চট্টগ্রাম নগরীতে কাঁচাবাজারের জন্য খ্যাত চকবাজারের ধনির পুল এলাকায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে ছয় কোটি টাকায় একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছিল সিটি করপোরেশন। কয়েক দফা পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিক্রেতা বা দোকানদারেরা ভবনটিতে দোকান নিয়ে বসছেন না। ফুটপাতে বাজার বসার কারণে ওই এলাকায় যানজট লেগেই আছে, ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে পাশের খালেও জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। অথচ ভবন নির্মাণে পরিকল্পনায় ভুল থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়ে ভবনটিকে কাজে লাগাতে হবে।

চকবাজারের এই কাঁচাবাজার নিয়ে প্রথম আলো আগেও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সম্ভাব্যতা যাচাই করা ছাড়া বা পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বাস্তব উদাহরণ এটি। জনগণের অর্থে নির্মিত ভবনটি জনগণের কোনো উপকারেই আসছে না। দোকানদার বা বিক্রেতারা এখানে সুফল পাওয়ার কথা থাকলেও তা থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত তাঁরা। অন্যদিকে ফুটপাতে দোকান বসার কারণে নানাভাবে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়ে গেছে, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও।  

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা শাহাদাত হোসেন ভবনটিকে চালু করার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ফুটপাতে দোকানদারদের ভবনের দোতলায় পুনর্বাসন করেন তিনি। এ জন্য তাঁদের কোনো দোকানভাড়া দিতে হচ্ছিল না। শুধু বাজারের ইজারাদারের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছিল। ফুটপাতে থাকার সময়ও এই অর্থ দিতে হতো। এরপরও দোকানিরা ভবনে থাকেননি। দু-তিন মাস না যেতেই আবার ফুটপাত ও সড়ক দখল করে ব্যবসা শুরু করেন সবজি বিক্রেতারা। গত শুক্রবার ফুটপাত ও সড়কে দোকান দেখে ক্ষুব্ধ হন মেয়র শাহাদাত হোসেন।

তার মানে, শুধু দোকানিদের পুনর্বাসনই যথেষ্ট নয়। কাঁচাবাজারটি যখন পুরোনো ভবনে ছিল, তখন দোকানের বিন্যাস যেমন ছিল নতুন ভবনে সেটি হয়নি। আগের ভবনে সবজি, পেঁয়াজ, রসুনের বাজার ছিল নিচতলায়। দোতলায় ছিল মাছ-মাংসের বাজার। নতুন ভবনে হয়েছে উল্টো। মানুষ নিচতলা থেকে মাছ-মাংস কিনে সবজির জন্য আর দোতলায় উঠতে চান না। ফলে দোতলায় থাকা দোকানিরা বলছেন, ক্রেতারা না আসায় তাঁদের পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা ফুটপাতে বসছেন। ফুটপাতে যেখানে তাঁদের দৈনিক বিক্রি ৪০-৫০ হাজার টাকা ছিল, নতুন ভবনে তা কমে ৮-১০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

ভবনটিকে যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া। পুরোনো ভবনে যেভাবে বাজারের দোকানগুলো বরাদ্দ করা ছিল, নতুন ভবনেও সে অনুসারে করা যায় কি না, বিবেচনা করা হোক। তা ছাড়া ক্রেতাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। ফুটপাতে দোকান বসানো ও খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পদক ষ প ন ফ টপ ত

এছাড়াও পড়ুন:

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব এবং কৌশলগত করণী

বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী। একদিকে পারস্য উপসাগর, অন্যদিকে ওমান উপসাগর। সরু এই জলপথ দিয়েই বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ যদি একদিনের জন্যও বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের তেল-গ্যাস আমদানিকারক অন্যান্য দেশেও। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, আমদানি-নির্ভর দেশও এর ব্যতিক্রম হবে না।

হরমুজ প্রণালী ইরানের দক্ষিণ তীরে এবং ওমানের উত্তরে অবস্থিত, যার প্রশস্ততা মাত্র ৩৯ কিলোমিটার। এই জলপথ দিয়েই সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, ইরাক ও ইরানের বিশাল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ( এলএনজি) জাহাজে করে রপ্তানি হয়। বিশ্ববাজারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির প্রভাব এতটাই বেশি যে এই রুটে সামান্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের দাম আকাশচুম্বী হতে পারে।

বাংলাদেশে মোট জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ মেটানো হয় আমদানি করা তেলের মাধ্যমে। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কিছু দেশ থেকে আমরা জ্বালানি তেল আমদানি করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই তেল আসে হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে। অন্যদিকে, এলএনজি আমদানির বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। অর্থাৎ হরমুজ প্রণালীতে যদি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বা জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়, তবে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।

হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দামের উপর প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার হয়ত তেল-গ্যাসে ভর্তুকি বাড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজেটের উপর চাপ বাড়বে। দ্রব্যের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করবে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে এবং কৃষিখাতেও সেচ সমস্যার কারণে ফলন হ্রাস পেতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন, পেট্রোলিয়াম-নির্ভর কৃত্রিম ফাইবার, কেমিক্যালস ইত্যাদি আমদানি হরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে আসে। জ্বালানি সংকট দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফলে রপ্তানি আদেশ বাতিল হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করেন। এই দেশগুলোর অর্থনীতিও মূলত জ্বালানি রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেল রপ্তানি ব্যাহত হবে, ফলে ওইসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। ফলস্বরূপ প্রবাসী কর্মীদের ছাঁটাই, নতুন নিয়োগ বন্ধ কিংবা বেতন কমানোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক আঘাত। কারণ রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বড় অবদান রাখে।

জ্বালানি সংকটের কারণে সরকারকে বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হবে, যা হবে তুলনামূলক ব্যয়বহুল। পাশাপাশি ডলার সঙ্কট আরও প্রকট হতে পারে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে বাড়বে ভোগান্তি।

হরমুজ প্রণালী ঘিরে যে ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমাদের মতো আমদানি-নির্ভর দেশের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। ভবিষ্যতের জ্বালানি সংকট বা বৈশ্বিক সরবরাহ বিঘ্নের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই কিছু বাস্তবভিত্তিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগ শুধু সাময়িক প্রতিকারে নয়, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হবে।

প্রথমত, আমাদের জোর দিতে হবে বিকল্প জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগে। নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর ও বায়ু শক্তির সম্ভাবনা বাংলাদেশে যথেষ্ট বেশি। কেন্দ্রীয় ও ব্যক্তিপর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিনির্ভরতা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে জ্বালানি মজুতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আমাদের জ্বালানি মজুত সীমিত সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম। ভবিষ্যতে যেন অন্তত এক থেকে দুই মাসের চাহিদা পূরণ করা যায়, সে অনুযায়ী রিজার্ভ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা নিতে হবে।

তৃতীয়ত, তেল ও গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে একক উৎস নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রয়োজন বহুমাত্রিক সরবরাহ চুক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গেও কৌশলগত জ্বালানি চুক্তি করতে হবে, যাতে একটি অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দিলে অন্য উৎস দিয়ে সরবরাহ চালু রাখা যায়।

চতুর্থত, আমাদের বন্দর ও নৌবাণিজ্য অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যাঘাত বা বিকল্প আমদানি রুটের প্রয়োজন দেখা দিলে যেন দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়, সে জন্য পায়রা, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি বিকল্প নৌপথ ও জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে একে ‘জ্বালানির লাইফলাইন’ বলা হয়। এই লাইফলাইন দুই একদিনের জন্য বন্ধ হলেও বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো কেঁপে উঠবে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। তাই এখন থেকেই কৌশলগত চিন্তা, বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি এবং বহুমুখী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আমাদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে যে আগুন জ্বলছে, তার ধোঁয়া আমাদের ঘরেও আসতে পারে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব এবং কৌশলগত করণী
  • ডেমরায় ভবনের ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু
  • মধ্যপ্রাচ্য আর হয়তো ইসরায়েলের ছকে চলবে না
  • সম্মেলন নয়, কৌশলের লড়াই জাতীয় পার্টির দুই পক্ষে
  • সীতাকুণ্ডে বনাঞ্চল কেটে গড়ে ওঠা জাহাজভাঙা কারখানা উচ্ছেদ
  • ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ এবং যুক্তরাষ্ট্র
  • অস্থায়ী কার্যালয়ে ‘মুক্তি ঐক্যদল’, দলীয় প্রধান এমপি হয়ে আবার বিয়ে করতে চান
  • কোনো দলের কার্যালয় আসলে ভাতের হোটেল, কোনোটার ট্রাভেল এজেন্সি
  • ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও করণীয় কী হবে