২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানকে আমরা জুলাই মাস দিয়ে নামকরণ করি। ঠিক এক বছর পরের জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের চেতনে কিংবা অবচেতনে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির একধরনের হিসাব–নিকাশের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। একটি পত্রিকার কলামের সুনির্দিষ্ট শব্দসংখ্যার সীমা এত বিস্তৃত বিষয়টি আলোচনার জন্য যথেষ্ট না হলেও কয়েকটি কথা বলা যাক।

একটা বড় প্রাপ্তি দিয়ে শুরু করা যাক। এটা হচ্ছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনকে বিপ্লব বলে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া। এমনকি যাঁরা এই চেষ্টা করেছেন, তাঁরাও সরে এসেছেন এই চেষ্টা থেকে; তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকেও এখন ‘গণ-অভ্যুত্থান’ শব্দটি ব্যবহার করতে দেখছি। এমনকি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা শুরুর দিকে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করলেও পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করেছেন ‘গণ-অভ্যুত্থান’ শব্দটি। শেখ হাসিনার পতনের জন্য আমরা যা করেছি, সেটা বিপ্লব নাকি গণ-অভ্যুত্থান, এটা আমাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানোর জন্য খুবই জরুরি। সেই প্রসঙ্গে আসব শেষের দিকে।

দীর্ঘ এক বছর চলে গেলেও আমরা আজও এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাতে পারিনি, শেখ হাসিনার পতন আমরা কেন চেয়েছিলাম এবং পতন–পরবর্তী সময়ে আমাদের উদ্দেশ্য কী ছিল। কেউ কেউ অবশ্য ঝটপট উত্তর দিয়ে দেবেন ৩ আগস্ট ২০২৪ শহীদ মিনারে ছাত্ররা তো শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ব্যবস্থা ফিরে আসা প্রতিরোধ করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির ঘোষণা করেছিলেন।

ঘটনাচক্রে একটা স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে চলে আসা কিছু ছাত্রনেতা যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা কি দেশের সব শ্রেণির মানুষের মনের চাওয়া ছিল? এক দফার মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির কথাটা বাদ দিয়ে শুধু শেখ হাসিনার পতনের কথা বললে আন্দোলনরত জনগণ রাস্তা থেকে ফিরে যেত ওই দিন? ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসা প্রতিরোধ করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও এই প্রশ্ন করা কি অমূলক হবে যে এই লক্ষ্যটি কি আসলে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ নয়? 

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির প্রসঙ্গেই গত এক বছরে ‘সংস্কার’ একটি বহুলশ্রুত শব্দে পরিণত হয়েছে। সত্যি বলতে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর ক্ষেত্রে সংস্কারই সম্ভবত এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড। যাঁরা খুবই গভীর, বিস্তৃত সংস্কারের পক্ষে খুব কঠোরভাবে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরা প্রায়ই বলেন, ‘জনগণ সংস্কার চায়।’ নিজের চাওয়াকে জনগণের নামে বলার প্রবণতা এই মাটিতে অনেক পুরোনো। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য রয়েছে। তবে বিভেদ রয়েছে সংস্কারের ব্যাপ্তি ও ধরন নিয়ে। সেটারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। বলা বাহুল্য, এটা দেখেই অনেকে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছেন।

সবকিছুর পরও আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার প্রধান বাধা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পেরেছি আমরা। এবং এর পরবর্তী সময়ে বিপ্লবের নামে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করতে পেরেছি আমরা, এগুলো আমাদের খুব বড় অর্জন। ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে হাঁটতে, আলোচনা-বিতর্ক (মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝঁাটি) করতে করতে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বাকি ইস্যুগুলোর সমাধান করতে পারব।

সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কমিশনগুলোর যেসব সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনে আসেনি, সেগুলো এবং কমিশনের আলোচনায় প্রাথমিকভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিষয়গুলো সরকার দ্রুত শেষ করতে আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ওদিকে সরকার কর্তৃক গঠিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড.

