Prothomalo:
2025-08-15@15:40:15 GMT

গণতন্ত্রের গভীর অসুখ!

Published: 15th, August 2025 GMT

প্রায় এক শ বছর আগে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার কবি জীবনানন্দ দাশের কলমে ঝরে পড়েছিল পৃথিবীর গভীরতম ক্ষতের চিহ্ন, ‘সুচেতনা’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;’ যে গভীর গভীরতর অসুখের কথা কবিতার আখরে উঠে এসেছিল, পৃথিবীর সেই অসুখ কি সেরেছে? হয়তো সারেনি, বরং ডালপালা মেলে সেই সব অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পথে পথে। এই লেখার বিষয়বস্তু গণতন্ত্র, তাই একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পেরিয়ে এসে পৃথিবীর গণতন্ত্রের দিকে তাকালে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেন নবরূপে অনুরণিত হয়, ‘গণতন্ত্রের গভীর গভীরতর অসুখ এখন;’

গণতন্ত্র; যে শব্দ একদিন মানুষের অধিকার, সমতা ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, আজ তা যেন ক্রমেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ অভিঘাতে। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র এখন এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ছদ্মবেশী কর্তৃত্ববাদ, লোকরঞ্জনবাদ, গুজব-প্রচারণা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা যেন আজ এই শাসনব্যবস্থার প্রাণশক্তিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলছে! এই অসুখ শুধু রাষ্ট্রের কাঠামোতেই নয়, আমাদের সমাজের গভীরে, আমাদের চেতনার মূলে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মাটিতে, যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় এখনো সুদৃঢ়ই হয়নি, এই অসুখের প্রভাব আরও তীব্র। তবু প্রশ্ন জাগে, এই অসুখ কি নিরাময়যোগ্য? আমরা কি এখনো চেষ্টা করলে সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি না?

আরও পড়ুননেতারা দেশে গণতন্ত্র চান, দলে চান না০১ মার্চ ২০২৫

আন্তর্জাতিক গবেষণা ও বৈশ্বিক সূচকগুলো বলছে, পৃথিবীর ৭১% জনগণ এখন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বসবাস করছে, যা এক দশক আগেও ছিল মাত্র ৪৮% (ভি-ডেম, ২০২৪)। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতার পালাবদলের সময় ক্যাপিটল হিলে কলঙ্কিত হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রথমবারের মতো ‘ব্যাকস্লাইডিং ডেমোক্রেসি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া)। সাম্প্রতিক কালেও ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আবার নির্বাচিত হয়ে এসে একের পর এক নির্বাহী আদেশে যেভাবে তাঁর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করে চলেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসেই বিরল। ট্র্যাম্প অবশ্য এবার শুধু নিজ দেশেই থেমে নেই, বাকি বিশ্বের ওপর ইচ্ছেমতো ট্যারিফ বসিয়ে প্রায় অর্থনৈতিক যুদ্ধই বাধিয়ে দিতে চলেছেন।

ফ্রিডম হাউস, ভি-ডেম ইনস্টিটিউট, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে নিয়মিতই উঠে আসছে নাগরিক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার ও আইনের শাসন—সবই ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত। উন্নত ও ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্রও এই পতনের বাইরে নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কৌশলী ক্ষমতা দখল, জনতুষ্টিবাদ, তথ্য বিকৃতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করাই এসব সংকটের মূল কারণ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনোই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দলীয় সংঘাতের ছায়ায় গণতন্ত্রের স্বপ্ন যেভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ব্যক্তিপূজা, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলান্ধতা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছে।

গণতন্ত্রের সুলুক সন্ধানে যাওয়ার আগে একটা মজার গল্প শোনা যাক। ‘একটি ছাগল শহরের চত্বরে ঘাস খেতে পারবে কি না’ তা নির্ধারণে দূরদেশ আইসল্যান্ডের ছোট্ট শহরে একবার অদ্ভুত এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের জোর কদম প্রচারণা শেষে ভোট গণনা করে দেখা গেল, ছাগলের পক্ষেই বেশি ভোট পড়েছে! অভাবনীয় সেই ছাগল–কাণ্ড শেষে স্থানীয় এক বাসিন্দা নাকি মন্তব্য করেছিল, ‘এটাই গণতন্ত্র, কখনো কখনো ছাগলও জিতে যায়’!

