৫ আগস্ট, মঙ্গলবার, ঢাকার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। থেমে থেমে বৃষ্টির পানিতে ভিজছিল রাজপথ। গত বছর এই দিনেই ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এই দিনকে ‘জুলাই অভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

এই দিনে প্রায় সব টেলিভিশনের পর্দায় গত বছর এই সময়ে চলা হাসিনা সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নৃশংসতার ছবি ও বর্ণনা ভেসে উঠছিল, যা দেখে চোখ ভিজছিল বারবার।

বিকেলে একটি দুঃসংবাদে সেই চোখের পানি বৃষ্টির মতোই নেমেছে সম্মুখ রণাঙ্গনের একদল লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার চোখে। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.

) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম) (৮৩) ৫ আগস্ট ২০২৫ বিকেলে সবাইকে ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম থেকে শিয়ালকোট হয়ে জীবন বাজি রেখে ভারত হয়ে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করেছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউদ্দিন, যিনি সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, মেজর তাহের, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ মেজর মঞ্জুর এবং একজন বাঙালি সৈনিক। উল্লেখ্য, তাঁদের মধ্যে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে তাহেরকে কর্নেল পদে থাকাকালে কথিত অভ্যুত্থানচেষ্টার দায়ে সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর মঞ্জুর মেজর জেনারেল অবস্থায় প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটান এবং পরবর্তী সময়ে জিয়াপন্থী একদল সেনার হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

সদ্য প্রয়াত জিয়াউদ্দিনসহ এই দুঃসাহসী দল ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই রাতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে জীবন বাজি রেখে কাশ্মীর অঞ্চলে পাকিস্তান–ভারত সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। মেজর মঞ্জুরের বাচ্চাদের ঘুমের ওষুধ দিয়ে প্রায় অচেতন করে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যান জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা। ‌

কাশ্মীর সীমান্তে মোতায়েন দুর্ধর্ষ রেঞ্জারস, কমান্ডো ও অন্য সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে পাহাড়, নিচু খাদ, জঙ্গল ও ফসলের মাঠে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, আবার কখনো হাঁটুতে ভর করে পাড়ি দেন দীর্ঘ এক বিপৎসংকুল দুর্গম পথ। সারা রাত জীবনমৃত্যুর দোলাচলে দুলে এবং দুবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভোরের প্রথম আলোতে ভারতের সীমান্তে প্রবেশ করেন এই জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদেরই একজন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী তথা পরবর্তী সময়ে কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতীক) এই দুঃসাহসিক যাত্রা ও পরবর্তী সময়ে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরে’ শীর্ষক একটি বই লেখেন।

জিয়াউদ্দিন তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তাঁর মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা এমন চুক্তিকে দেশের জন্য ক্ষতিকর ও স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন ইমেজ, সার্বভৌম ক্ষমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক মতানুসারীদের আকাশচুম্বী ক্ষমতার কারণে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নীরব, নিথর। ‌ কিন্তু গর্জে উঠেছিলেন একজন, তিনিই জিয়াউদ্দিন। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন গণমাধ্যমকে।

আমার সৌভাগ্য, কিছু বিচ্ছিন্ন নোট সম্পাদনা করে এমন একটি বই রচনার সঙ্গে আমি সংযুক্ত ছিলাম। ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রথমা প্রকাশন বইটি প্রকাশ করে। তখন কর্নেল পাটোয়ারীর মুখে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়ার বীরত্বগাথা ও দেশপ্রেমের এক অনন্য উপাখ্যান জানতে পেরেছিলাম। আবেগ আর শ্রদ্ধা নিয়ে সামরিক হাসপাতালে অসুস্থ বীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াকে দেখতেও গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে। ‌

পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম ছেড়ে তৎকালীন মেজর জিয়াউদ্দিন ও তাঁর দল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সহায়তায় পরবর্তী সময়ে তাঁদের নেওয়া হয় দিল্লিতে। দিল্লির ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা, বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা সমরবিদ ও গোয়েন্দারা, তখন ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) ভূখণ্ডকে শত্রুমুক্ত করতে চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক তখন জিয়া, মঞ্জুর, তাহের ও পাটোয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিষয়ে বিশদ বর্ণনা ও তাদের গোপনীয় সব পরিকল্পনার তথ্য জানিয়ে যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ–পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ‌

