সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ
Published: 23rd, June 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সিরাজুল আলম খানের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সময় গতকাল রোববার বিকেল ৭টা নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস জুইস সেন্টারে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সিরাজুল আলম খান স্মৃতি পরিষদ নিউইয়র্ক শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক সভার সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সদস্য সচিব শাহাব উদ্দীন। সভায় বক্তব্য রাখেন অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস, লিগ্যাল কনসালটেন্ট মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক ডা.
সভার আলোচনা পর্বে সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বক্তারা বলেন, তিনি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে অনার্স পাশ করলেও সেই সময় কনভেকশোনাল মুভমেন্টে যোগদানের কারণে কারাবরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় মাস্টার্স সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি তার। তা সত্ত্বেও রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ছিল অসীম লেখাপড়া। সে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতেন। তিনি ছিলেন আজীবন দেশের মানুষ ও জনগণের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণপুরুষ।
রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বক্তরা বলেন, ১৯৬৩ সালের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদের পর তিনি আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসেননি। কিন্তু মূল সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সারাজীবন ছিলেন একজন অগ্রসর রাষ্ট্রচিন্তক। যে কারণেই ’৬৩ সালেই আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমদকে নিয়ে স্বাধীন বাংলার নিউক্লিয়াস গঠন করেন। তাদের নেতৃত্বেই ’৬৬ সালের ছয় দফা ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। তাদের চিন্তার কারণেই পাকিস্তানের আপোষকামী ধারা থেকে বেরিয়ে বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য আলাদা রাষ্ট্র করেন। সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মূল্যবোধ ইত্যাদি সংযোজন করে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে ‘ডিকলারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ ঘোষণা করা হয়েছিল।
তারা বলেন, স্বাধীনতার পর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বৃটিশ ভাবধারার দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্রের পরিবর্তে দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে একটি বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সেদিন সিরাজুল আলম খানসহ তরুণ মেধাবী ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা না শুনে বৃটিশ পাকিস্তানের সেই প্রশাসন দিয়েই দেশ শাসন শুরু করলেন। বরং যারা এই প্রস্তাবনা করেন তারাই বঙ্গবন্ধুর বিরাগভাজন হন। যে কারণেই ৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের জন্ম হয়। পথহারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ এবং জাসদের অস্থির রাজনীতির কারণই স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পরে ও দেশকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। সিঙ্গাপুর ,মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশ আমাদের পরে স্বাধীন হওয়ার পর ও অনেক উন্নত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস, ন্যূনতম প্রতিষ্ঠা হয়নি। দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচারের মাধ্যমে দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
সিরাজুল আলম খানের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে বক্তরা বলেন, রাষ্ট্রচিন্তক সিরাজুল আলম খান জাতির স্বার্থে বিভিন্ন সময় লেখনীর মাধ্যমে জাতির দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বুঝতে অসুবিধে অথবা হীনমন্যতার কারণে তার চিন্তাধারাকে আমলে নেওয়া হয়নি। তা নাহলে নব্বইয়ের দশকে প্রথম দিকে তিনি, রাষ্ট্র কাঠামো ও শাসন ব্যবস্থা সম্বলিত ১৪ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাতীয় সংসদে দু’কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট (৩০০+২০০ মোট ৫০০ আসনের)। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য; সংবিধানের ৭০ ধারাসহ কালাকানুন বাতিল করে সংবিধান সংস্কার; বাংলাদেশকে ৭-৯ টি প্রদেশে বিভক্ত করে আমলাতন্ত্র মুক্ত, নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা দেশ পরিচালনা করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন, স্থায়ী জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, মাইক্রো ক্রেডিট এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের জন্য সিরাজুল আলম খানের প্রস্তাবনা পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ছিল। এর মধ্যে কিছু দফা বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঐক্যমত্য কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।
সিরাজুল আলম খানের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করার দাবি জানিয়ে বক্তরা বলেন, মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তার জীবনেও ভুল থাকতে পারে। কিন্তু আমরা জাতির স্বার্থে ভালো দিকগুলো আলোচনা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারি। তিনি জীবনে কখনো ভোগের রাজনীতি করেননি। জাতির সামনে ত্যাগের রাজনীতির এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। ঢাকার সাধারণ একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে মৃত্যু, কোনো বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পরিবার-উত্তরাধিকার কিছুই রেখে যাননি। তার অছিয়ত অনুযায়ী কোনো শোকসভা নয়, পুষ্পমাল্য বা শহীদ মিনারে লাশের ডিসপ্লে নয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনারও চাননি। শুধু মায়ের একটা সাদা শাড়ি দিয়ে মুড়ে গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার কবরের পাশে যেন পুতে দেওয়া হয়। তাই হয়েছে। এইসব ক্ষণজন্মা মানুষের ইতিহাস আমাদের স্কুল, কলেজ, পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা একান্ত জরুরি। তবেই আগামী প্রজন্ম খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে গড়ে উঠবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স মরণসভ স র জ ল আলম খ ন য ক তর ষ ট র স র জ ল আলম খ ন র ম হ ম মদ র জন ত র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নিউইয়র্ক সিটি কি একজন মুসলিমকে মেয়র নির্বাচিত করবে
জোহরান মামদানির নাম আপনারা অনেকেই হয়তো শোনেননি। কিন্তু তাঁর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ারের নাম অনেকেরই জানা। তাঁর বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছেন উগান্ডায়।
১৯৬৩ সালে কেনেডি পরিবারের আর্থিক অনুদানে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কে আসেন। এখানেই ১৯৯১ সালে মিরা নায়ারের সঙ্গে পরিণয়। সে বছরই জোহরানের জন্ম।
২.মাত্র ৩৩ বছরের এই জোহরান মামদানি আগামী নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শুধু যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তা–ই নয়, একাধিক জনমত জরিপে এক ডজনের বেশি প্রার্থীকে ডিঙিয়ে সবার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুমোর তুলনায় ৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন তিনি।
আপাতত জোহরান মামদানির লক্ষ্য ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জয়লাভ করা। বাছাইপর্বের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৪ জুন। যেহেতু নিউইয়র্ক মূলত একটি ডেমোক্র্যাট-প্রধান শহর, তাই বাছাইপর্বে জিতে গেলে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জেতার সম্ভাবনা বিস্তর। কিন্তু এই শহর কি একজন বাদামি রঙের মুসলিমকে তার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য প্রস্তুত?
৩.গত বছর একজন দক্ষিণ এশীয় নারী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, জিততে পারেননি। ভাবা হয়, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতকায়, আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের সমর্থনে কমলা হ্যারিসকে অনায়াসে পরাস্ত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের কোনো তুলনা হয় না। তবে নিউইয়র্ক যে কোনো একটি শহর নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহর। প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষের বাস এই শহরে। এর বার্ষিক বাজেট ১১২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের গড় বাজেটের চেয়ে বেশি। শুধু শিক্ষা বিভাগের যে বাজেট (৩৮ বিলিয়ন ডলার), তা লাওসের মতো একটি দেশের জাতীয় বাজেটের বেশি।
