে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে। ৯৫ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ কখনও একবারও পরীক্ষা করায়নি এবং নারীর এই হার ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ। বিভাগ অনুযায়ী খুলনা বিভাগের মানুষ সবচেয়ে কম থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করিয়েছে। এই বিভাগে জরিপে অংশ নেওয়া ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ জীবনে কখনও থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করায়নি। এই দিক থেকে রংপুরে অবস্থান কিছু ভালো। রংপুর বিভাগে ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ কখনও পরীক্ষা করায়নি।
জরিপে দেখা গেছে, এই বাহকদের মাঝে ১৪ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মাঝে ১২ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মাঝে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মাঝে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির সভাপতি এম এ মতিন বলেন, থ্যালাসেমিয়া রোগী এ বাহক শনাক্তে শিশু জন্মের পর পরীক্ষা ও জাতীয় পরিচয়পত্রে এটি উল্লেখ করা। বিয়ের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে কাজী বিয়ে পড়াবেন। এই নীতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এখনও এমন নীতি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এই রোগ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণে অনেকবার তাগিদ দিলেও বাস্তবে এটি করা সম্ভব হয়নি।
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও মুগদা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস সমকালকে বলেন, দেশে ৬০ হাজারের বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তখনই সন্তানের এ রোগ হতে পারে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দু’জনের একজন যদি বাহক হন এবং অন্যজন সুস্থ হন, তাহলে কখনও এ রোগ হবে না। তাই বিয়ের আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা, তা সবারই জেনে নেওয়া দরকার।