গণতন্ত্র কী? এই প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের গোলকধাঁধায় নিয়ে যায়। এটি কি কেবল ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া? নাকি এটি একটি জীবনদর্শন, যেখানে প্রত্যেক মানুষের কণ্ঠস্বর সমান গুরুত্ব পায়? গণতন্ত্রের সূতিকাগার প্রাচীন গ্রিসের অনেক দার্শনিকের কাছেই গণতন্ত্র ছিল একটি সন্দেহজনক ধারণা। সক্রেটিস, প্লেটো, এমনকি অ্যারিস্টটলও বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, নীতিবোধ ও প্রজ্ঞা। তাঁদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রায়ই জনতুষ্টিবাদের ফাঁদে পড়ে, যেখানে ছলাকলা আর প্রোপাগান্ডা সত্যের ওপর বিজয়ী হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা সব সময় রাষ্ট্রের মঙ্গল বয়ে আনে না। প্লেটোর মতে, গণতন্ত্র মানুষের আবেগনির্ভর, অগভীর সিদ্ধান্তে গড়া এক অবয়ব। অ্যারিস্টটল তো আরেক ধাপ এগিয়ে গণতন্ত্রকে বলেছিলেন ‘গরিবতন্ত্র’! তাঁর মতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণের হাতে ক্ষমতা গেলে শাসন হবে আত্মকেন্দ্রিক, নীতিকেন্দ্রিক নয়। যদিও বর্তমান সময়ের উদার গণতন্ত্র মোটেও এতটা সরল নয়।

আরও পড়ুনযেখানেই বৈষম্য বাড়ছে, সেখানেই গণতন্ত্র মার খাচ্ছে১৪ জুলাই ২০২৪

আধুনিক গণতন্ত্র এই প্রাচীন সমালোচনাকে অনেকাংশে অতিক্রম করেছে। আজকের উদার গণতন্ত্র কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, এটি সংখ্যালঘুদের অধিকারের নিশ্চয়তা, প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি জটিল কাঠামো। ফরাসি দার্শনিক আলবের কাম্যু বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠদের আইন নয়, বরং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা’। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে এই আদর্শ বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা।

গণতন্ত্রের সংকট এককভাবে কোনো জাতিরাষ্ট্রের সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক। তবে সমস্যার রূপ ও গভীরতা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কখনোই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দলীয় সংঘাতের ছায়ায় গণতন্ত্রের স্বপ্ন যেভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ব্যক্তিপূজা, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দলান্ধতা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছে।

আরও পড়ুন‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নয়, সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী করাই লক্ষ্য০৫ মে ২০২৫

ব্যক্তিপূজার রাজনীতি এদেশীয় গণতন্ত্রের এক গভীরতর অসুখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে বাঙালির এই প্রবৃত্তির কথা লিখেছিলেন। আমরা প্রায়ই ব্যক্তিকে দেবত্ব দিয়ে ফেলি, তাঁর কথাকে অলঙ্ঘনীয় সত্য মনে করি। ব্যক্তিপূজা থেকেই উৎপত্তি হয় বংশপরম্পরার নেতৃত্বের। রাজনৈতিক দলগুলোয় যোগ্যতার চেয়ে বংশগত উত্তরাধিকার বেশি গুরুত্ব পায়। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিপরীত। এর ফলে নেতৃত্বের গুণাবলি, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নীতিবোধ প্রভৃতির মূল্যায়ন হয় না। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো নেতৃত্ব পরিবর্তনের সুযোগ, জবাবদিহিতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা। যখন একজন নেতা তাঁর কাজ নয়, বরং পরিচয় বা বংশের কারণে অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠেন, তখন সেখানে গণতন্ত্র কেবল নামেই টিকে থাকে।

আজকের বাস্তবতায় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মধ্যে অন্যতম জনতুষ্টিবাদ, মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ও গুজব। নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যম যাদের নিয়ন্ত্রণে, জনমতও তাদের নিয়ন্ত্রণে’। এই যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার নতুন করে গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন একটি মিথ্যা খবর কয়েক মিনিটেই লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।

