মঙ্গলবার গাজার দক্ষিণ শহর রাফায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশে ইসরায়েলি অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক ডজন আহত হন। এই হামলা এমন সময়ে হয়েছে, যার দুই দিন আগে একই স্থানে ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের হামলার শিকার হন হাজারো উদ্বিগ্ন ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি। সেখানে প্রাণ হারান ৩১ ফিলিস্তিনি। একই দিনে মধ্য গাজার নেটজারিক মরিডোরের কাছে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গাজার ২০ লাখ অনাহারী মানুষকে এখন মাত্র চারটি স্থানে খাবার বিতরণ করা হয়। তারা প্রায় তিন মাস ইসরায়েলি এমন ব্লকেডের মধ্যে ছিলেন, যেখানে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ১৯ মে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় ‘সীমিত’ ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেন। তাও তখন এই অনুমতি আসে যখন গণঅনাহার পরিস্থিতি এমন ‘লাল রেখা’য় পৌঁছে, যার পর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সংকটে পড়তে পারে; বস্তুত ইসরায়েলি অপরাধ ও গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এখনও এমন গণহত্যার কারণ হলো, ‘সীমিত’ পর্যায়ে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি, যার কারণে ফিলিস্তিনিরা এমন ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন, হয় ক্ষুধায় মারা যাবে, না-হয় খাবার না পাওয়ার জন্য মারা যাবে। শুধু এ দুই কারণে তারা মারা যাচ্ছে না। বরং ইসরায়েলি জেনোসাইডে যখন দেশটি নির্বিচারে হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরে এবং এর বাইরেও বোমা মারছে তখন ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৫৪ হাজার চার শতাধিক।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামে নতুন একটি সংগঠন পরিচালনা করে। এটি মূলত ইসরায়েলি উদ্ভাবিত বেসরকারি সংগঠন, যা সুইজারল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলওয়ার রাজ্যে নিবন্ধিত। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, জিএইচএফের ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য বিতরণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।’ অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, যেখানে সংগঠনটি সাবেক মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে।
সে জন্যই গাজায় খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এখন সশস্ত্র মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদারদের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়, যেখানে এগুলোর অবস্থান ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি সুবিধাজনক জায়গায়। বর্তমানে যে চারটি জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়, সেগুলো মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় অবস্থিত। অথচ গাজার উল্লেখযোগ্য মানুষ বাস করে উত্তর দিকে। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য অনেক ফিলিস্তিনিকে দীর্ঘ পথ হেঁটে ইসরায়েলি সামরিক সীমানা অতিক্রম করে যেতে হয়, যা তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে। সেখানে বয়স্ক, অসুস্থ বা আহত ফিলিস্তিনিদের খাবার বিতরণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। আর শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম, যারা এতদূর যেতে পারেন না, এমন ক্ষুধার্ত মানুষের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
অধিকন্তু জিএইচএফের উদ্যোগ ইসরায়েলের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করছে। তারা জীবিত ফিলিস্তিনিদের গাজার দক্ষিণাঞ্চলে জড়ো করার চেষ্টা করছে, যাতে পরে তাদের স্থায়ীভাবে বিতাড়ন সহজ হয়। এটি করা হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত নতুন গাজা পরিকল্পনা অনুসারে, যে পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি ব্যতীত অন্যদের নিয়ে অঞ্চল গড়ার লক্ষ্য রয়েছে। অন্যভাবে বললে, জিএইচএফ গাজার মানুষের ক্ষুধা নিবারণ বা স্থানীয়দের চাহিদা পূরণে কাজ করছে না; বরং তাদের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এমন এক চমকপ্রদ প্রচারণার আয়োজন, যা মানবিক বিপর্যয়ের নামে ইচ্ছাকৃত অনাহার ও গণহত্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তাকারী সংস্থা মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কড়া সমালোচনা করেছে। এমনকি এই পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, জিএইচএফের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক মার্কিন মেরিন স্নাইপার জেক উড পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বেলেন ফার্নান্দেজ: আলজাজিরার কলাম লেখক; ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর
মাহফুজুর রহমান মানিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত র ণ ব তরণ ক ন দ র য ক তর ষ ট র জ এইচএফ ইসর য় ল গণহত য ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