আজকের দিনে প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এর ব্যবহার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠলে তা ভয়াবহ পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। প্লাস্টিক একেবারে বাদ দেওয়া কঠিন হলেও সচেতনতা, বিকল্প ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণ রোধ সম্ভব এবং এই পথে হাঁটতে পারলে দেশের অর্থনীতিতেও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে পারে।
ভয়াবহ বাস্তবতা
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮ লাখ ২১ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর বড় একটি অংশই সরাসরি খাল, নদী ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (২০১৯-২০) এক জরিপে দেখা যায়, বন্দরনগরীতে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ২৪৯ টনই প্লাস্টিক। এর এক-চতুর্থাংশ সংগ্রহ না হওয়ায় তা জলাবদ্ধতা ও দূষণের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) এক গবেষণা বলছে, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে শুধু জলজ পরিবেশে নয়– ভূমি, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলও পড়ছে হুমকির মুখে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হচ্ছে, যা বাতাস, খাবার ও পানির মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানবদেহে। ফলে বাড়ছে ক্যান্সার, ফুসফুস ও কিডনিজনিত রোগের ঝুঁকি। গবেষকদের মতে, মাইক্রোপ্লাস্টিক বলতে এমন কণাকে বোঝায় যার আকার ৫ মিলিমিটারের কম; যা সহজেই পরিবেশ ও শরীরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে শরীরে জমতে থাকলে তা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের প্রথম দেশ; যারা ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। উপকূলীয় এলাকায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তবু এসব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে খুব একটা কার্যকর হয়নি। নানা উদ্যোগ থাকলেও জনসচেতনতা এখনও আশানুরূপ নয়।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিকদূষণের কারণে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ সাগরে মাছের চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক! বর্তমানে বাংলাদেশ যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে ফেলে, তা বিশ্বে পঞ্চম সর্বোচ্চ। সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক গবেষণায় দেশের নদী, মাটি, মাছ এমনকি ধানেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ডিম্বাণু-শুক্রাণুতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে প্লাস্টিক কম দামি মনে হলেও পরিবেশ আর স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় মোটেও সাশ্রয়ী নয়। পলিথিন রোধ করতে হলে আইনের পাশাপাশি দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা।’
সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক: নিষেধাজ্ঞা আছে, প্রয়োগ নেই
যদিও একবার ব্যবহারযোগ্য বা সিঙ্গেল-ইউজ পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ; তবুও বাস্তবে এর উৎপাদন ও ব্যবহার চলছে বহাল তবিয়তে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় দেড় হাজারের বেশি অবৈধ পলিথিন কারখানা সক্রিয় রয়েছে; যার বড় অংশই পুরান ঢাকা ও গাজীপুর এলাকায়। বর্তমানে দেশে প্রায় ২,৫০০ ধরনের প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদিত হয় এবং প্রতিবছর ১৪ লাখ ৯ হাজার টন ভার্জিন প্লাস্টিক রেজিন আমদানি করা হয়।
সংকটের মধ্যেই সম্ভাবনার আলো: চক্রাকার অর্থনীতি
এই দুঃসহ বাস্তবতার মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে এক নতুন সম্ভাবনা–চক্রাকার অর্থনীতি বা সার্কুলার ইকোনমি। এটি এমন একটি মডেল, যেখানে ব্যবহার শেষে প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার ও পুনঃচক্রায়নের মাধ্যমে বর্জ্য কমানো হয়। শুধু তাই নয়, এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং নিম্নআয়ের মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের হার প্রায় ৩৭ শতাংশ, যা বৈশ্বিক গড় ৯ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি; এটি মূলত অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য খাতের শ্রমজীবী মানুষের অবদান। বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য খাত প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে; অথচ প্লাস্টিক সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই খাতে কর্মরত ব্যক্তিরা প্রতিদিন শহরের অলিগলিতে ঘুরে প্লাস্টিক, পলিথিন সংগ্রহ করেন, যা পরবর্তী সময়ে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়।
চট্টগ্রামের ভিন্ন উদ্যোগ
২০২২ সালে ইউনিলিভার বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও উন্নয়ন সংস্থা ইপসা’র একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীতে একটি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগ চালু হয়। লক্ষ্য ছিল নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডজুড়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৪ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যা চট্টগ্রামের মোট বর্জ্যের প্রায় ১০ শতাংশ। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তিন হাজারের বেশি বর্জ্যকর্মীকে। দুই হাজারের বেশি বর্জ্য সংগ্রাহক ও ২০০ জন ভাঙারিওয়ালা পেয়েছেন নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ। চালু হয়েছে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স কর্মসূচি, যার আওতায় দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ এবং চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার বাসিন্দা মো.
জনসচেতনতা বাড়ানোও এ উদ্যোগের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইতোমধ্যে ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। ৭১টি স্কুলের প্রায় সাত হাজার শিক্ষার্থী পেয়েছে বর্জ্য পৃথককরণ ও পুনর্ব্যবহারের প্রশিক্ষণ। নগরীর বিভিন্ন এলাকাজুড়ে ‘ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন’ পরিচালনার ফলে মানুষ এখন নিজের বাসাতেই পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করে রাখছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাত নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রোকাইয়া সুলতানা বলেন, ‘আগে পচনশীল ও অপচনশীল সব ময়লা একসঙ্গে রাখা হতো। এখন তা করা হয় না। পচনশীল ও অপচনশীল ময়লা আলাদা ড্রামে রাখা হয়। প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন আরেক পাত্রে রাখা হয়। প্রতিদিনের পৃথক করা এসব ময়লা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে নিয়ে যান।’
ইউনিলিভারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা প্লাস্টিক সংগ্রাহকেরা এ উদ্যোগের প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে একটি ন্যায্য ও টেকসই অর্থনৈতিক মডেল গড়ে তোলাই এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। প্লাস্টিকদূষণ রোধে ইউনিলিভার বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এটি একটি বাস্তব উদাহরণ, যেখানে সরকার, করপোরেট খাত এবং উন্নয়ন সংস্থা একসঙ্গে কাজ করে একটি টেকসই শহর নির্মাণে ভূমিকা রাখছে।
একটি কার্যকর চক্র: সংগ্রাহক থেকে রিসাইকলার
সরেজমিন দেখা যায়, উৎসস্থল ও বিভিন্ন খোলা উৎস থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য বিক্রি হয় স্থানীয় ছোট ভাঙারি দোকানে। সেখান থেকে তা যায় বড় রিসাইক্লিং কারখানায়। এরপর প্রক্রিয়াজাত প্লাস্টিক ফের বিক্রি হয় নতুন পণ্য তৈরির জন্য। এই চক্রে অংশ নিচ্ছে ১৪০টির বেশি রিসাইকলার প্রতিষ্ঠান; যারা এখন চট্টগ্রামে একটি কার্যকর সার্কুলার ইকোনমি গড়ে তুলেছে। দেশের সব শহরে চট্টগ্রামের মডেল ছড়িয়ে দিতে পারলে আমরা পেতে পারি একটি পরিচ্ছন্ন, পরিবেশবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের পথরেখা।
প্লাস্টিক সংকট একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, তবে স্থানীয় সমাধানের পথেই রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উত্তরণ। চট্টগ্রামের মডেলটি প্রমাণ করে–সরকারি, বেসরকারি ও নাগরিক সমাজ যদি হাতে হাত মিলিয়ে এগোয়, তবে বাংলাদেশও পারবে প্লাস্টিকদূষণ মোকাবিলায় একটি বৈশ্বিক উদাহরণ গড়ে তুলতে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ল স ট ক বর জ য প ল স ট ক বর জ য স গ বর জ য স গ র স গ র হক বর জ য ব হ জ র টন ব যবস থ র ব যবহ ব যবহ র ক র যকর পর ব শ পল থ ন ট কসই করপ র
এছাড়াও পড়ুন:
ঘোষণাপত্রে সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রতিবাদ গণফোরামের
জুলাই ঘোষণাপত্রে ১৯৭২–এর সংবিধান প্রণয়নপদ্ধতি এবং সাংগঠনিক কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাতে তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে গণফোরাম। বুধবার বিকেলে গণফোরাম সভাপতি পরিষদের এক সভায় এ নিন্দা জানানো হয়। গণফোরামের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান, সভাপতি পরিষদের সদস্য জগলুল হায়দার আফ্রিক, মোশতাক আহমেদ, মেজবাহ উদ্দিন, সেলিম আকবর, সুরাইয়া বেগম, শাহ নূরুজ্জামান প্রমুখ।
সভায় নেতারা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্টের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। দীর্ঘ ৫৩ বছরে কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার ’৭২–এর সংবিধানের প্রণয়নপদ্ধতি নিয়ে কখনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি।
সংবিধান সময়ের প্রয়োজনে জন আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন হতে পারে উল্লেখ করে সভায় বলা হয়, সংবিধানের প্রণয়নপদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে মুক্তিযুদ্ধকেই বিতর্কিত করা হয়। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিই বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭২–এর সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ’৭২–এর সংবিধানের প্রণয়নপদ্ধতি এবং কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে জুলাই ঘোষণাপত্রে বিতর্ক সৃষ্টি করার কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে।
গণফোরামের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘শুধু ৭২ সালের সংবিধানকে দায়ী করে পরবর্তী সরকারগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতাকে আড়াল করার হীন মানসিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতাকে কোনোভাবেই সংবিধানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত হবে না।’
জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণে বৈষম্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ গণফোরামের। দলটির নেতারা বলেন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের দাবিতে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্রে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো রূপরেখা স্থান পায়নি। জুলাই ঘোষণাপত্রে একতরফা, পক্ষপাতদুষ্ট ও ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা লক্ষণীয়। অন্যদিকে ৩৬ জুলাই উদ্যাপন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা কাম্য নয়।