অন্যদিকে জনতুষ্টিবাদী নেতারা জনতার মন পেতে দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের কথা না ভেবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেন, যেমনঃ ভর্তুকি, সাময়িক সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ ইত্যাদি। যেসব দেশে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী নয়, সেখানে এই জনতুষ্টিবাদ আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। তখন নেতারা জনতার পক্ষের দাবি নিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তারপর নিজেদের সুবিধামতো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে ফেলেন। জনতুষ্টিবাদ শুধু নীতিহীনতাকেই উৎসাহিত করে না, বরং জনগণের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তার অভাবকেও তীব্র করে।

সমকালীন বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এর চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উত্থান, মব সহিংসতা এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু সামনেই যেহেতু নির্বাচন, জনতুষ্টিবাদের ফাঁদে পড়া নতুন-পুরোনো অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই এসব বিষয়ে বেশ মৌন। গণমানুষের কাছে অপ্রিয় হতে পারে, এমন কোনো কথা বললে পাছে তাঁদের ভোট কমে যায়, অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচিত হয়ে পড়েন!

আরও পড়ুনরাজনৈতিক দল থেকে কেন সংস্কার শুরু করা জরুরি০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—আব্রাহাম লিংকনের এই সংজ্ঞা সর্বজনীনভাবে গণতন্ত্রের শেষ কথা। লিংকনকে নিয়ে বিখ্যাত একটি কৌতুক স্মরণ করা যেতে পারে। যখন কেউ একজন তাঁকে গণতন্ত্র কী, জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি লেজকে পা বলি, তাতে কুকুরের কয়টি পা হবে?’ প্রশ্নকারী বললেন, ‘পাঁচটি।’ লিংকন বললেন, ‘না, লেজকে পা বললেও লেজ লেজই থাকে, পা হয়ে যায় না!’ লিংকন বোঝাতে চেয়েছিলেন যে গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং সত্যের অনুসন্ধান। বিষয়টা নিয়ে আমাদের জনগণ ও রাজনীতিবিদদের বিস্তর ভাবনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই গণতন্ত্র বলতে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসনই বুঝে থাকেন। আধুনিক উদার গণতন্ত্র মোটেই কেবল ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসন’ নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

গণতন্ত্র রক্ষার দায় শুধু শাসকের নয়, নাগরিকদেরও। জনগণ যদি দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে ‘ভোটতন্ত্র’ হয়ে যাবে। অথচ গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়, এটি অংশগ্রহণ, জবাবদিহি, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা; সব মিলিয়ে এক সম্মিলিত চেতনা। গণতন্ত্র কারও একার যাত্রাও নয়, এটি আমাদের সবার। এখানে একযোগে কাজ করতে হবে সবাইকে। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের আজকের চর্চার ওপর। গণতন্ত্র এক দিনে তৈরি হয় না। এটি গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, প্রশ্নে প্রশ্নে, প্রতিবাদে, আলোচনায়, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধায়।

আমাদের সমাজ, আমাদের শিক্ষা, আমাদের রাজনীতি; সবকিছুর কেন্দ্রে যদি থাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হতে পারে একটি প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র। গণতন্ত্রের পথ কঠিন, কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্যনীয় নয়। এটা অনেকটা নদীর মতো, কখনো তীর ভাঙে, কখনো গতি মন্থর হয়। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা আর সমষ্টিগত প্রচেষ্টা যদি আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, এই নদী একদিন নিশ্চয়ই সমুদ্রে গিয়ে মিশবে!

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র নিখুঁত তো নয়ই, এমনকি সবচেয়ে খারাপ ধরনের সরকার ব্যবস্থা। তবে বাকি যেসব ব্যবস্থা এর আগে ছিল বা আছে, সেগুলোর চেয়ে তুলনামূলক ভালো’! জীবনানন্দের যেই ‘সুচেতনা’ কবিতা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই কবিতার আরেকটি পঙ্‌ক্তি দিয়েই লেখাটা শেষ করা যাক, “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে!’

