জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সেই সুপারিশ ঐকমত্য কমিশন থেকে পাওয়া গেছে। এই সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো। কারণ, সব কটি সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হতে পারেনি। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার অধিকাংশগুলোতেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ ভিন্নমত আছে। সেই ভিন্নমতসহ রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করেছে।

আমরা জানি যে গণভোটের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই সনদ বাস্তবায়ন হবে বা গণভোটের প্রশ্ন কী হবে (জনগণ কোন প্রশ্নের ওপর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবে), তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে তা পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই যৌক্তিক প্রশ্নও উঠছে যে কমিশনের প্রস্তাব দেশের রাজনীতিতে নতুন সংকটের সূচনা করল না তো?

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে গণভোটের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নটি পাওয়া গেছে। প্রশ্নটি এ রকম; ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই প্রশ্ন থেকে ‘খসড়া বিলের’ শব্দ দুটি প্রয়োজনে বাদও দেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে ভিন্নমত যুক্ত হয়েছিল, গণভোটে তা বিবেচনায় না নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। মানে জুলাই সনদের পক্ষে যদি জনগণ ভোট দেন, তবে ভিন্নমতগুলো আর বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

গণভোটের যে প্রশ্নটি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের সব মানুষ সংবিধান সংস্কারের ৪৮টি প্রস্তাব যথাযথভাবে জেনেবুঝে ভোট দেবেন, এমন না–ও হতে পারে। আর কেউ যদি প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে জেনেবুঝেও থাকেন, তা–ও দেখা যাবে একজন ভোটার হয়তো কিছু সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত আর কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে নয়। এতগুলো সংস্কার প্রস্তাব আসলে শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’–এর বিষয় নয়। দেখা যাচ্ছে, আপনাকে হয় ৪৮টি প্রশ্নের সবগুলোর সঙ্গে একমত হতে হবে অথবা সবগুলোকেই না বলতে হবে। গণভোটের প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয় না। ঐকমত্য কমিশন হয়তো তাদের করা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর পক্ষে বৈধতা আদায় করতে চেয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ গণভোটে পাস করার চেয়ে গণভোটের মাধ্যমে আগামী সংসদকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়াই হতো সবচেয়ে যৌক্তিক। গণভোটের প্রশ্নটি সেভাবে সাজানো যেত।

৮ অক্টোবর প্রথম আলোয় ‘গণভোট অপ্রয়োজনীয়, তবে এরপরও যদি হয়…’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের আগের তিনটি গণভোটের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের কোনো প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছিলাম। রাজনৈতিক দলগুলো এর আগেই গণভোটের ব্যাপারে একমত হয়ে গেছে। তাই ‘এরপরও যদি হয়.

..’ যুক্ত করে কিছু কথা বলেছিলাম। ‘গণভোটটি হওয়া উচিত জুলাই সনদের যে বিষয়গুলোয় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, তার ওপর এবং একটি প্রশ্নের ভিত্তিতে।’

আরও লিখেছিলাম, ‘সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত নিয়ে গণভোটের কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর এসব ভিন্নমতকে দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে দেখতে হবে। এসব বিবেচনায় নিয়েই জনগণ তাঁর দল বাছাই করবেন। নির্বাচিত দল তার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বিবেচনায় নিয়ে সংবিধান সংশোধন করবে। কারণ, কোনো দলের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া মানে তার অবস্থানের পক্ষেই জনগণ সমর্থন জানিয়েছে।’

জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব আছে ৪৮টি। এর মধ্যে না হলেও ৩৬টি প্রস্তাব নিয়ে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত আছে। জুলাই সনদে সেই ভিন্নমতগুলো যুক্ত করে এটা নিশ্চিত করা হয়েছিল যে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ভিন্নমতগুলো উল্লেখ করে যদি জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়, তবে তারা তাদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় শুধু সংস্কার প্রস্তাবগুলোই আছে। আদেশ অনুযায়ী নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংবিধান সংস্কার পরিষদকে ‘তফসিল ১–এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ’ অনুসারে সংবিধান সংস্কার করতে হবে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, কিছু দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও সনদ গণভোটে অনুমোদিত হলে সেভাবেই কার্যকর হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জিতে গেলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে।

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের যে বিষয়গুলোতে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে তার ওপর গণভোট হচ্ছে না। আবার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগও থাকছে না। গণভোটের ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনের এমন সুপারিশ নিয়ে প্রথম যে প্রশ্ন তোলা যায়, তা হচ্ছে ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর বিষয়গুলো যদি বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে, তবে জুলাই সনদে তা যুক্ত করা হয়েছিল কোন যুক্তিতে?

সংবিধান সংশোধনের কোনো ইস্যুতে জোরালো আপত্তি আছে এবং সেই ইস্যুতে ভিন্নমত জানানো কোনো দল যদি জাতীয় নির্বাচনে জিতে আসে, সেই দলটিকে কি পুরো সনদ বাস্তবায়নে আদৌ বাধ্য করা যাবে? দলটি তো বলতে পারে যে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে দলের অবস্থান জাতীয় নির্বাচনের আগেই তারা পরিষ্কার করেছে। জনগণ যদি সেই দলকেই নির্বাচিত করে, তাহলে তারা কেন তাদের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ পাবে না?

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন বা প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন না—সংবিধানের এমন সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। বিএনপির এই অবস্থানকে অযৌক্তিক এবং সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। কিন্তু ভালো মন্দ যাই হোক এটা দলটির অবস্থান এবং এর ব্যাপারে জুলাই সনদে তাদের ভিন্নমতের কথা লেখা আছে। এখন গণভোটে জুলাই সনদ পাস হলে এবং বিএনপি ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জিতে গেলে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটিকে এই সংশোধনী দুটি করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা কি আদৌ নিশ্চিত করা সম্ভব?

অন্যদিকে বিএনপি যদি জাতীয় নির্বাচনে জিতে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয় এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে না চায়, তখন গণভোটে বিএনপি এবং এর সমর্থকদের অবস্থান কী হবে? তারা কি জুলাই সনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? গণভোট নিয়ে রাজনীতিতে এরই মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্যের সুর বেজে উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে জনমনেও তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি।

আগের লেখায় লিখেছিলাম গণভোট অপ্রয়োজনীয়। সঙ্গে এটাও লিখেছিলাম, ‘গণভোট যদি করতেই হয়, তবে তা হওয়া উচিত জাতীয় নির্বাচনের পর। নির্বাচিত সরকার সংসদে গিয়ে জুলাই সনদের সব দলের একমত হওয়া বিষয় এবং নিজ দলের নোট অব ডিসেন্টের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করে তা রাষ্ট্রপতির সইয়ের জন্য পাঠানোর আগে একটি গণভোট আয়োজন করতে পারে।’

ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলসহ সমাজের নানা পক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খরচ ও পরিশ্রম করে যে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করেছে, তা মনে হচ্ছে গণভোট ইস্যুতে এসে হোঁচট খেতে যাচ্ছে। গণভোটের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত ফলদায়ক কিছু হবে বলে মনে হয় না। বরং জগাখিচুড়ি ধরনের সমাধানের চেষ্টা হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে।

গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ যত বাড়বে, গণভোটের ব্যাপারে মানুষ আগ্রহ হারাবে। এ ধরনের গণভোটে এমনিতেই উপস্থিতির হার খুব কম থাকে, কোনো রাজনৈতিক পক্ষের বর্জনের ডাক পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘অগ্রহণযোগ্য’ একটি গণভোট জুলাই গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বাধাগ্রস্ত হতে পারে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব জ ল ই জ ত য় সনদ গণভ ট র ব য প র ন ট অব ড স ন ট জ ল ই সনদ র প রস ত ব র র অবস থ ন ব ষয়গ ল ভ ন নমত অন য য় ত হয় ছ হয় ছ ল ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

ভোটারদের মনে আস্থা তৈরি করা সরকারের দায়িত্ব

আসন্ন নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ ও হামলার শঙ্কা প্রকাশ করে সরকারের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। নির্বাচন নিয়ে যদি কোনো চক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সরকারের দায়িত্ব এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আস্থা সৃষ্টি করা। সরকারকেই একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এত দিন ধরে আলোচনার পর এখন যদি বলা হয় যে হঠাৎ আক্রমণ আসতে পারে; এটা তো মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করবেই। নির্বাচনে যারা ঝামেলা তৈরি করতে চায়, এ ধরনের বক্তব্য তাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি করতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে নির্বাচনে সব বাধা অতিক্রম করার বক্তব্য জাতি আশা করে। তাঁর উচিত নির্বাচনে ঝুঁকি যাতে দূর হয়, সেটার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া। ভোটারদের মনে একটা আস্থা তৈরি করা।

নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার আরও শক্ত ভূমিকা নেওয়া উচিত। অন্যান্য বিষয়ে অনৈক্য থাকলেও নির্বাচন ঠিকমতো করার ব্যাপারে দলগুলো যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো সংকট যেন কেউ তৈরি করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সরকারকেই ভূমিকা নিতে হবে।

নির্বাচন এগিয়ে আনলে এ ধরনের ঝামেলাগুলো কম হতো। নির্বাচনকে সামনে রেখে এতগুলো এজেন্ডা নিয়ে আসা অযৌক্তিক। সব রাজনৈতিক দল সব বিষয়ে একমত হবে, এমন ভাবাটাও ঠিক নয়। রাজনৈতিক দলগুলো একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ নিয়ে চলে। সুতরাং সবাই তো সব বিষয়ে একমত হবে না।

ন্যূনতম জায়গায় ঐকমত্য তৈরি করে নির্বাচন করার বিষয়ে যে রকম গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ছিল, সেটার বিষয়ে সরকারের দিক থেকে গাফিলতি আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভোটারদের মনে আস্থা তৈরি করা সরকারের দায়িত্ব
  • দলগুলোর মতপার্থক্য সামনে এল আরও তীব্রভাবে
  • সংস্কার প্রতিবেদন সহজবোধ্য করে জনগণের কাছে তুলে ধরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
  • জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা: কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল
  • ইতিবাচক মনে করছে এনসিপি
  • জুলাই সনদ অনুযায়ীই সংবিধান সংস্কার করতে হবে: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে, জানুন ১০ প্রশ্নের উত্তরে
  • সংসদ ২৭০ দিনে ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে
  • সংসদ ২৭০ দিনে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তাবগুলো সংবিধানে যুক্ত হবে: আলী রীয়াজ