দিল্লির পর্ব শেষে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী সঙ্গে দেখা করেন। ওসমানীর নির্দেশেই মেজর জিয়াউদ্দিন সিলেট বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ সীমান্তে যুদ্ধরত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। আর প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির অধিনায়ক ও উপ–অধিনায়কের দায়িত্ব পান ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী। ক্যাপ্টেন হাফেজ (বিএনপি নেতা), লেফটেন্যান্ট মাহবুব, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত প্রমুখ আগে থেকেই এই সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন। তাঁদের চিকিৎসক ছিলেন ক্যাপ্টেন মুজিব, যিনি পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। লেফটেন্যান্ট আকাশসহ আরও কিছু সাহসী অফিসার কর্নেল জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে পরবর্তীকালে মরণপণ লড়াই করেছিলেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পরবর ত প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

গণ–অভ্যুত্থানের সময় চানখাঁরপুলে পুলিশের পোশাকে লোকেরা হিন্দি ভাষায় কথা বলছিল

গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনেছেন বলে জবানবন্দি দিয়েছেন সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ।

গণ–অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১–এ শহীদ আহম্মেদ এই জবানবন্দি দেন। গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে গুলিতে শহীদ ছয়জনের একজন মো. ইয়াকুবের চাচা হলেন শহীদ আহম্মেদ।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল–১–এ আজ এই জবানবন্দি দেন শহীদ আহম্মেদ। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এই মামলায় আজ তিন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। এ নিয়ে এই মামলায় মোট ছয় সাক্ষী জবানবন্দি দিলেন।

আজ জবানবন্দিতে সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট তিনি, তাঁর ছেলে সালমান, তাঁর ভাতিজা মো. ইয়াকুব ও তাঁর এলাকার রাসেল, সুমন, সোহেলসহ আরও অনেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চাঁনখারপুল এলাকায় পৌঁছান। সেখানে হাজার হাজার লোক চারদিক থেকে জড়ো হচ্ছিলেন। তখন তিনি দেখেন, চানখাঁরপুল মোড়ের উল্টো পাশে অনেক পুলিশ, ছাপা পোশাকধারী পুলিশ ছিল। পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদেরকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শোনেন তিনি। পুলিশ তাঁদের বাধা দিচ্ছিল। তাঁদের লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি করে পুলিশ। তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

জবানবন্দিতে শহীদ আহম্মেদ বলেন, আবার তাঁরা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। তাঁর পাশের একজনের পায়ে গুলি লাগে। তাঁকে তিনি সরাচ্ছিলেন। তখন তাঁকে একজন বলেন, তাঁর ভাতিজা ইয়াকুবের গায়ে গুলি লেগেছে। তিনি ওই ছেলেকে আরেকজনের কাছে রেখে ভাতিজার কাছে যান। আরও দুজনসহ ভাতিজাকে অটোরিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন যে ইয়াকুব মারা গেছে।

এ মামলায় আট আসামি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। আর অপর আসামি শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম গ্রেপ্তার আছেন। আজ তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণ–অভ্যুত্থানের সময় চানখাঁরপুলে পুলিশের পোশাকে লোকেরা হিন্দি ভাষায় কথা বলছিল
  • চবিতে শিবিরকে নিয়ে ছাত্রদলের মিথ্যাচারের অভিযোগ
  • গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি
  • স্পর্শকাতর বিষয়, তদন্ত দ্রুত যেন হয় মনিটরিং করবেন
  • প্রধান বিচারপতির বাসভবন, সুপ্রিম কোর্ট ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
  • দেশে কিছু ভুয়া সমন্বয়ক সৃষ্টি হয়েছে: দুদক চেয়ারম্যান
  • পণ্ডিত অমরেশ রায় চৌধুরী আর নেই
  • ছাত্র সংসদের দাবিতে ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দৃঢ অবস্থান
  • রাবি উপাচার্যের বাসভবনে সাবেক ছাত্রদল নেতার তালা