আশিনুর রেজা লেখক ও গবেষক

ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র গণত ন ত র ক প গণতন ত র র স য় গণতন ত র র জনত ষ ট ব দ র গণতন ত র গণতন ত র ম ই গণতন ত র গণতন ত র ক স ব ধ নত বল ছ ল ন দ র গণত ব যবস থ জনগণ র আম দ র এই প র দ র বল ন র জন নত র প ক ষমত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

লাঙ্গল কাউকে দিতে চাইলেই আন্দোলন: জি এম কা‌দের

জাতীয় পা‌র্টির বিরু‌দ্ধে ষড়যন্ত্র চল‌ছে। সেই ষড়য‌ন্ত্রের অংশ হি‌সে‌বে দ‌লের প্রতীক অন‌্য কাউ‌কে দি‌তে চাইলে রাজপ‌থে আন্দোলন গ‌ড়ে তোলা হ‌বে ব‌লে জা‌নি‌য়ে‌ছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।

বুধবার (১৩ আগস্ট) বিকা‌লে কাকরাইলে জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যাল‌য়ে দ‌লের ঢাকা জেলা শাখার স‌ঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ হুম‌কি দেন।

জিএম কা‌দের ব‌লেন, ‘‘আমরা বর্তমান সরকারের অপকর্মের বিরোধিতা করছি। ঝুঁকি নিয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলছি। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে আমরা থেমে যাবো না। এজন্যই জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। দ‌লের বিরু‌দ্ধে ষড়যন্ত্র হ‌চ্ছে, যা‌তে আমরা আগামী‌তে নির্বাচ‌ন কর‌তে না পা‌রি। আমা‌দের প্রতীক নি‌য়ে চক্রান্ত হ‌চ্ছে।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘স্পষ্ট ভাষায় বল‌তে চাই, আমাদের লাঙ্গল অন্য কাউকে দিতে চাইলে আমরা রাজপথে আন্দোলন করব। যারা ভূমিকা রাখতে পারবে, তারাই জাতীয় পার্টির প্রকৃত নেতা। সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকব। জনগণের জন্য জীবন দিতেও রাজি আছি। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করবোই।’’ 

জিএম কা‌দের ব‌লেন, ‘‘আমাদের দলীয় প্রতীক অন্যদের দেয়া হবে— এমন ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাক মেইল করেছিল আওয়ামী লীগ। এখন আবার সেই খেলা শুরু হয়েছে। বিএনপির জনসমর্থন বেশি তাই শেখ হাসিনা আরেকটি দল সাজিয়ে তাদের ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার সাহস করেনি। বিএনপি মজলুম দল ছিল তাই সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন করেছে। এখন আমরাও মজলুম। আমরাও জনগণের সমর্থন অর্জন করতে পারব। এখন জাতীয় পার্টি ছাড়া সব দলই সরকারি দলের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। সরকার আমাদের পিছে লেগে রয়েছে। সুবিধা তো দূরের কথা, আমরা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে পারি না। জনগণের চোখে এখন আমরাই মজলুম।’’

‘‘শেখ হাসিনা সরকার আইনের মারপ্যাঁচে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, এখন এই সরকারও আইনের মারপ্যাঁচে আমাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দেশীয় রাজনীতিবিদ ও বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে একটি সফল সম্মেলনে আমাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে আমি যাকে নিয়োগ দিয়েছি, তাকে বাদ দেয়ার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ক্ষমতাও আছে। আওয়ামী লীগ সরকার যা করেছে, বর্তমান সরকারও তাই করছে, পরিবর্তন কী হলো? আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার বলা হয়, একই কাজ যদি বর্তমান সরকারও করে তাকে কী বলবেন?’’ প্রশ্ন রা‌খেন জিএম কা‌দের।

আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না জা‌নি‌য়ে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, আমি তার প্রতিবাদ করেছি। একইভাবে এখন বলছি, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’’ 

তি‌নি ব‌লেন, ‘‘জুলাই গণহত্যায় অনেক মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আমার এবং আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা হত্যা মামলা দেয়া হয়েছে। মিথ্যা মামলায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের জামিন দেয়া হচ্ছে না। আইন উপদেষ্টা ও আইজিপি বলেছেন— অনেক মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। তাহলে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের জামিন দেয়া হচ্ছে না কেন? আইনের কথা হচ্ছে, একজন নিরপরাধকে বাঁচাতে প্রয়োজনে দশজন দোষীকে ছেড়ে দাও। কিন্তু এখন কী হচ্ছে?  একজন দোষীকে শাস্তি দিতে দশজন নিরাপদ মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে। বাড়িঘর ও অফিসে আগুন দিয়ে, মামলা হামলা করে আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।’’  

দে‌শের বর্তমান প‌রি‌স্থি‌তি উল্লেখ ক‌রে কা‌দের ব‌লেন, ‘‘দেশের মানুষের মুখে হাসি নাই।  দেশের মানুষ আতঙ্কের মাঝে বসবাস করছে। এখন যারা যা খুশি করতে পারে তারা তো নির্বাচন চাইবে না। নির্বাচন যত পিছিয়ে যাবে, ততই তাদের লাভ। জনগণের কথা তাদের বিবেচনায় নেই। নির্বাচন চাই না, এটা বলার আপনি কে?  সবাইকে বলতে দিন, এটাই তো গণতন্ত্র। স্বৈরাচার হবেন? থাকতে পারবেন না। এদেশের মানুষ স্বৈরতন্ত্র মেনে নেয় না।’’

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান বলেন,  ‘‘জাতীয় পার্টির পরিষ্কার কোন রাজনীতি ছিল না। জাতীয় পার্টি কী করতে চায় তা নিয়ে নেতাকর্মী ও জনমনে বিভ্রান্তি ছিল। এখন থেকে আমরা জনগণের পক্ষের রাজনীতি করব। এতদিন জনগণ ভোট দিতে পারে নাই, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আমি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলাম। মানুষের ভোটের অধিকারের জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, আমরা সর্বাত্মকভাবে তার সঙ্গে ছিলাম। ছাত্ররা যখন কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে, আমি তাকে বলেছিলাম— বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন।  ছাত্রদের ওপর যখন জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়েছিল, তখন সকলস্তরের মানুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেয়। এখন যদি বলে শুধু তারাই আন্দোলন করেছে, তা সঠিক নয়। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেছিল কিন্ত সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সেই আন্দোলন সফলতা পেয়েছে। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্ররা জীবন দিয়েছে, এখন সারাদেশে সকল স্তরে বৈষম্য চলছে।  দোসর অপবাদ দিয়ে মানুষের ঘর, বাড়ি ও কলকারখানায় আগুন দেয়া হয়েছে।’’  

জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, ইঞ্জিঃ ইকবাল হোসেন তাপস, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা খলিলুর রহমান খলিল, যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাদুর ইসলাম ইমতিয়াজ, রমজান আলী ভূঁইয়া, ঢাকা জেলা নেতা আশরাফুজ্জামান আশু, মশিউর রহমান তাপস, লাইজুল ইসলাম, ইউসুফ, শাহজাদা। উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা একেএম নুরুজ্জামান জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের, দফতর সম্পাদক মাহমুদ আলম, এনজিও বিষয়ক সম্পাদক মোড়ল জিয়াউর রহমান, যুগ্ম সাংগঠনিক শেখ সরোয়ার, যুগ্ম দফতর সমরেশ মন্ডল মানিক।

ম‌হিলা পা‌র্টির সভা 
আজ বুধবার (১৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় মহিলা  পার্টির এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও বিশেষ অতিথি হিসেবে পার্টি মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বক্তব্য রাখেন।

হেনা খান পন্নির সভাপতিত্বে এই সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, শেরীফা কাদের, নুরুন নাহার বেগম, উপদেষ্টা লাকী বেগম, খলিলুর রহমান রহমান খলিল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য রিতু নূর, জেসমিন নূর প্রিয়াঙ্কা প্রমুখ। 

উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিঃ ইকবাল হোসেন তাপস, ভাইস চেয়ারম্যান এমএ সোবাহান, আখতার হোসেন দেওয়ান, হুমায়ুন খান, যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন চাকলাদার।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খালেদা জিয়ার জম্মবার্ষিকী উপলক্ষে মহানগর বিএনপির দোয়া 
  • শেখ মুজিব জাতির জনক নন, তবে তার ত্যাগ স্বীকার করি: নাহিদ
  • ফ্যাসিবাদের জায়গায় তারেক রহমান গণতন্ত্রের সূচনা করবেন: নজরুল ইসলাম
  • জি এম কাদের ছাড়া অন্য কারও লাঙ্গল পাওয়ার সুযোগ নেই: শামীম হায়দার পাটোয়ারী
  • নির্বাচনী ব্যবস্থার অসংগতি দূর করতে কয়েকটি প্রস্তাব
  • লাঙ্গল কাউকে দিতে চাইলেই আন্দোলন: জি এম কা‌দের
  • বাংলাদেশের ‘তরুণকম্পের’ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
  • গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি
  • জুলাই সনদে এক বিন্দু ছাড় নয়: নাহিদ