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কিছুদিন আগে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নেও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

দীর্ঘদিন একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করার পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। ধারণা করি, সরকার মোটাদাগে মানুষকে হতাশ করেছে। শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, এটা মেনে নিয়েও বলতে চাই, অনেক অসাধারণ কিছু করা দূরেই থাকুক, একটা সরকারের খুবই সাধারণ রুটিন কাজের ক্ষেত্রেও সরকারের ব্যর্থতা আমরা দেখেছি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা একেবারে নজিরবিহীন। পুলিশ বাহিনী অন্তর্গতভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে সামরিক বাহিনীর মাঠে উপস্থিতির পরও এমন ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য।

শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ আদতে কোনো রাষ্ট্র ছিল না, ছিল ‘মগের মুল্লুক’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই আলাপ এখন অনেকেই তুলছেন এই সরকারের সময়ে দেশ ‘মবের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে কি না। বিশেষ করে ধর্মের নামে তৈরি হওয়া মব নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছুই করতে পারেনি কিংবা পরিকল্পিতভাবেই করেনি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো পত্রিকা বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডানপন্থী উগ্রবাদীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খানিকটা সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে, এমন শিরোনামে রিপোর্ট করেছে। 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি না বাড়ার মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য আছে সরকারের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি বাস্তবায়নের চেয়ে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে চাহিদা হ্রাস পাওয়ার বড় প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া এই সরকারের ক্যাবিনেটকে মোটাদাগে দুর্নীতিমুক্ত বলেই মনে করা হয়, যদিও সরকারি অফিসে দুর্নীতি দমনে সরকার কিছুই করতে পারেনি। এমনকি পারেনি বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলদারির মতো ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে।

একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তাদের চিন্তা এবং আদর্শগত মতপার্থক্য বা ভিন্নতা থাকবেই কিন্তু প্রত্যাশিত ছিল শেখ হাসিনা–পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আচরণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা অনেক ভালো থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে না গেলেও দলগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ করছে। দীর্ঘকাল একটা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মিথস্ক্রিয়া থেকে অনেক দূরে ছিল দীর্ঘকাল। তাই এমন সংকট হয়তো অভাবনীয় নয়। কিন্তু এটাকেও আমরা বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম যদি গণ-অভ্যুত্থানের ঠিক পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই এর কৃতিত্ব দাবি করে অন্যদের অবদানকে তুচ্ছ করার প্রবণতাকে আমরা রোধ করতে পারতাম। একই সঙ্গে সরকারের দিক থেকে একটি দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করাও রাজনীতিতে অবিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।

শেখ হাসিনার পতন–পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি হতাশা তৈরি করেছে সম্ভবত গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এবং সামনের সারিতে থাকা ছাত্রদের কেউ কেউ নানা রকম অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছেন বলে সাধারণের মধ্যে ধারণা তৈরি হওয়া। জুলাইয়ের নামে নতুন ‘চেতনা ব্যবসা’ চালু করছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ উমামা ফাতেমা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনটি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেটা দীর্ঘদিন থেকে সমাজে প্রচলিত ধারণাকেই শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।

যাঁরা চেয়েছিলেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘটা স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানটিকে বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বিপ্লবী সরকার গঠনের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করে, ছাত্রদের দিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে, রাষ্ট্রক্ষমতা দীর্ঘকালের জন্য কুক্ষিগত করবেন, তাঁরা হতাশ হয়েছেন। যাঁরা চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারটিকে যতটা সম্ভব (নিদেনপক্ষে পাঁচ বছর) টেনে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব উপভোগ করা, হতাশা আছে তাঁদেরও; কারণ দেশ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। হতাশ হয়েছেন তাঁরাও, যাঁরা চেয়েছেন এবারই এই বাংলাদেশের সব ধরনের সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার করে আমাদের গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ী করে তুলবেন। তাঁদের এ ধরনের চিন্তার সদিচ্ছাকে প্রশ্ন না করেও বলা যায়, এটা শিশুতোষ অতি আশাবাদ। এখন পর্যন্ত সংস্কার নিয়ে যেভাবে আলাপ–আলোচনা হয়েছে এবং যতটুকু মতৈক্য হয়েছে, সেটা খুবই আশাব্যঞ্জক।

এই অভ্যুত্থানের সুফল আমরা যতটা পেলাম, শেষ পর্যন্ত সেটা খুব সন্তোষজনক নয় বটেই। যদি শুরুতেই এ গণ-অভ্যুত্থানটাকে বিপ্লব বলে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা না করতাম এবং একটা দক্ষ সরকার পেতাম, তাহলে এর সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া সম্ভব ছিল। একটা বিপ্লবের কাছে একটা জাতি এবং রাষ্ট্র যা চাইতে পারে, একটা গণ-অভ্যুত্থানের কাছে কোনোভাবেই সেটা চাইতে পারে না। বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে যদি আমরা আমাদের গণ-অভ্যুত্থানটাকে এবং এর ধরনটাকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারতাম, তাহলে আমরা অনেক বেশি বাস্তব স্বপ্ন দেখতে পারতাম, বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্য ঠিক করতে পারতাম।

সবকিছুর পরও আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার প্রধান বাধা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পেরেছি আমরা। এবং এর পরবর্তী সময়ে বিপ্লবের নামে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করতে পেরেছি আমরা, এগুলো আমাদের খুব বড় অর্জন। ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে হাঁটতে, আলোচনা-বিতর্ক (মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝঁাটি) করতে করতে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বাকি ইস্যুগুলোর সমাধান করতে পারব।

জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ খ হ স ন র পতন গণত ন ত র ক পর স থ ত সরক র র ব যবস থ পরবর ত র জন য র প রব ক ষমত দলগ ল ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

চবিতে শিবিরকে নিয়ে ছাত্রদলের মিথ্যাচারের অভিযোগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে শাখা ছাত্রদল নেতৃবৃন্দের মিথ্যাচার ও অপবাদের অভিযোগ তুলে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চবি শিবির।

বুধবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে শাখা শিবিরের প্রচার সম্পাদক ইসহাক ভূঁঞা স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

এর আগে, মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) চাকসু নির্বাচন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে শাখা ছাত্রদল। সেখানে লিখিত ও মৌখিকভাবে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ শাখা শিবিরের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ করেন।

আরো পড়ুন:

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দেয়াল টপকাতেই হাতে ঢুকল রড

৬ ঘণ্টা পর রেলপথ ছাড়লেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) চাকসু নির্বাচন ও ক্যাম্পাস পরিস্থিতি বিষয়ে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চবি ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে নানান অপবাদ এবং সুস্পষ্ট মিথ্যাচার করেছে। এসব ভিত্তিহীন অভিযোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে শাখা ছাত্রশিবির।

সংবাদ সম্মেলনে শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর আলোচনায় শিবির এমফিল-পিএইচডির পক্ষে ও বয়স ৩০ এর কথা বলাই প্রশাসন সেটা নির্ধারণ করেছে বলে জানায়।

এর জবাবে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ছাত্রশিবির এমফিল, পিএইচডির পক্ষে ছিল মর্মে ছাত্রদল নেতা সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়ের দেওয়া উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, এমফিল-পিএইচডিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবেই পরিগণিত হয়। এজন্য সে সভায় উপস্থিত ছাত্রশিবির নেতৃবৃন্দ এই বিষয়ে নীরব থেকে অন্যদের মতামতকে সম্মান জানিয়েছে।

এমফিল ও পিএইচডিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং বয়সসীমা নির্ধারণের বিষয়ে পরবর্তীতে গৃহীত সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একান্ত নিজস্ব। এতে ছাত্রশিবিরের কোনো প্রকার সম্পৃক্ততা নেই।

