তুরস্ক কেন ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় নিন্দা জানায়নি
Published: 23rd, June 2025 GMT
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনায় তুরস্ক সরাসরি নিন্দা জানায়নি। অথচ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রধান মিত্রদেশগুলোর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক রাষ্ট্র এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এ হামলার সমালোচনা করে দেশগুলো বলেছে, এ ঘটনায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে। তারা এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া বলেছে।
গত শনিবার গভীর রাতে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা পঙ্গু করে দেওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ছে।
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বের কাছে জানাতে পারি যে হামলাটি দুর্দান্ত এক সামরিক সাফল্য। ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’ এ সময় তিনি তেহরানকে ‘শান্তির পথে আসার’ আহ্বান জানান। একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দেন, সেটা না করলে ইরানে আরও জোরালো হামলা করা হবে।
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘এখন হয় শান্তি আসবে; না হলে ইরানের জন্য সামনে এমন এক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে, যেটা গত আট দিনের চেয়েও ভয়াবহ হবে।’
এই হামলার কয়েক ঘণ্টা পর তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে সতর্ক করে যে এসব হামলা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি তৈরি করবে।
আরও পড়ুনইরানে হামলার পর এখন ট্রাম্পের সামনে যে তিন অনিশ্চয়তা২২ জুন ২০২৫তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র যে হামলা চালিয়েছে, তার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে তুরস্ক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। চলমান পরিস্থিতি আঞ্চলিক সংঘাতকে বৈশ্বিক স্তরে নিয়ে যেতে পারে। আমরা চাই না এ রকম বিপর্যয়কর দৃশ্যপট বাস্তবে রূপ নিক।’
তুরস্ক সরকারের এই হিসাবি প্রতিক্রিয়া দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আগের মন্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি বিপরীত। ইরানে চলা ইসরায়েলি হামলাকে এরদোয়ান ‘দসুত্য’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে এলেও সব সময়ই এ সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলেছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ২০১০ সালে উত্তেজনা প্রশমনে তুরস্ক ও ব্রাজিল পারমাণবিক জ্বালানি বিনিময় চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক পরিষদের সদস্য ও সেতা থিঙ্কট্যাংকের নিরাপত্তা–বিশ্লেষক মুরাত ইয়েশিলতাশ গতকাল রোববার লিখেছেন, ‘ইরানের কথিত পারমাণবিক প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা, যা দেশটির নেতারা আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলে যুক্তি দেন, তুরস্কের দৃষ্টিতে সেটি একটি বিপজ্জনক জুয়া। এটি মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিস্তার ঘটাতে পারে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি তুরস্কের বিরোধিতা মানেই এটি নয় যে তারা ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করছে।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যম আক্সিওসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তুরস্কের কর্মকর্তারা এটা নিশ্চিত করেছেন যে গত সপ্তাহে এরদোয়ান ট্রাম্পকে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে ইস্তাম্বুলে ইরানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রাজি করান। ইরানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির। এমনকি ট্রাম্প নিজেও আলোচনায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাকে তুরস্কে ‘উসকানি ছাড়াই হামলা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রতিবেদনের আলোকে আঙ্কারা এটা বলেছে।
কেননা তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে সক্রিয়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে, এমন দাবি দুটি পক্ষের কেউই বিশ্বাস করে না।
এ কারণেই ইরানে ইসরায়েলের হামলায় তুরস্কের কর্মকর্তারা দ্রুত নিন্দা জানিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, ইসরায়েলের এ হামলা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বিভাজন ডেকে আনছে এবং বিস্তৃত পরিসরে যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায় ইসরায়েলের পূর্ববর্তী হামলাগুলো বিবেচনায় নিয়েছিল তুরস্ক।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম নূর নিউজ, দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ১৩ জুন জানিয়েছিল, ইসরায়েলের হামলায় তখন পর্যন্ত ৪৩০ জন নিহত হন ও প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানের পাল্টা হামলায় অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কয়েক শ মানুষ।
আরও পড়ুনপুতিন কেন ইরানকে রক্ষা করছেন না?২২ জুন ২০২৫এ পরিস্থিতিতে উত্তেজনা প্রশমনে উদ্যোগ নেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি কয়েকজন মূল নেতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। এর মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ছিলেন।
এই ফোনালাপের মধ্য দিয়ে এরদোয়ান নিজেকে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু আলোচনার জন্য ইস্তাম্বুলকে ভেন্যু হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনার বদলে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিজের সুসম্পর্ক বজায় রাখতেই আগ্রহী। এই সুসম্পর্কের জোরেই তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারার প্রশাসনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ট্রাম্পকে রাজি করাতে পেরেছিলেন।
তুরস্কের কর্মকর্তারা অ্যাক্সিওসের সপ্তাহান্তের প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে মিডল ইস্ট আইকে জানান, গত সপ্তাহে এরদোয়ান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে ইস্তাম্বুলে একটি ইরানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের জন্য পাঠাতে ট্রাম্পকে রাজি করান। ওই ইরানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। ট্রাম্প নিজেও আলোচনায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
আরও পড়ুনইরানের সঙ্গে যুদ্ধে নেতানিয়াহুকে চড়া মূল্য দিতে হবে ৮ ঘণ্টা আগেমার্কিন সংবাদমাধ্যম আক্সিওসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তুরস্কের কর্মকর্তারা এটা নিশ্চিত করেছেন যে গত সপ্তাহে এরদোয়ান ট্রাম্পকে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে ইস্তাম্বুলে ইরানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রাজি করান। ইরানি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির। এমনকি ট্রাম্প নিজেও আলোচনায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
যা–ই হোক, শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি আর হয়নি। তুরস্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বিবৃতি থেকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনার আয়োজক হতে এরদোয়ানের আগ্রহ এখনো অটুট।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি–সংক্রান্ত সংঘর্ষের একমাত্র সমাধান হলো আলোচনা। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক তার দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি প্রস্তুত এবং গঠনমূলক অবদান রাখতে চায়।
তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে বিদ্ধ করা সত্ত্বেও এরদোয়ান প্রায়ই আঞ্চলিক সংঘাতে একটি মসৃণ পথ বেছে নেন। কোনো একটি পক্ষে ঝুঁকে পড়ার বদলে তিনি তুরস্কের জন্য যেটা সুবিধাজনক, সেই পথটি বেছে নেন।
ন্যাটো সদস্যপদ ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে চলমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে প্রতিপক্ষ ও মিত্র—দুইয়ের সঙ্গে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে তুরস্ক একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।
ইয়েসিলতাস যেমনটা বলেছেন, ‘ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষে তুরস্কের অবস্থান স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর নির্ভর করে না।’
রাগিপ সয়লু মিডল ইস্ট আইয়ের তুরস্কের ব্যুরো প্রধান
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র পরর ষ ট র ত রস ক র প ইসর য় ল র পর স থ ত ক র জন য এরদ য় ন দ শট র ত কর ছ র আগ র কর ছ ল র মন ত পরম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
বড়লেখায় ১২ রোহিঙ্গাসহ ১৬ জনকে ঠেলে দিল বিএসএফ
মৌলভীবাজারের বড়লেখার কুমারসাইল সীমান্ত দিয়ে ১২ রোহিঙ্গাসহ অন্তত ১৬ জনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দিয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সোমবার ভোরে সীমান্তের জিরো লাইনে এনে বিএসএফ তাদের বাংলাদেশে দিকে ঠেলে দেয়। সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বিজিবি তাদের আটক করে। এ নিয়ে গত দুই মাসে বড়লেখা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বিএসএফ প্রায় চার শতাধিক অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে।
উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন আহমদ জানান, সকালে কুমারসাইল গ্রামের লোকজন ওই এলাকায় কয়েকজন নারী-পুরুষ ও শিশুকে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখেন। তাদের কথা শুনে কয়েকজনকে রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ হলে স্থানীয়রা বিজিবি ক্যাম্পে খবর দেয়। পরে বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের আটক করে লাতু ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শুনেছি বিজিবি তাদের পুলিশের হস্তান্তর করবে।
এ বিষয়ে ৫২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বড়লেখা থানার ওসি (তদন্ত) হাবিবুর রহমান জানান, বিজিবি আটককৃতদের এখনো থানায় হস্তান্তর করেনি। হস্তান্তর করা হলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার পরমেশ্বরপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ৪ যুবককে আটক করেছে বিজিবি। রোববার রাত সাড়ে ৩টায় বোচাগঞ্জ উপজেলার পরশ্বেরপুর বিওপির সীমান্তের ৩৩১ মেইন পিলারের ৮ সাব পিলারের ৩০০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তর চালান দিঘীরপাড় থেকে তাদের আটক করা হয়। পরে তাদেরকে বোচাগঞ্জ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই বাংলাদেশি। সোমবার দিনাজপুর-৪২ বিজিবি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
আটককৃতরা হলেন- বোচাগঞ্জ উপজেলার নারইল গ্রামের জুবিয়ার ইসলাম, বেলবাস গ্রামের অতীন চন্দ্র রায়, বিরল উপজেলার বনগ্রামের মোনাই দীপক চন্দ্র রায় ও ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের তরিকুল ইসলাম। আটককৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে বিজিবি জানায়, তারা কাজের সন্ধানে ৩ থেকে ৪ মাস আগে দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিল।