মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি থাকা রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে পরিমাণেও দেওয়া হচ্ছে কম। দুর্ভোগের মুখে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনরা এসব অভিযোগ করেন।
সরেজমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, রোগীদের খাবার সরবরাহ করার জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্স নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইজিপি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় স্থান হওয়ার পরও সেই ঠিকাদার খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পায়।
স্থানীয় সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে হাসপাতালে তোলপাড় শুরু হয়। গত মঙ্গলবার সেখানে গেলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। হাসপাতালের প্রধান ডা.
জানা গেছে, হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ বিভাগে ভর্তিরত রোগীদের ওষুধের পাশাপাশি প্রতিদিন সরকারিভাবে প্রতি বেলা ১৭৫ টাকা মূল্যের ৩ বেলা (সকালে নাশতা, দুপুরে ও রাতে ভাত) খাবার দেওয়া হয়। বিশেষ দিবসে তা ২০০ টাকা নির্ধারণ করা থাকে। টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে সপ্তাহে তিন দিন দুপুরে ও রাতে ১৭৫ গ্রাম করে ৩৫০ গ্রাম ভাত, মুরগির মাংস ৭৫ গ্রাম করে ১৫০ গ্রাম দেওয়ার কথা। এর মাঝে মাংস পরিমাণমতো দেওয়া হচ্ছে না। সপ্তাহে চার দিন দুপুরে ও রাতে ৩৫০ গ্রাম ভাত, মাছ ৭৫ গ্রাম করে ১৫০ গ্রাম দেওয়ার কথা। প্রতিদিন রোগীদের সকালে দুটি পাউরুটি, একটি সিদ্ধ ডিম, দুটি পাকা কলা দেওয়ার কথা থাকলেও ছোট কলা ও নিম্নমানের পাউরুটি দেওয়া হচ্ছে। মাছ-মাংসসহ মোটা চালের ভাত, বাসি তরকারিসহ নিম্নমানের খাবার পরিমাণে কম সরবরাহ করা হচ্ছে।
হাসপাতালের বাবুর্চি সাজিয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীদের খাবারে সব ধরনের উপকরণ কম দেওয়া হয়। মাছ-মাংস একজন রোগীর প্লেটে দুপুরে ও রাতে ১৫০ গ্রাম দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম। সকালে নিম্নমানের পাউরুটি, ছোট সাইজের কলা দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মচারী জানান, এখানে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সের মুক্তার আহমদ কাগজে-কলমে খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পেলেও হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক আলমাছুর রহমান তাঁকে সহযোগিতা করছেন। তাদের দু’জনের যোগসাজশে নিম্নমানের খাবার দিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
ভর্তিরত রোগী উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা ইউছুফ আলী বলেন, পাঁচ দিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও পেটের ব্যথা নিয়ে ভর্তি আছি। হাসপাতালে দু’বার সামান্য ভাত, আলু এক পিস, ছোট সাইজের মাছ-মাংস দেওয়া হয়। মাছ-মাংস পুরোপুরিভাবে রান্না করা হয় না।
পৌর এলাকার বাসিন্দা আকলু মিয়া জানান, চার দিন ধরে তাঁর স্ত্রী ছমরুন বেগম ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি। খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। একই কথা জানালেন পৌর এলাকার বাসিন্দা শাহেদা আক্তার। তিনি বলেন, আমার ১১ মাসের মেয়ে মরিয়ম নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের খাবার নিম্নমানের হওয়ায় বাইরে থেকে এনে খাওয়াতে হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মেসার্স শিউলী এন্টারপ্রাইজের আবু তালেব মুকুল ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ২৯ টাকা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল উত্তোলন করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সের মুক্তার আহমদ ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ৬৫০ টাকার বিল উত্তোলন করেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সের মুক্তার আহমদ ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকার বিল উত্তোলন করেন। এক বছরের ব্যবধানে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৮০০ টাকা অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি ইজিপি টেন্ডারে দু’জন ঠিকাদার অংশগ্রহণ করেন। সেখানে এক বছরের জন্য সর্বনিম্ন ২০ লাখ ৭৪ হাজার ৮৯৮ টাকার দর দেন শিউলী এন্টারপ্রাইজ। অন্যদিকে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্স ৩০ লাখ ৪১ হাজার টাকা দর দেন। ইজিপি টেন্ডারের নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা শিউলী এন্টারপ্রাইজ কাজ পাওয়ার কথা থাকলেও কাগজপত্র সঠিক নয় বলে হাসপাতালের আলমাছ আহমদের সহায়তায় জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ঠিকাদার মুক্তার আহমদ খাবারের পরিমাণ কম দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, খাবারে কিছুটা ত্রুটি থাকবে কারণ ভ্যাট রয়েছে। ব্যবসায়ী হয়ে দেখেন কত হিসাব। খাবারে মাছ-মাংস পরিমাণ থেকে কম দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন তিনি।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক আলমাছুর রহমান জানান, তিনি ঠিকাদারের অংশীদার নন। যে কেউ এটা বলতে পারে কারও মুখ তো বন্ধ করা যায় না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ম ক ত র আহমদ খ ব র সরবর হ পর ম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
৫৪ বছর পর স্বাধীনতার পক্ষে–বিপক্ষে বলে বিভক্তি সৃষ্টি কাম্য নয়: সালাহউদ্দিন আহমদ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রির মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে–বিপক্ষে এই বক্তব্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করা আমাদের কাম্য হতে পারে না। আমরা কেউই স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এটা কামনা করতে পারি না।’
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাহউদ্দিন আহমদ এ কথা বলেন।
‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠী প্রসঙ্গ ও জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা’ শীর্ষক এই বৈঠকের আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।
বৈঠকে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই জাতিকে বিভক্ত করার মানসিকতা দেখেছি। এখানে স্বাধীনতার পক্ষ–বিপক্ষ বলে আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যে বাণিজ্য হয়েছে, রাজনীতিকরণ হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে বাণিজ্য হয়েছে, চেতনা বিক্রি করতে করতে যে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে সবাই সশস্ত্র সংগ্রামে না থাকলেও মানসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল এবং দেশের সব মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল বলে যাদের আমরা বিভক্ত করতে চাই, তাদের মধ্যেও দেশের স্বাধীনতার পর সেই স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার মতো কোনো প্রকাশ্য মানসিকতা আমরা দেখিনি। যারা হয়তো দেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করতে পারেনি, তাদের মধ্যে কিছু ভিন্ন চিন্তা থাকতে পারে। কিন্তু সে রকম দুঃসাহস দেশে কেউ দেখায়নি যে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার মতো কোনো বিভক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছে। আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে অনেক আগে থেকেই একটি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা চালু আছে উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানান। সাম্প্রতিককালে কুকি–চিনের ঘটনা দেশবাসী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে চিন্তিত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেটা আমরা সাদা চোখে দেখছি, সেটার পেছনেও পর্দার অন্তরালের কারণ আছে।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এখানে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল ও ভারতের একটি অঞ্চল, মিয়ানমারের একটি অঞ্চল নিয়ে আরেকটি বৈশ্বিক কোনো কোনো শক্তির পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এই ভূখণ্ডকে হয়তোবা তারা অন্যভাবে সাজাতে চায়। এর বেশি আমি আজ বলতে চাই না। সে জন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে; যাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো এ রকম পরিকল্পনা আমাদের ভূখণ্ডকে নিয়ে সফল হতে না পারে।’
বাংলাদেশে বসবাসকারী সবারই পরিচয় বাংলাদেশি হতে হবে উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমাদের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি ও আধা উপজাতি—সব জনসমষ্টি, সব সত্তাকে বাংলাদেশি হতে হবে একটি ঐক্যবদ্ধ নেশন (জাতি) তৈরিতে। সেই ঐক্যবদ্ধ জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্যই আমরা একাত্তরের পর চব্বিশে আবার রক্ত দিয়েছি।’
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী।
সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির শাহজাহান চৌধুরী, বিএনপির মিডিয়া সেলের চেয়ারম্যান আলমগীর মোহাম্মদ মওদুদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ও আমজনতার দলের সদস্যসচিব তারেক রহমান। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য মোহাম্মদ আব্দুর রব, ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ বরকত আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারেক ফজল, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আল ইউসুফ, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বাবু রুইথি কার্বারি, অ্যাকটিভিস্ট থোয়াই চিং মং শাক প্রমুখ।