নিউইয়র্কের ভোটাদাতাদের যে মানচিত্র, তা–ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার মানচিত্র থেকে একদম আলাদা। যেমন এই শহরের তালিকাভুক্ত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৬ ও ১০ শতাংশ। অথচ সারা দেশে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির ভোটারদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান; ৩০ শতাংশ করে।
তার চেয়েও বড় কথা, সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অশ্বেতকায়দের পরিমাণ প্রায় ৪২ শতাংশ, সেখানে নিউইয়র্ক শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই অশ্বেতকায় ও বহিরাগত।
বস্তুত, জনসংখ্যার গঠনগত দিকে দিয়ে পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এ শহর অধিক বৈচিত্র্যময়। কুইন্স, যেখানে জোহরানের বাস, সেখানে ইংরেজি ভাষা ছাড়াও প্রায় ১৮০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা হয়।
৪.নিউইয়র্কের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিজস্বতা রয়েছে। এই শহরে প্রায় ৯ লাখ মুসলিমের বাস, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি। মুসলিম সংখ্যার হিসাবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিকাগো, যার মোট মুসলিম জনসংখ্যা লাখ তিনেক।
জনসংখ্যার বৈচিত্র্যের বিচারে নিউইয়র্ক ও লন্ডন প্রায় কাছাকাছি। উভয়ের জনসংখ্যা প্রায় সমান সমান (৯ মিলিয়ন বনাম সাড়ে ৮ মিলিয়ন)। নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের ৩৭ শতাংশ বহিরাগত (অর্থাৎ তাঁদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে), তেমনি লন্ডনের বাসিন্দাদের প্রায় ৪০ শতাংশ বহিরাগত। মোট মুসলিম নাগরিকের সংখ্যার হিসাবেও এই দুই শহর কাছাকাছি; লন্ডনে রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ মুসলিম, নিউইয়র্কে ৯ লাখ।
লন্ডনের সঙ্গে নিউইয়র্কের তুলনা টানছি; কারণ, সেখানে বর্তমান মেয়র সাদিক খান পরপর তিনবার বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডন যদি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিমকে মেয়র নির্বাচিত করতে পারে, তাহলে নিউইয়র্ক কেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানিকে তার প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত করবে না?
৫.নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পর্বে এন্ড্রু কুমো জোহরানের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। পরপর দুবার নিউইয়র্কের জনপ্রিয় গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত কুমো স্বাভাবিকভাবেই নাম-পরিচিতির দিকে দিয়ে জোহরানের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
তবে চার বছর আগে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য দায়িত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ায় কুমো এই শহরের নারী ও বামঘেঁষা ভোটারদের কাছে নিন্দিত। তাঁরাই এখন জোহরানকে প্রতিযোগিতার শীর্ষে নিয়ে এসেছেন।
নবীন ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করতেস জোহরানকে মেয়র পদে সমর্থন দিয়েছেন। সেটি তাঁকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু ‘পুলসিরাতের শেষ ধাপ’ পার হতে হলে তাঁকে এই শহরের শক্তিশালী ইহুদি লবির বাধা পার হতে হবে।
বুঝিয়ে বলছি। জোহরান ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা নামের একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থক। মুখ্যত ডেমোক্রেটিক পার্টির অসন্তুষ্ট প্রগতিশীল অংশের সমন্বয়ে গঠিত এই দল খোলামেলাভাবে নিজেদের সোশ্যালিস্ট বা সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন প্রশ্নে এদের রয়েছে মার্কিন মূলধারার বিপরীত একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করে, অধিকৃত গাজায় এখন যা চলছে, তা স্পষ্ট জাতিহত্যা বা জেনোসাইড। তারা অবিলম্বে ইসরায়েলের ওপর মার্কিন সাহায্য প্রত্যাহারের পক্ষে, সেখানে যেসব মার্কিন সংস্থা নানা খাতে বিনিয়োগ করেছে, তা তুলে নেওয়ারও পক্ষে।
ইসরায়েল প্রশ্নে জোহরানের এই অবস্থানের কারণে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী ইহুদি লবির আপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।
ধরা যাক, নিউইয়র্কের প্রগতিশীল ভোটার, মুসলিমসহ অন্য অভিবাসীদের ভোটে জোহরান ২৪ জুনের ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বে জিতে গেলেন। সে ক্ষেত্রে নভেম্বরের চূড়ান্ত ভোটে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে একজন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। অনুমান করি, তাঁরা ইসরায়েলের সমালোচক ও ফিলিস্তিনের সমর্থক একজন মুসলিমকে কোনোক্রমেই এই শহরের মেয়র হিসেবে দেখতে চান না, সে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যা–ই হোন, একজোট হবেন জোহরানকে পরাস্ত করতে।
৬.জোহরানের জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে ব্রুকলিন থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশি-আমেরিকান কাউন্সিল সদস্য শাহানা হানিফ। ২০২২ সালে এই শহরের প্রগতিশীলদের সমর্থনে শাহানা সহজ জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর পুনর্নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ইহুদি লবির বিরুদ্ধ-প্রচারণার মুখে পড়তে হয়েছে। গাজা প্রশ্নে ইসরায়েলের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ অবস্থানের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে একজন ইহুদি প্রার্থীকে।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়ে বাছাইপর্বে তাঁর পরাজয়ের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় শাহানা নিজের অবস্থান বদলে নিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের সমালোচনা থেকে সরে না এলেও এখন তিনি হামাসের সন্ত্রাসী হামলার কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছেন; পাশাপাশি নিউইয়র্ক সিটিতে ইহুদিবিদ্বেষ বৃদ্ধিতে কঠোর সমালোচনাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন।
৭.জোহরান মামদানি গাজা প্রশ্নে এখনো অনড়। কিন্তু বাছাইপর্বে জিতে গেলে তাঁকে সম্মিলিত ইহুদি লবির মুখোমুখি হতে হবে। মোটেই বিস্ময়ের কিছু থাকবে না, যদি তিনি শাহানার মতো ইসরায়েল প্রশ্নে নিজের অবস্থান অধিক নমনীয় করে আনেন। তবে তা জয়ের জন্য যথেষ্ট কি না, সময়ই বলতে পারবে।
জোহরানের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাও বিবেচনায় রাখতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমান্বয়ে ডেমোক্র্যাটদের
সমর্থক-ভিতে অল্প অল্প করে ক্ষয় ধরিয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি যেখানে এই শহরে পেয়েছিলেন ২৩ শতাংশ ভোট, সেখানে ২০২৪ সালে তাঁর মোট ভোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।
অতিরিক্ত যে ৭ শতাংশ ভোট ট্রাম্প এই শহরে পান, তার একটা বড় অংশ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটাররা। এই ভোটাররা ট্রাম্প-সমর্থিত কোনো রিপাবলিকানকে ভোট না দিয়ে জোহরানকে কেন ভোট দেবেন—এমন প্রশ্নের জবাব আমরা এখনো পাইনি।
জোহরানের বিপক্ষে আরও কাজ করতে পারে অশ্বেতকায়দের ব্যাপারে শ্বেতকায় ভোটারদের দ্বিধা। তারপরও তিনি একজন মুসলিম, যাঁদের ব্যাপারে দেশটির অনেকেরই ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব রয়েছে।
এ মুহূর্তে প্রগতিশীল শ্বেতকায়দের সমর্থনে জোহরান হয়তো এগিয়ে, কিন্তু ভোটের সময় তাঁদের অনেকেই সিদ্ধান্ত বদলে একজন অশ্বেতকায় ও মুসলিমকে ভোট না দিয়ে একজন রিপাবলিকান প্রার্থীকেই ভোট দেবেন, সে সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না।
এই প্রবণতার নাম ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’। ১৯৮২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের গভর্নর নির্বাচনে জনমতে শ্বেতকায়দের সমর্থন পেয়ে এগিয়ে
ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী টম ব্র্যাডলি। কিন্তু ভোট গণনার পর দেখা গেল, প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি হেরে গেছেন।
মুখে এক কিন্তু কাজে ভিন্ন, শ্বেতকায় ভোটারদের এই ব্যবহারের নাম ব্র্যাডলি ইফেক্ট। ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও ঠকে যান আফ্রিকান-আমেরিকান প্রার্থী ডেভিড ডিনকিন্স। কারণ, ব্র্যাডলি ইফেক্ট। জোহরান মামদানি কি ‘ব্র্যাডলি ইফেক্ট’ উতরে যেতে পারবেন?
হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব