হলি আর্টিজান হামলার ৯ বছর, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি আসামিদের
Published: 1st, July 2025 GMT
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের ১ জুলাই এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস এই হামলায় ২০ জন জিম্মি নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিদেশী নাগরিক। এছাড়াও নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
এ ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক নাড়া দেয়। ইতোমধ্যে বিচারিক আদালতে মামলার সাত আসামিকে বিচার সম্পন্ন হয়ে মৃত্যুদণ্ড রায় দেওয়া হয়েছে। তবে আসামিদের আপিলে উচ্চ আদালতে বিচারের অপেক্ষায় আছে মামলাটি।
ঘটনার দিন রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকার গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর প্লটে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে পাঁচজন সশস্ত্র জঙ্গি প্রবেশ করে। তারা সেখানে থাকা দেশি-বিদেশি লোকজনকে জিম্মি করে এবং নির্বিচারে গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালায়। নব্য জেএমবির এই জঙ্গিরা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল এবং আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছিল।
আরো পড়ুন:
‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ প্রচারণাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে: কমিশন
আয়নাঘরে বন্দি করে জঙ্গি নাটক বানিয়েছে: জামায়াত আমীর
তারা বেকারির ভেতরে প্রবেশ করেই এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে এবং বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করে। হামলাকারীরা ছিল নব্য জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ)-এর সদস্য। হামলার খবর পেয়ে র্যাব ও পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং এলাকাটি ঘিরে ফেলে। জঙ্গিরা ভেতরে জিম্মিদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।
নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয় ও একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও দুইজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন।
এছাড়া দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা (ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ সালাউদ্দিন খান), রেস্তোরাঁর দুই কর্মচারী (অভিযান শেষে ও হাসপাতালে) নিহত হন। এ হামলায় আরো অনেকে গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
এরই মধ্যে হামলার খবর শুনে ভেতরে জিম্মি হয়ে থাকা অতিথিদের স্বজনেরর বেকারির আশপাশে এসে অবস্থান নেন। তাদের চোখে মুখে ছিল আতঙ্ক, স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর প্রায়; করতে থাকেন আহাজারি। অনেকেই ভেতরে জিম্মিদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া না আসায় বাড়তে থাকে হতাশা।
জঙ্গিরা রেস্টুরেন্টের অতিথিদের মধ্যে যারা পবিত্র কোরআনের আয়াত বলতে পেরেছিল, শুধু তাদেরই রেহাই দিয়েছিল। বাকিদের, বিশেষ করে বিদেশিদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তারা।
হামলার খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায় এবং রাত সাড়ে ৯টার দিকে তৎকালীন বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ সালাউদ্দীনসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। সালাউদ্দিন খান পরে হাসপাতালে মারা যান।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। পরদিন সকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডো দল ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামে একটি উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া এই অভিযানে প্রায় ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে। অভিযানে পাঁচ হামলাকারী জঙ্গি নিহত হয় এবং ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার পর ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায় ঘোষণা করে। রায়ে আট আসামির মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং একজনকে খালাস দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মোহাম্মদ আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ, মামুনুর রশিদ রিপন। এই রায় পরবর্তীতে উচ্চ আদালতেও আপিল হয়।
হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনাটি বিশ্ব জুড়ে নিন্দিত হয়। বিভিন্ন দেশ এ হামলার তীব্র নিন্দা জানায় এবং বাংলাদেশের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। এই হামলা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করলেও এর পরবর্তীতে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে কঠোর অবস্থান নেয়। হামলার পর থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়, যার ফলে নব্য জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমে অনেকটাই ভাটা পড়ে।
এই হামলা বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসে একটি নতুন মোড় এনেছিল এবং এটি প্রমাণ করেছিল যে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের প্রভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও প্রসারিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গিবাদ দমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই যে হবে, তা ঠিক না। এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কেননা মতাদর্শ কখনো মরে যায় না। এ কারণে নিখুঁত হামলা আমলে রেখে জঙ্গিরা যে এসব সুযোগ আবারো নেবে না, সেই সন্তুষ্টি নেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের বিরুদ্ধে সবসময় নিবিড় নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা তারা দমে থাকলেও নির্মূল হয়নি।
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আস ম আর ট জ ন
এছাড়াও পড়ুন:
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার রায় ঘিরে দেশজুড়ে ‘সতর্কতা’
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকালে এই রায় ঘোষণা হওয়ার কথা। রায় ঘোষণা আদালত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে দেশের মানুষকে দেখানোর সুযোগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আরো পড়ুন:
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন
শেখ হাসিনার মামলার রায়: ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার দাবি ফখরুলের
রায় ঘোষণা ঘিরে আগে ও পরে যাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নাশকতা না ঘটাতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে জোরদার তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, র্যাব ও যৌথ বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানী ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
রবিবার (১৬ নভেম্বর) বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এই তথ্য দিয়েছেন।
বিজিবি জানায়, সাম্প্রতি রাজধানীতে ককটেল বিস্ফোরণ এবং বিভিন্ন মহাসড়কসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটায় সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিজিবি দায়িত্ব পালন করছে, যা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনাল চত্বর ও এর আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে বহু স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। আইনজীবীদেরও পরিচয় যাচাই করে আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে নিদর্শনা দেওয়া হয়েছে।
মোতায়েন থাকবে বিজিবি ও ডিএমপির সাঁজোয়া যান। রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে পুলিশ, র্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রাজনৈতিক কার্যালয় এবং কৌশলগত মোড়গুলোতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করেছে।
মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, যৌথ অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ, র্যাবের সঙ্গে বিজিবি এবং সেনাবাহিনী সদস্যরা যৌথভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে কাজে করে যাচ্ছে। ঢাকার প্রবেশপথ, আবাসিক হোটেল, মেস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে বিশেষ তল্লাশি ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে।
নজরদারি করা হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। গ্রুপ ও মেসেঞ্জার পর্যবেক্ষণ করছেন গোয়েন্দারা। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জেলা, উপজেলা শহরগুলোতেও। এসব স্থানে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে।
মেট্রোপলিটন পুলিশ, জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে এসব স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, নগরীতে ককটেল, বোমা বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ কিম্বা নাশকতা করলে গুলি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রায়কে ঘিরে রাজধানীতে দুষ্কৃতকারীদের করার কিছু নেই। রাজধানীবাসীরও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাশকতার পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং অভিযান চালিয়ে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তেমন কিছু হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সংঘাতের আশঙ্কা থাকায় মাঠ প্রশাসনকে যেকোনো উস্কানিমূলক তৎপরতা প্রতিরোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জনগণকে গুজবে কান না দিতে এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বিভিন্ন যানবাহনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল আগুন দিয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। ১৭ নভেম্বরের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীতে শঙ্কার কিছু নেই। নাশকতাকারীদের দমনে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরাও মাঠে কাজ করছেন।
পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানের পাশাপাশি এলিট ফোর্স র্যাবও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকায় বাড়ানো হয়েছে টহল, বসানো হয়েছে তল্লাশি চেক পোস্ট। পাড়া-মহল্লা, অলিগলি, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ স্পর্শকাতর স্থানে বাড়ানো হয়েছে র্যাবের গোয়েন্দা তৎপরতা। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ভেদ করে কোনো দুষ্কৃতকারী বিশৃঙ্খলা করতে পারবে না বলে মনে করছেন র্যাব কর্মকর্তারা।
ঢাকা/এমআর/রাসেল