সংবাদ সম্মেলনে হলে আসন বরাদ্দ এবং ডাইনিং পরিচালনা নিয়ে শাখা ছাত্রদল সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিনের বক্তব্যের জবাবে বলা হয়েছে, চবির হল ও ডাইনিং পরিচালনা প্রশাসনের নির্ধারিত নিয়ম ও নীতিমালার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী তারা মেধার ভিত্তিতেই সবগুলো হলে আসন বরাদ্দ দিয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে ডাইনিং পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রশিবির কোনোভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণ বা মতপ্রকাশে বাধা প্রদান করে না। বরং শিবির সর্বদা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত ব্যবস্থাপনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমরা চবি ছাত্রদল সভাপতির এমন মিথ্যাচার ও অপবাদের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

কমিটি নিয়ে চবি ছাত্রদল সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমানের বক্তব্যের উত্তরে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক অজ্ঞতাবশত অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ভুল তথ্য ছড়িয়েছেন। চবি ছাত্রশিবির প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও প্রত্যেকটি হল ও অনুষদে বছরের শুরুতেই কমিটি নবায়ন করেছে এবং সেটা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করা হয়েছে। 

কমিটি ঘোষণার পর থেকে বিগত ৭ মাস যাবত প্রকাশ্যেই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন, কল্যাণমূলক কার্যক্রম এবং নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অপরদিকে, শাখা ছাত্রদল হল কমিটি দূরে থাক, ২০২৩ সালে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি দিলেও লোকবল সংকট বা গুপ্ত রাজনীতি করার উদ্দেশ্যে অথবা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

গত ২১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থানীয় যুবলীগ সন্ত্রাসী হানিফ ও ইকবাল কর্তৃক ককটেল বিস্ফোরণ এবং দোকান ভাঙচুরের পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে যেখানে সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা হয় এবং কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। উক্ত ঘটনাকে মব বলে সন্ত্রাসীদের পক্ষপাতীত্ব করা এবং হামলাকে সহজিকরণ করার হীন চেষ্টার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

গত ৬ আগস্ট জীববিজ্ঞান অনুষদের একটি কক্ষে কিছু শিক্ষার্থীর মাঝে কুরআন বিতরণ করে জীববিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রশিবির। যা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে, শ্রেণী কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক সম্প্রীতি নষ্টের উদ্দেশ্যেই ছাত্রদের জন্য কল্যাণমূলক এই কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে জলঘোলা করা হচ্ছে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সংবাদ সম্মেলনে চবি ছাত্রদলের দেওয়া লিখিত বক্তব্যের ৩ নং পয়েন্টে শাখা ছাত্রশিবিরের তৎকালীন অফিস সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন রনিকে নিয়ে মিথ্যা দোষারোপ করা হয়েছে। বর্ণিত ঘটনার প্রকৃত রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ৫ আগস্টের পর চবির বন্ধ হল থেকে গার্ডদেরকে ধাক্কা দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী দাউদ সালমানকে সনদ এবং অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের হাতে ব্যাগভর্তি নেশাজাতীয় দ্রব্য এবং শটগানসহ হাতেনাতে আটক হয়।

পরবর্তীতে তাকে শটগানসহ সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী উপস্থিত সাংবাদিক এবং বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার উপস্থিতিতে গুলিসহ সন্ত্রাসী আটক হয়েছে মর্মে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। উক্ত ঘটনাকে ভিন্নভাবে বর্ণনা দিয়ে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে শাখা ছাত্রশিবির।

বিবৃতির বিষয়টি নিশ্চিত করে চবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, “চবি ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শাখা ছাত্রদল নেতৃবৃন্দের এমন মিথ্যাচার ও অপবাদের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ৫ আগস্ট পরবর্তী এ দেশে আমরা এমন অপরাজনীতি আশা করিনি।”

ঢাকা/মিজান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সোনারগাঁয়ের আলোচিত চেয়ারম্যান লায়ন বাবুল গ্রেপ্তার
  • ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা চ্যালেঞ্জের
  • বাহাত্তরের ‘সরব কণ্ঠ’ বীর উত্তম জিয়াউদ্দিন, নীরবেই চলে গেলেন
  • চবিতে শিবিরকে নিয়ে ছাত্রদলের মিথ্যাচারের অভিযোগ
  • গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি