পৃথিবীর ভাগ্য এখন বৃদ্ধ ও নির্মম পিতৃতন্ত্রের হাতে
Published: 28th, June 2025 GMT
আসুন, ভালো কিছু চেষ্টা করি। বয়সবাদের খপ্পরে না পড়ে বয়স নিয়ে কথা বলি। আধুনিক ইতিহাসে এর আগে কখনও এমন বৃদ্ধদের হাতে বিশ্বের ভাগ্য পড়েনি। ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং উভয়েরই বয়স ৭২। নরেন্দ্র মোদি ৭৪, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ৭৫, ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭৯ এবং আলি খামেনির বয়স ৮৬।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য ধন্যবাদ। মানুষ দীর্ঘ ও আরও সক্রিয় জীবনযাপন করতে সক্ষম হচ্ছে, কিন্তু আমরা এখন ভীতিকরভাবে রাজনৈতিক নেতাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার ওপর তাদের দখল আরও শক্ত হতে দেখছি, যেখানে প্রায়ই তাদের তরুণ সহকর্মীরা বাদ পড়ে যাচ্ছে।
এই সপ্তাহে তাদের বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটো নেতাদের মধ্যে ইমানুয়েল মাখোঁ ও মেটে ফ্রেডেরিকসন (উভয়েরই বয়স ৪৭), জর্জিয়া মেলোনি (৪৮) এবং পেদ্রো সানচেজ (৫৩) ট্রাম্পের সামরিক ব্যয় বাড়ানোর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ন্যাটো রাষ্ট্রপ্রধানদের গড় বয়স ৬০। জার্মানির ফ্রিডরিখ মের্জের বয়স ৬৯, তুরস্কের রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের ৭১।
সবাই ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয়ের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নতমস্তকে মেনে নিয়েছেন, যা একটি স্বেচ্ছাচারী সংখ্যা; যেখানে গুরুতর সামরিক যুক্তি বা যুক্তিসংগত বিতর্ক ছাড়াই আরোপ করা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে জোরালো কোনো গণতান্ত্রিক বিতর্ক তো দূরের কথা। এতে নীতি বা পলিসি কম গুরুত্ব পেয়েছে, যেখানে একজন ক্ষুব্ধ পিতৃপুরুষের খেয়ালখুশির প্রতি শ্রদ্ধাই প্রাধান্য পেয়েছে। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুট, যার বয়স মাত্র ৫৮ বছর, যিনি ট্রাম্পকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতে গিয়েছিলেন। এটি কূটনীতি নয়, এটি হলো আত্মসমর্পণ।
এই প্রজন্মগত দ্বন্দ্ব অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেনের ৪৭ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ৭০ বছর বয়সী পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ৭০ বছর বয়সী শি তাঁর সাত বছরের ছোট এক প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে তাইওয়ানের পেছনে লেগেছেন। এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ বয়সী নেতানিয়াহু গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করছেন, যেখানে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ১৮ বছরের কম। ইরানে ৮৬ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ ৩২ বছর বয়সী জনসংখ্যার ওপর শাসন করছেন। ক্যামেরুনের ৯২ বছর বয়সী পল বিয়া ১৯৮২ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন, যেখানে গড় বয়স ১৮ এবং আয়ু মাত্র ৬২।
এখানে কোনো প্রবীণের শাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে না। কোনো প্রবীণ নাগরিকদের ক্লাব বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের জন্য ঝুঁকে নেই। কিন্তু এমন কিছু উদ্বেগজনক বিষয় রয়েছে, যেমন– পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে সেইসব মানুষের দ্বারা, যাদের জীবন যুদ্ধোত্তর স্থাপত্য দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় খামেনির বয়স ছিল ছয় বছর।
এটি একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত। পূর্ববর্তী বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার স্থপতিরা– হিটলার, মুসোলিনি, স্ট্যালিন, মাও– ক্ষমতায় আসার সময় তাদের বয়স ছিল ৩০ বা ৪০ বছর। একটি নতুন প্রজন্ম নতুন এক পৃথিবী তৈরি করেছিলেন এবং তার পরিণতি নিয়েই তারা বেঁচে আছেন। আজ সেই নতুন পৃথিবী একটি পুরোনো প্রজন্ম দ্বারা ধ্বংস হচ্ছে– এমন একটি প্রজন্ম, যারা তাদের রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ দেখতে আয়ু পাবেন না। যখন পরিসংখ্যানগতভাবে আপনার জলবায়ু বিপর্যয়ের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা কম দেখছেন, তখন ‘ড্রিল, বেবি, ড্রিল’ বলে চিৎকার করা সহজ। ফরাসিরা যেমন বলে, ‘আমাদের পরে বন্যা আসবে।’
আপনি হয়তো ভাবছেন, দীর্ঘায়ু লাভের সৌভাগ্যবান প্রজন্ম যত্ন, কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বব্যাপী তত্ত্বাবধানের সিলসিলা রেখে যাবে। বরং আমরা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা, দমনপীড়ন, সংঘাত, গণহত্যা, পরিবেশ ধ্বংস এবং আন্তর্জাতিক আইনের অবজ্ঞার পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করছি– যা প্রায়ই নির্মম সত্তর ও আশি বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা শান্তিরক্ষার চেয়ে দায়মুক্তি থেকে দূরে থাকতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। কিন্তু এটা এভাবে হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতা ছাড়ার পর নেলসন ম্যান্ডেলা এল্ডার্স গড়ে তোলেন। ঐকমত্য ও প্রবীণদের লব্ধ জ্ঞানের আফ্রিকান ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এল্ডার্সরা একটি দৃষ্টান্ত রেখে গেছে– সংগঠনটি দেখিয়েছে বয়স কীভাবে স্পষ্টতা, করুণা ও বিবেক গড়ে তোলে; কেবল প্রভাব নয়। সমস্যাটি বার্ধক্য নয়। কেউ কেউ এভাবেই এটিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বয়স্ক শক্তিশালীদের আর প্রয়োজন নেই। এর জন্য এমন প্রবীণদের প্রয়োজন, যারা ত্যাগ করতে ইচ্ছুক এবং পথপ্রদর্শক। যারা উত্তরাধিকারকে ব্যক্তিগত গৌরব হিসেবে নয়, বরং তাদের রেখে যাওয়া পৃথিবী হিসেবে ভাবেন। এই যুগে আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো– আধিপত্য নয়, প্রজ্ঞা। শেষ পর্যন্ত এটিই একজন নেতাকে একজন শাসক থেকে আলাদা করে।
ডেভিড ভ্যান রেব্রুক: রেভোলুসি: ইন্দোনেশিয়া অ্যান্ড দ্য বার্থ অব দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড ও কঙ্গো: দি এপিক হিস্ট্রি অব অ্যা পিওপল; দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রজন ম প রব ণ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে ইসরায়েল
ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ও কামান থেকে চালানো হামলায় তছনছ হচ্ছে গাজা সিটির উত্তরাঞ্চল। রাতভর অঞ্চলটি কেঁপে কেঁপে উঠছে বিস্ফোরণের শব্দে। গত সোমবার রাতে সেখানে হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। আর গতকাল মঙ্গলবার থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজা উপত্যকাজুড়ে হত্যা করা হয়েছে ৮৯ ফিলিস্তিনিকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা চলছিল। জুলাইয়ের শেষ দিকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলে আলোচনা থেকে সরে যায় দুই পক্ষ। এরপর গাজা সিটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা করে ইসরায়েল সরকার। তখন থেকেই সেখানে তীব্র হামলা চলছে। কত দিন এই হামলা চলবে, তা স্পষ্ট করেনি ইসরায়েল।
গতকাল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৮৯ জনের মধ্যে ৩১ জন ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন ৫১৩ জন। এ নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৫৯৯ জনে। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।
হতাহত ফিলিস্তিনিদের প্রায় সবাই বেসামরিক মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন, সোমবার রাতে গাজা সিটির জাইতুন এলাকায় দুটি বাড়ি ও মধ্যাঞ্চলের একটি অ্যাপার্টমেন্টে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ১১ জন নিহত হন। এ ছাড়া দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি বাড়িতে হামলায় এক শিশু ও তার মা–বাবাসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। মাওয়াসি উপকূলে নিহত হয়েছেন চারজন।
তবে ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, গাজার বেসামরিক মানুষের হতাহত হওয়ার সংখ্যা যতটা সম্ভব কমাতে চাচ্ছে তারা। গতকাল তারা বলেছে, আগের মাসে উত্তর গাজায় কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এরই মধ্যে আগামী অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজাজুড়ে সামরিক নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নেতানিয়াহুর এই পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা চলছে। এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধানও। তাঁর মতে, এতে গাজায় বেঁচে থাকা জিম্মিদের জীবন হুমকিতে পড়বে। এ ছাড়া এমন পরিকল্পনা ইসরায়েলি সেনাদের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারে। গাজায় বর্তমানে প্রায় ৫০ জন জিম্মি বন্দী আছেন। তাঁদের ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হয়।
এদিকে খাবারের চরম সংকটের কারণে গাজায় অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। গতকাল ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় না খেতে পেয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুটি শিশু। এ নিয়ে সংঘাত শুরুর পর থেকে অনাহারে ২২৭ জনের মৃত্যু হলো। তাঁদের মধ্যে শিশু ১০৩।
কায়রোয় যাবেন হামাস নেতাএদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা আবার শুরু করতে মিসরের রাজধানী কায়রোয় যাচ্ছেন হামাস নেতা খলিল আল–হায়া। আলোচনার বিষয়ে জানাশোনা আছে, এমন একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে ফিরতে প্রস্তুত রয়েছেন হামাস নেতারা।
তবে যুদ্ধবিরতির মূল শর্তগুলো নিয়ে এখনো হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং হামাসের অস্ত্র ত্যাগের মতো শর্তগুলো। তবে স্বাধীন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র না প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অস্ত্র ত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে ফিলিস্তিনি সংগঠনটি।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আরবের একজন কূটনীতিক রয়টার্সকে জানিয়েছেন, মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিসর এখনো আলোচনা আবারও শুরুর আশা ত্যাগ করেনি। আর গাজা সিটিতে ইসরায়েলের নতুন করে অভিযান শুরুর যে পরিকল্পনা, তা হামাসকে আলোচনার টেবিলে ফেরানোর জন্যও হতে পারে।