ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত রোগ; যা এডিস মশা দ্বারা ছড়ায়। ছোটদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর অনেক সময় জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এ কারণে অভিভাবকদের সতর্ক থাকা ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

যেসব লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে
lসাধারণভাবে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত শিশুদের লক্ষণ বড়দের মতোই হয়ে থাকে। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মতো জটিলতাগুলো শিশুদের ক্ষেত্রে দ্রুত এবং ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সে কারণে শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হয়।
lশিশুর শরীরে মাঝারি বা তীব্র মাত্রার জ্বর এক থেকে পাঁচ দিন থাকে। জ্বরের সঙ্গে দেখা দেয় ক্ষুধামান্দ্য ও বমি বমি ভাব। অনেক সময় শরীরে র‍্যাশ দেখা দিয়ে থাকে। মাথা বা শরীরের ব্যথায় শিশু অযথা কান্নাকাটি বা বিরক্ত করতে থাকে। কখনও কখনও বমি, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে।
lঅনেক সময় সিভিয়ার ডেঙ্গু হলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যেমন মাড়ি, নাক, চোখের কনজাংটিভায় রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা যায়।
lপানি আসার কারণে অনেক সময় পেট ফুলে যেতে পারে, ফুসফুসে পানি জমে শিশুর কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
lকিশোরী মেয়েদের মাসিকের সময় বেশি রক্তপাত হতে পারে।
lজ্বর কমে যাওয়ার দু-তিন দিন পর রোগটি প্রশমিত না হয়ে উল্টো শরীরে শক বা চেতনাহীন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। শুরুতে শিশুর নাড়ির স্পন্দন দ্রুত বাড়তে থাকে। একসময় রক্তচাপ কমে যায়, নাড়ির স্পন্দন তখন অনুভূত হয় না। শিশু শকে চলে যায়। এই শক প্রতিহত করতে না পারলে তা থেকে প্রাণহানির কারণ হতে পারে। এজন্য শিশু বা বড় যে কোনো রোগীর জ্বর কমে গেলেও নাড়ির স্পন্দন এবং রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে।
মা-বাবা বা অভিভাবকের করণীয়
lডেঙ্গু রোগাক্রান্ত শিশুর শরীরে তীব্র জ্বর দেখা দেয়। এজন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় প্যারাসিটামল সেবন, স্পঞ্জিং বা হালকা গরম পানিতে শরীর মুছে দেওয়া এবং বেশি বেশি তরল খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
lতরল খাবার, খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত, স্যুপ, ডালের পানি ইত্যাদি বেশি করে পান করাতে হবে।
lপ্রস্রাব যথেষ্ট ও ঠিকমতো করছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছয় ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না হলে শিশুকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা উচিত।
lনিয়মিত নাড়ির স্পন্দন, রক্তচাপ মাপা জরুরি। শিশুর রক্তচাপ মাপার জন্য নির্দিষ্ট মাপের ব্লাডপ্রেশার কাফ ব্যবহার করতে হবে। এজন্য নিকটস্থ চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিন
lশিশুর জ্বরের সঙ্গে রোগসংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেওয়ার আগেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং তাঁর নির্দেশে রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাবেন। কোনো শিশুর জ্বর ৫-৬ দিন পার হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাবেন। ডেঙ্গুর অ্যান্টিবডি ৫-৬ দিন আগে ধরা পড়ে না। এজন্য আগেভাগে অ্যান্টিবডি টেস্ট করার দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাতে হবে।
lজ্বর কমে গেলেও, অর্থাৎ ষষ্ঠ দিন থেকে নিশ্চিন্ত না হয়ে বরং আরও নিবিড়ভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
lশিশু অসুস্থ হলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। তাকে পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন দিন এবং আশ্বস্ত করুন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ 
করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সন্তানের মধ্যে ডেঙ্গুর কোনো লক্ষণ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।।
যেসব শিশু আগে থেকেই অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত– যেমন কিডনি রোগ, রক্তজনিত রোগ, লিভারসংক্রান্ত জটিলতা বা বিশেষায়িত ওষুধ সেবন করছে, তাদের জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
ডেঙ্গু হলে অভিভাবকেরা প্রথমেই রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ রোগে প্লাটিলেটসংক্রান্ত জটিলতা স্বল্পসংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা দেয়। অধিকাংশ রোগী পানিশূন্যতা, বুক ও পেটে পানি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসে। তাদের চিকিৎসা শুধু বিশেষায়িত হাসপাতালে সম্ভব। 
[অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগ) জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র র জ বর এজন য

এছাড়াও পড়ুন:

রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীদের স্যালুট

পৃথিবীর এক দিকে যখন সূর্যের আলো নিভে আসে, তখন অন্য দিকে শুরু হয় নতুন এক সকাল। এমন সকাল যেখানে কোনো আনন্দ নেই, নেই বিশ্রাম বা বিলাস; আছে শুধু ঘাম কষ্ট আর নীরব সংগ্রাম। সেই সকালেই লাখো বাংলাদেশি শ্রমিক মাথায় হেলমেট পরেন, কেউ হাতে ট্রাউল ধরেন, কেউ স্টিয়ারিংয়ে বসেন, কেউবা মরুভূমির দিকে হাঁটেন। তারা জানেন, তাদের ঘামের প্রতিটি ফোঁটা একদিন দেশের মাটিতে সোনার দানায় রূপ নেবে।

এই মানুষগুলো আমাদের অর্থনৈতিক সেনা। তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন না, কিন্তু প্রতিদিন যুদ্ধ করেন সময় যন্ত্রণা আর একাকিত্বের সঙ্গে। তারা শুধু নিজের জন্য লড়াই করেন না, তারা লড়ে যান প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, দেশের পতাকা উঁচু রাখার জন্য। আমরা তাদের বলি ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। তারা প্রবাস থেকে উপার্জন করে নিবাসে যা পাঠান তাই রেমিট্যান্স।

মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে 

রাতের অন্ধকারে কখনও একা বসে থাকা প্রবাসীর মুখে দেখা যায় এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ মায়ের ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে মায়ের মায়াবী মুখ। ছেলে বলে, ‘মা, তুমি এখনও ঘুমাওনি?’
মা বলেন, ‘না রে বাবা, তোকে মনে পড়ছিল।’
এই ছোট্ট সংলাপেই লুকিয়ে আছে এক মহাকাব্যিক ভালোবাসা। হাজার মাইল দূরে থেকেও মা ও ছেলের মমতার বাঁধন ছিঁড়ে যায় না। ছেলেটি কান্না চেপে বলে, ‘আমি ভালো আছি মা।’
এই ‘ভালো থাকার’ আড়ালে লুকিয়ে থাকে অনেক অশ্রু, নির্ঘুম রাত, অপমান ও সংযমের গল্প। একজন প্রবাসী গৃহকর্মী হয়তো দিনের পর দিন অপরিচিত কোনো পরিবারের ঘর মুছছেন, কিন্তু তার নিজের ঘরে আলো জ্বলে না মাসের পর মাস। একজন পিতা হয়তো বিদেশের ব্যস্ত শহরে গাড়ি চালান ১৬ ঘণ্টা, যেন দেশে থাকা তার ছেলেটি বিদ্যালয়ে যেতে পারে। এভাবেই জন্ম নেয় এক নতুন অভিধান- যেখানে ত্যাগ মানে প্রবাসী, ভালোবাসা মানে রেমিট্যান্স, আর দেশপ্রেম মানে দূরদেশে থেকেও মাটির গন্ধ অনুভব করা।

ঘামে গড়া অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মূল শক্তি, স্থিতিশীল থাকে জিডিপি, ঘুরে দাঁড়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি।
বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে কর্মরত। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই যান না কেন, তারা নিজের নামের আগে উচ্চারণ করেন একটা শব্দ ‘বাংলাদেশ’। তাদের পাঠানো অর্থ গ্রামের ঘর থেকে জাতীয় বাজেট পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের টাকায় গড়ে ওঠে বাড়ি, সেতু, স্কুল, মসজিদ; তাদের অর্থেই চলে সন্তানের পড়াশোনা, বোনের বিয়ে, মায়ের ওষুধ এবং দেশের অর্থনীতি। রেমিট্যান্সের প্রতিটি নোটে লেগে থাকে ঘাম, অশ্রু আর একটি না বলা গল্প।

ত্যাগের প্রতিচ্ছবি

অনেক প্রবাসী ভাই আছেন যারা একটানা দশ-পনেরো বছর দেশে ফেরেননি। বছরের পর বছর তাদের ঈদ কেটে যায় পরদেশে। একটি ভিডিও কলেই তারা জড়িয়ে ধরেন সন্তানকে, মোবাইলের স্ক্রিনে চুমু খান তাদের মুখে। অনেক প্রবাসী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হন। কেউ কেউ আর ফেরেন না জীবিত অবস্থায়। তাদের কফিনে মোড়ানো লাল-সবুজ পতাকা তখন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির প্রতীক। তাদের সন্তানরা হয়তো বুঝে না বাবার অনুপস্থিতি মানে কী, কিন্তু যখন প্রবাসে থাকা সেই বাবা বাড়ি ফেরেন লাশ হয়ে, তখন বুঝতে শেখে- পরিবার ও দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু গর্ব ও হাসি নয়, কখনও কখনও কান্না।

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মানবিক মুখ

আজ যাদের আমরা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলি, তাদের জীবনের ভেতর আছে এক অনন্য মানবিকতা। তারা প্রতিদিন নিজের চেয়ে অন্যের জন্য বাঁচেন। মায়ের জন্য, স্ত্রীর জন্য, সন্তানের জন্য, দেশের জন্য। নিজের কষ্টকে গোপন করে হাসেন, যেন প্রিয়জনেরা সুখে থাকে। অনেকে হয়তো বলেন, ‘ওরা তো বিদেশে টাকা কামায়’। কিন্তু সত্য হলো, ওরা উপার্জন করে ঘাম দিয়ে, অবহেলা সহ্য করে, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে। তাদের পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশের মাটি ভুলে যান না।

সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব

প্রবাসী আয় শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই ঘটায় না, এটি সামাজিক পরিবর্তনেরও অনুঘটক। গ্রামের গৃহিণীরা এখন ব্যাংক হিসাব রাখেন, বিদেশ থেকে আসা টাকা দিয়ে গড়ে ওঠে নতুন ব্যবসা, ছোট খামার, দোকান। অনেকে প্রবাসী টাকায় সন্তানের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ সরকারের ‘এক্সপ্যাট্রিয়েটস ওয়েলফেয়ার ব্যাংক’ ও ‘ওভারসিজ ওয়েলফেয়ার ফান্ড’ এখন প্রবাসীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। তবে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে; অবৈধ দালালচক্র, ভুয়া চুক্তি, কাজের নিশ্চয়তা না থাকা- এসব অব্যবস্থার মধ্য দিয়েও তারা দাঁড়িয়ে থাকে একা, নিঃশব্দে, দৃঢ়ভাবে।

রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান

যে দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো রেমিট্যান্স, সে দেশের প্রবাসীরা যেন শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতিও পান- এটাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। তাদের জন্য বিমানবন্দরে শালীন আচরণ, দ্রুত সেবা, বিদেশে আইনি সুরক্ষা ও পরিবারে আর্থিক সহায়তা এসব এখন শুধু দাবি নয়, অধিকার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলো যেন আরও কার্যকরভাবে পাশে দাঁড়ায়- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

দেশের প্রকৃত নায়ক 

বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, জুলাই বিপ্লবীরা অভ্যুত্থান দিয়েছেন, কৃষকরা দিয়ে যাচ্ছেন খাদ্যের নিরাপত্তা, আর প্রবাসীরা দিয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তাদের ঘামে সিঞ্চিত প্রতিটি টাকায় জেগে থাকে এই দেশের প্রাণশক্তি। তারা আমাদের গর্ব। তাদের জন্যই ব্যাংক ভরে থাকে বৈদেশিক মুদ্রায়, বাংলাদেশের নাম উঠে আসে বিশ্ব তালিকায়। তাই আমাদের উচিত তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় উচ্চারণ করা- ‘হে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা, আপনাদের প্রতি আমাদের স্যালুট। আপনাদের শ্রমে বেঁচে আছে এই মাটি, আপনাদের ঘামে ধুয়ে যায় দারিদ্র্যের দাগ, আপনারা দেশের প্রকৃত নায়ক।’

ঢাকা/তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি পেলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
  • রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীদের স্যালুট