প্রযুক্তির সর্বসাম্প্রতিক উদ্ভাবন বিষয়ে বিশ্বের দু’জন শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক এবং জ্যাক মার একটি মুখোমুখি কথোপকথনের চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। দু’জনেই তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। দু’জনের বক্তব্য দু’রকমেরই শুধু নয়; পরস্পরবিরোধীও বটে। ইলন মাস্কের শঙ্কা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ফলে এক সময়ে পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিণতিটা দাঁড়াবে এই, মানুষকে বসবাসের জন্য বিকল্প স্থান খুঁজতে হবে। মঙ্গল গ্রহ হতে পারে তেমন একটি বিকল্প। জ্যাক মা অমনটা মনে করেন না। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্মার্ট হবে ঠিকই, কিন্তু মানুষ তার নিজের ওই স্মার্ট সৃষ্টির চেয়েও অধিক স্মার্ট থাকবে, এখন যেমন রয়েছে। ফলে মানুষই যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে; যন্ত্র মানুষকে সেবা করার কাজ চালিয়ে যাবে। জ্যাক মা কমিউনিস্ট বিশ্বে বড় হয়েছেন। সে জন্যই হয়তো মানুষের মানবিক ক্ষমতায় এখনও আস্থা হারাননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইলন মাস্কের সে আস্থাটা নেই। তবে তারা দু’জনেই বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবনের সুফল যা পাওয়া যাবে তা নিজের দিকে টেনে নিতে কসুর করবেন না। ইলন মাস্ক তো ইতোমধ্যে মঙ্গল গ্রহে বসবাস স্থাপনের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাতেও অর্থ বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন। গাছেরটা এবং তলারটা, কোনোটাকেই ইলন মাস্ক হাতছাড়া হতে দেবেন না। 

জ্যাক মা যে প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের অবস্থার উন্নয়নে আস্থা রাখেন, তার অবশ্য একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। সেটা এই যে, প্রযুক্তি এ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে গায়ে পড়ে শত্রুতা করেনি; মানুষকে সাহায্যই করেছে। বাষ্পীয় শক্তি, বিদ্যুৎ, কম্পিউটার– এগুলো আগের তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটানোর পেছনে সক্ষমতা জুগিয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ওই ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে– এমনটাই তাঁর আশা। তবে প্রযুক্তির উপকারী চরিত্রের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের সংশয় যে নেই, তা তো নয়। বিলক্ষণ রয়েছে। একটা কথা তো স্থূল সত্য, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যেভাবে গণহত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে– তা মোটেই আশাবাচক নয়। এর দায় অবশ্য প্রযুক্তির নয়, মানুষেরই। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে প্রযুক্তির মালিকদের। প্রযুক্তি নৈতিকতার শিক্ষা দেয় না; নৈতিকতার ব্যাপারটা পুরোপুরি মানবিক। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ মানুষকে মারবে কি মানুষের সুখ বৃদ্ধি ঘটাবে– সেই সিদ্ধান্ত যন্ত্র নেয় না, যন্ত্রের মালিকরাই নিয়ে থাকেন।

জ্যাক মা বলেছেন, কম্পিউটারে শুধু চিপ থাকে; মানুষের থাকে হৃদয়। খুবই সত্য কথা। কিন্তু শঙ্কাটা এই যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হৃদয়ের ব্যবহার কমিয়ে দেবে। এখানে যে প্রশ্নটা একেবারে প্রাথমিক, এই প্রযুক্তির মালিকানা কার হাতে থাকবে? গোটা ব্যবস্থাই তো পুঁজিবাদী এবং এতে মালিক তিনিই হবেন, যার দখলে পুঁজি রয়েছে। মালিক হবেন ইলন মাস্ক ও জ্যাক মার মতো ব্যক্তিরাই, যারা হৃদয়ের নির্দেশ দ্বারা নয়, মুনাফালিপ্সা দ্বারাই পরিচালিত হবেন। বিশ্বের সর্বত্র আজ দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্র পথ ছেড়ে দিচ্ছে কতিপয়তন্ত্রের জন্য। কতিপয়তন্ত্র ধনীদের সংঘ। আগামীতে তাদের এই অগ্রযাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। 
পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর এক বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে পদার্থবিজ্ঞান কাজ করে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবেই সত্য। সত্য এটাও যে, পদার্থবিজ্ঞান মস্তিষ্ককে কৃত্রিম করে না, তাকে সজীব ও কার্যকর রাখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও পদার্থবিজ্ঞানের অবদান হিসেবে আবির্ভূত। কিন্তু নতুন উদ্ভাবনাটির বেলাতে যেটা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা তা হলো, পদার্থই প্রাণবান হয়ে উঠছে, মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের প্রাণকে দমিয়ে দিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আচরণটি রূপকথার সেই দৈত্যের মতো দাঁড়াতে পারে, যে বলত কাজ দে, নইলে ঘাড় মটকাব। এমনটা ঘটলে মালিকরা সতত কর্মপ্রার্থী যন্ত্রটির তুষ্টিসাধনে ব্যস্ত থাকবেন এবং তেমন সব কাজেরই জোগান দেবেন, যা মুনাফা আনবে। আর সেসব কাজ দাঁড়াবে চলমান তিন ধরনের গণহত্যার একটি কিংবা একসঙ্গে তিনটিরই সহযোগী। 
বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারগুলোর একটি, জীবের মতো জড়েরও সাড়া দেবার সক্ষমতা রয়েছে। জগদীশচন্দ্র বসু দেখালেন, একটি টিন, গাছের একটি ডগা এবং ব্যাঙের একটি পেশি– এরা সবাই বাইরের উত্তেজনায় সাড়া দেয়। জগদীশচন্দ্র বসু এভাবে জীব-পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎদের একজন হয়ে রয়েছেন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে তো প্রাণের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে যন্ত্র এবং যন্ত্র নিজেই হয়তো আরও উন্নত যন্ত্রের উদ্ভাবন ঘটাবে। হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঘটে আরও অনেক আধুনিক ও স্মার্ট যন্ত্রের উদ্ভাবন জমা হয়ে রয়েছে।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে এলিয়েনদের রাজত্বের কথা শোনা গেছে। প্রযুক্তির গড়া নতুন পৃথিবীতে হয়তো এলিয়নদেরই রাজত্ব কায়েম হবে। তবে তারা ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে আসবে না। তৈরি হবে আমাদের এই গ্রহেই এবং তৈরি করবে অন্য কেউ নয়; মানুষ নিজেই; নিজের মাথা খাটিয়ে। যন্ত্রসভ্যতার সেই ভয়াবহ সময়ে এলিয়েনদের ভয়ে মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। কিন্তু পালাবে কোথায়? ইলন মাস্ক জানাচ্ছেন, পালাবে মঙ্গল গ্রহে। কিন্তু সেখানে যাবার খরচপাতি তো আছে, সেটা কে জোগাবে? নিশ্চয়ই মাস্ক সাহেব জোগাবেন না। খরচপাতি তারাই করতে পারবেন, যারা ধনী। বাকিরা কী করবেন? সে কথার উত্তর মাস্ক সাহেবরা দেবেন না। ওইসব ব্যাপারে তাদের মুখের মাস্ক অবিচলিতই থাকবে। 

খুব স্থূল শঙ্কা এটাও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈপ্লবিক শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দেবে। দশজনের কাজ যদি তিনজনে করতে পারে তাহলে বাকি সাতজনকে কে যাবে নিয়োগ দিতে? ওই সাতজন তখন কী করবে? তারা তো কেবল বেকার নয়, প্রথমে অপ্রয়োজনীয় পরে বোঝা হয়ে দেখা দেবে।  

নানা বিবেচনাতেই তাই সতর্কতা প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যারা প্রতিযোগিতামূলক বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন, তাদের জানানো দরকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবশ্যকতা আমরা মানি, প্রয়োগও চাই, কিন্তু তার শাসন চাই না। সে জন্য ওই ক্ষেত্রে বিনিয়োগটা কমিয়ে বরং মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর ব্যাপারে টাকা খরচ করুন। 
বলাই বাহুল্য, এসব নীতিকথা পুঁজির মালিকরা শুনবেন না। যারা হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান সেই মানুষদের কর্তব্য প্রতিবাদী আওয়াজ তোলা এবং আওয়াজটাকে জোরদার করা। তবে কাজটা বিচ্ছিন্নভাবে করলে কুলাবে না। করতে হবে সংঘবদ্ধভাবে। তার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি দরকার হবে। যে প্রস্তুতির লক্ষ্য থাকবে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাকে হটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। ওই লক্ষ্য অর্জনে চাই সামাজিক বিপ্লব; প্রতিটি দেশে এবং সারাবিশ্বে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের তুলনায় এখন যা অধিক ও আশু প্রয়োজন তা হলো, সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাকে হটিয়ে সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ পুঁজিবাদকে বিদায় করে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত র ইলন ম স ক ব যবহ র র জন য বসব স ক ষমত র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সাড়ে ৩ ঘণ্টায় খুলনা থেকে ঢাকা, যাত্রাবাড়ীতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা

গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল নয়টায় খুলনা থেকে বাস চালিয়ে দুপুর সাড়ে বারোটায় যাত্রাবাড়ী পৌঁছেছেন চালক রমজান আলী। দুপুর দেড়টার দিকেও তাঁকে আটকে থাকতে দেখা যায় যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়কের গুলিস্তান টোল প্লাজায়। চোখমুখে ক্লান্তি। মাঝেমাঝেই এলোপাতাড়ি হর্ন দিচ্ছিলেন। তাতে অবশ্য কাজ হচ্ছিল না। বাসের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখা গেল, প্রায় সব যাত্রীর চোখেমুখে ক্লান্তি আর বিরক্তির ছাপ।
রমজান বললেন, ‘সাড়ে তিন ঘণ্টায় গাড়ি ঢাকায় আনলাম। কিন্তু আগে আগে ঢাকা পৌঁছে তো লাভ হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্লাইওভারেই বসে থাকি।’

৪ অক্টোবর বেলা ১১টা। যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে গুলিস্তানগামী একটি পরিবহন প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে যাত্রাবাড়ী মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, সামনে সারি সারি বাস, ট্রাক, রিকশা এবং মোটরসাইকেল থেমে আছে। বিরক্ত হয়ে অনেক যাত্রীই বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছেন। বাস থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে দেখা গেল, বিপরীত পাশের সড়কে বিরাট আকারের একটি কার্গো ট্রাক দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে উল্টে পড়ে আছে। সেটিকে টেনে তোলার কাজ চলছে। সড়কের ওই লেনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই লেনের যানবাহনগুলো হঠাৎই উল্টো সড়কে চলে এসেছে। ফলে যাওয়া–আসা উভয় দিকের রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেছে। সেই জট ছড়িয়ে পড়েছে যাত্রাবাড়ীর অলিগলিতেও।

৪ অক্টোবর রাত ১০টা। মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীগামী একটি পরিবহন আটকে আছে সায়েদাবাদ রেলগেটের কিছুটা আগে। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে গাড়ি নড়ছেই না। মধ্যবয়সী একজন যাত্রী বিরক্ত মুখে বারবার জানালা দিয়ে সামনে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বেশ কয়েকবার উঁকি দিয়ে পাশের যাত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘দেখেন, একটাও গাড়ি নেই, সব অটো (ব্যাটারিচালিত রিকশা)। রাস্তাটা কেমনে আটকায়ে রাখছে দেখেন।’

সারা দেশের প্রায় ৪০টি জেলার যানবাহন প্রতিদিন ঢাকায় প্রবেশের জন্য মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এবং ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই সড়কে যানবাহনের চাপ আরও বেড়েছে। তবে অপরিকল্পিত নকশা, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং ট্রাফিক আইন না মানার কারণে ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচের সড়কে তীব্র যানজট দেখা দিচ্ছে। এতে কম সময়ে ঢাকায় পৌঁছানোর সুফল অনেকাংশেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এই সড়কে নিয়মিত চলাচলকারীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার প্রকল্পের তথ্য বলছে, এটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার। ফ্লাইওভারটি শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান হয়ে চানখাঁরপুলকে সংযুক্ত করেছে।

সারা দেশের প্রায় ৪০টি জেলার যানবাহন প্রতিদিন ঢাকায় প্রবেশের জন্য মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এবং ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই সড়কে যানবাহনের চাপ আরও বেড়েছে।

মূলত শনির আখড়া, ডেমরা, সায়েদাবাদ ও দোলাইরপাড়—এই চারটি পয়েন্ট দিয়ে যানবাহনগুলো ফ্লাইওভারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের মতো ঢাকার পাশের জেলাসহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলার পরিবহনগুলো শনির আখড়া পয়েন্ট দিয়ে, সিলেট বিভাগ ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় জেলার পরিবহনগুলো ডেমরা পয়েন্ট দিয়ে এবং বরিশাল, খুলনা বিভাগসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহনগুলো দোলাইরপাড় পয়েন্ট দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ পয়েন্ট থেকেও প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চলের যানবাহন এই ফ্লাইওভার ব্যবহার করে ওঠানামা করছে।

এর বাইরে ঢাকার ভেতরের যাত্রাবাড়ী, দোলাইরপাড়, জুরাইন, ডেমরা, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড ও মাতুয়াইল এলাকায় বসবাসকারী মানুষও ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াতের জন্য এটি ব্যবহার করেন।

তিন অংশে স্থায়ী যানজট

গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবরের পর্যন্ত সরেজমিনে ফ্লাইওভারের চারটি প্রবেশমুখ ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি যানবাহন প্রবেশ করে ডেমরা ও দোলাইরপাড় পয়েন্ট দিয়ে। ব্যস্ত সময়ে গণপরিবহন এবং ব্যক্তিগত গাড়ি মিলিয়ে প্রতি মিনিটে এই দুই পয়েন্ট দিয়ে গড়ে ১২০টির বেশি যানবাহন প্রবেশ করতে দেখা গেছে। বাকি পয়েন্টগুলোতেও যানবাহন প্রবেশের হার প্রায় কাছাকাছি।

ফ্লাইওভারের তিনটি অংশে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। প্রথমটি ফ্লাইওভারে ওঠার অংশে। দ্বিতীয়টি সায়েদাবাদ অংশে এবং শেষে নামার সময় গুলিস্তান ও চানখাঁরপুল অংশে।

দোলাইরপাড় পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পরিবহনগুলো ফ্লাইওভারে ওঠার আগে সড়কে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। এতে মূল সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে শুরুতেই উড়ালসড়কের প্রবেশমুখে যানজটে পড়ে যানবাহনগুলো। এরপর সেগুলো উড়ালসড়কে উঠতে পারলেও সায়েদাবাদ অংশ থেকে শুরু হয় ধীরগতি, যা শেষ হয় একবারে গুলিস্তান ও চানখাঁরপুল পয়েন্টে।
সায়েদাবাদ অংশে ধীরগতির অন্যতম কারণ যানবাহনগুলোর টোল প্লাজা পার হতে ধীরগতি। এ ছাড়া ঢাকার ভেতরে চলাচল করা গণপরিবহনগুলোকে ফ্লাইওভারে বাস থামিয়ে যত্রতত্র যাত্রী ওঠাতে–নামাতেও দেখা গেছে, যা যানজট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।

এরপর নামার মুখে চার লেনের ফ্লাইওভার গুলিস্তানে দুই লেন এবং চানখাঁরপুলে এক লেন হয়ে নেমে গেছে। ফলে এই সরু দুই অংশ পার হতে দীর্ঘ সময় গাড়িগুলোকে আটকে থাকতে হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকা যাতায়াত করা বেসরকারি চাকরিজীবী লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোগান্তি বেশি হয় ফ্লাইওভার থেকে গুলিস্তান নামতে। কখনো কখনো এক–দেড় ঘণ্টাও লেগে যায়। এরপর গাড়িগুলোকে টোল কাউন্টার পার হতেও বেগ পেতে হয়। কারণ, টোল কাউন্টারের পর থেকে বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত সড়কটি হকারদের দখলে থাকে।’

ফ্লাইওভারের তিনটি অংশে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। প্রথমটি ফ্লাইওভারে ওঠার অংশে। দ্বিতীয়টি সায়েদাবাদ অংশে এবং শেষে নামার সময় গুলিস্তান ও চানখাঁরপুল অংশে।

গলার কাঁটা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল

যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভারের নিচেও একটি সড়ক রয়েছে। সেই সড়কের অবস্থাও বেহাল। সম্প্রতি সরেজমিনে যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সংস্কারের অভাবে জায়গায় জায়গায় সড়ক ভেঙে একাধিক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে পানি জমে যায়। আর শুষ্ক মৌসুমে চলে ধুলার রাজত্ব।

এই সড়কে যানজটের অন্যতম কারণ সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্য বলছে, ১৯৮৪ সালে গুলিস্তান কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালকে স্থানান্তর করার জন্য আনন্দবাজার, সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালীতে জমি দেওয়া হয়। তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালীতে তিনটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বর্তমান ধারণক্ষমতা অনুযায়ী, সেখানে ৭০০ থেকে ৮০০টি বাস রাখার অনুমোদন রয়েছে। তবে পরিবহনসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেখানে আড়াই থেকে তিন হাজার বাস রাখা হয়। চারদিকে সীমানাপ্রাচীরবেষ্টিত এই টার্মিনালের ভেতরে মাদকের আড্ডা বসে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরিবহন ব্যবসায় অদৃশ্য দালাল সিন্ডিকেটের কাছে মালিকপক্ষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে সায়েদাবাদ টার্মিনালের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি জাহাঙ্গীর শিকদার

টার্মিনালের বাইরে অবৈধভাবে শত শত পরিবহন কাউন্টার গড়ে উঠেছে। একেকটি পরিবহনের একাধিক কাউন্টারও দেখা গেছে। এসব কাউন্টারের সামনে থেকেই পরিবহনগুলো যাত্রী ওঠানামা করায়। অতিরিক্ত যাত্রী ধরতে বাসগুলো বেশির ভাগ সময় টার্মিনালের বাইরেই রাখা থাকে। ফলে মূল সড়কে চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এতে প্রায়ই তীব্র যানজট দেখা দেয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি জাহাঙ্গীর শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন ব্যবসায় অদৃশ্য দালাল সিন্ডিকেটের কাছে মালিকপক্ষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে সায়েদাবাদ টার্মিনালের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

ক্ষতি শুধু সময়ের নয়

২০২৩ সালে ‘রিডিউসিং পলিউশন ফর গ্রিন সিটি’ শীর্ষক এক জরিপ প্রকাশ করেছিল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাদের জরিপে বলা হয়েছিল, ঢাকার যাত্রীদের প্রতি দুই ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট যানজটে আটকে থাকতে হয়, যা বছরে জনপ্রতি প্রায় ২৭৬ ঘণ্টার সমান। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য তখন (২০২২) ছিল প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা।

বেসরকারি চাকরিজীবী রেজাউল করিমকে রায়েরবাগ থেকে কারওরানবাজার যেতে হয় প্রতিদিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্লাইওভার করা হয়েছে মানুষের সুবিধার জন্য। এত বড় দূরত্ব পনেরো মিনিটে পার হওয়ার জন্য। অথচ সেখানে নিয়মিত এক ঘণ্টার বেশি আটকে থাকা লাগে। নিচের সড়কে যানজটে পড়লে তবু বিকল্প সড়কের চিন্তা করা যায়। কিন্তু ফ্লাইওভারে একবার আটকা পড়লে না যেতে পারি সামনে, না পেছনে। লাভের থেকে তো ক্ষতিই বেশি।’

সমাধান কী

যানজট কমাতে হলে নিচের সড়কগুলোতে বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খানের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আধুনিক নগর পরিবহন পরিকল্পনায় ফ্লাইওভার নির্মাণকে উৎসাহিত করা হয় না। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে যানজট সমস্যার সমাধান করা যায়নি। বরং অনেক ফ্লাইওভারের ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম লেগে থাকে। ফ্লাইওভারের কারণে নিচের রাস্তার ট্রাফিক পরিচালন ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কমে গেছে।’

এই নগরপরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘ফ্লাইওভারের ওপর নতুন কিছু করার তেমন সুযোগ নেই। ফ্লাইওভারের নিচের সড়কগুলো সংস্কার করতে হবে, যেন ফ্লাইওভারে গাড়ির চাপ কমে আসে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশের নজরদারি বাড়াতে হবে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী জোনের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. আজাদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা চেষ্টা করছেন যাত্রাবাড়ীর নিচের সড়কের পাশে থাকা পরিবহন কাউন্টারগুলোকে সায়েদাবাস বাস টার্মিনালের ভেতরে নেওয়ার। পাশাপাশি এই অঞ্চলের যানজট কমাতে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

অবহেলা, ক্ষোভ

গত বছর জুলাই আন্দোলনের অন্যতম হটস্পট ছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা। সরকারি গেজেট অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে এই এলাকায়। সরকারি গেজেট অনুযায়ী, সেই সংখ্যা ১১৭। তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর এক বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এ এলাকা থেকে গেছে আগের মতোই নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টির আড়ালে। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে স্থানীয়দের মনে। তাঁদের অভিযোগ, ওপরে গাড়ি চলার কারণে নিচে সংস্কারকাজ করা হচ্ছে না। এতে নিচের রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট লেগে থাকে।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মো. আতিকুর রহমানের ভাই মো. সোলায়মান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ছিল রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তনের। যেখানে রাষ্ট্রেই পরিবর্তন এল না, সেখানে যাত্রাবাড়ীর পরিবর্তন কীভাবে আসবে? জুলাই অভ্যুত্থানে এই যাত্রাবাড়ীর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। অথচ এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এখনো যাত্রাবাড়ীর সড়কগুলো খানাখন্দে ভরা। আবর্জনার গন্ধে রাস্তায় চলা দায়!’

সম্পর্কিত নিবন্ধ