বোয়িংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল, শেয়ারের দাম বাড়ল ৪ শতাংশ
Published: 28th, September 2025 GMT
মার্কিন বিমান কোম্পানি বোয়িংয়ের শেয়ারের দাম গতকাল শুক্রবার প্রায় ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) কোম্পানির ৭৩৭ ম্যাক্স ও ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানের ওপর আরোপিত সীমাবদ্ধতা শিথিল করেছে, এমন খবরে কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত বোয়িংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই দুই মডেলের বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে কোম্পানিটি কড়া নজরদারির আওতায় ছিল। খবর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
বিষয়টি হলো, মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার ১৮ মাসের কঠোর নজরদারি ও মূল্যায়নের পর ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বোয়িংকে কিছু ৭৩৭ ম্যাক্স ও ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের জন্য আবার নিরাপত্তা সনদ দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে।
একসময় বোয়িংয়ের এই ক্ষমতা ছিল। কিন্তু একের পর এক নিরাপত্তার ত্রুটি ও একাধিক দুর্ঘটনার কারণে বোয়িংকে নিজেদের কিছু বিমান মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপদ বলে সনদ দেওয়ার অনুমতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সাধারণত বিমান নির্মাতাদের এফএএর পক্ষে কিছু কার্যক্রম করার অনুমতি দেওয়া হয়, যেমন ওড়ার উপযুক্ততা ও উৎপাদন সনদ। তবে বোয়িং এই দুই মডেলের ক্ষেত্রে সেই অনুমতি হারিয়েছিল।
মূলত বড় দুটি বিমান দুর্ঘটনার জেরে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রাণঘাতী লায়ন এয়ারের দুর্ঘটনার জন্য ৭৩৭ ম্যাক্স ও ২০২২ সালে ইথিওপিয়ান এয়ার দুর্ঘটনার ৭৮৭–এর ক্ষেত্রে এই অনুমতি বাতিল করা হয়েছিল। জানুয়ারি ২০২৪ সালে ৭৩৭ ম্যাক্সের একটি দরজার প্লাগ ভেঙে যাওয়া এবং এরপর সরকারি তদন্তে যে বিব্রতকর সত্য বেরিয়ে আসে, তার জেরে বোয়িং চাপে পড়ে।
এরপর ৭৩৭ ম্যাক্স ও ৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেলের সব বিমান ২০ মাসের মতো বসিয়ে রাখতে হয়েছে। তখন তারা বিমানের মান ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে বড় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ ঘটনায় ২০২৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বোয়িংয়ের প্রায় ৩৫ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার পরিচালন ক্ষতি হয়। খবর সিএনএন
তবে এফএএ নিরাপত্তা সনদ দেওয়ার ক্ষমতা এখনই বোয়িংয়ের কাছে সম্পূর্ণভাবে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত নয়। গতকাল সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রতি দুই সপ্তাহে একবার বোয়িং বিমান ওড়ার উপযুক্ততা সনদ দিতে পারবে। অন্য সময় সংস্থাটি নিজেই সনদ দেবে।
এফএএ বিবৃতিতে বলেছে, ‘নিরাপত্তাই আমাদের মূলকথা। এফএএ কেবল তখনই এই পদক্ষেপ অনুমোদন করবে, যখন নিশ্চিত হওয়া যাবে, বিষয়টি নিরাপদভাবে করা সম্ভব। বোয়িংয়ের চলমান উৎপাদন মানের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় আরও বেশি নজরদারি করার সুযোগ দেবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, পরিবর্তনগুলোর পরেও সংস্থা বোয়িংয়ের উৎপাদনের প্রক্রিয়ার ‘সরাসরি ও কঠোর নজরদারি’ বজায় রাখবে। গত দেড় বছরে কয়েকজন হুইসেলব্লোয়ার (এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের ভেতরের অবৈধ, অনৈতিক বা ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম প্রকাশ করেন) বোয়িংয়ের নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণের ত্রুটিগুলো সামনে এনেছেন। এর মধ্যে ৭৩৭ ম্যাক্স ও ৭৮৭–এর উৎপাদনের প্রক্রিয়াও রয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের বিচার বিভাগ মনে করত, বোয়িংয়ের বিমানে যেসব নিরাপত্তার ত্রুটি হচ্ছে, সেগুলো নিরাপত্তাজনিত আগের এক চুক্তির লঙ্ঘনের কারণে হচ্ছে। এরপর বোয়িং গত বছর সেই দুই প্রাণঘাতী ৭৩৭ ম্যাক্স দুর্ঘটনার জন্য দোষ স্বীকার করতে রাজি হয়েছিল, যে দুটি দুর্ঘটনায় ৩৪৬ জন নিহত হয়েছিলেন।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের বিচার বিভাগ এই ফৌজদারি মামলা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। করপোরেটদের অপকর্মের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান যে শিথিল, এটি তার আরেকটি উদাহরণ।
বিক্রি বাড়ছেসম্প্রতি টার্কিশ এয়ারলাইনস ও নরওয়েজিয়ান গ্রুপের কাছ থেকে নতুন বিমান সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছে বোয়িং। ইন্দোনেশিয়া ও জাপান বোয়িংয়ের শত শত যাত্রীবাহী বিমান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে বছরের শুরুতে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার বোয়িংয়ের বিমান কেনার ঘোষণা দেয়।
বিষয়টি হলো, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেসব বাণিজ্যচুক্তি করছে, তার অংশ হিসেবে বোয়িং ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন বিমান সরবরাহের কার্যাদেশ পাচ্ছে। এ ধরনের বিক্রি বোয়িংয়ের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। কেননা, কোম্পানিটি কয়েক বছর ধরে নানা সংকটে আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করতে পারেন, তাঁর ব্যতিক্রমী বাণিজ্যের নীতি মার্কিন উৎপাদন খাতের পালে হাওয়া দিচ্ছে।
এদিকে পাল্টা শুল্ক নিয়ে দর–কষাকষির অংশ হিসেবে বাংলাদেশও বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুই এয়ারলাইনসের সঙ্গে চুক্তি ও তার সঙ্গে এফএএর কিছু নিরাপত্তা সনদ পুনর্বহালের পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। এ বাস্তবতায় বিশ্লেষকেরা বোয়িংয়ের ব্যবসায়িক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা দেখছেন। যদিও গত কয়েক বছরে বোয়িং যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে, তাতে সামনে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র ঘটন র নজরদ র হয় ছ ল র জন য সনদ দ
এছাড়াও পড়ুন:
৪১ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন গাইবান্ধার রহিম
গাইবান্ধার পত্রিকা বিক্রেতা আবদুর রহিম। বাড়ি পলাশবাড়ী পৌরসভার নুনিয়াগাড়ি এলাকায়। বয়স ৭১ বছর। এই বয়সেও তিনি ঘুমভাঙা চোখে একনজর পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেন। পত্রিকা গুছিয়ে বগলে চেপে ছুটে চলেন পাঠকের কাছে। ‘ভাই, আজকে গরম খবর আছে’ বলেই পাঠকের হাতে এগিয়ে দেন পত্রিকা।
এক পাঠক থেকে আরেক পাঠকের কাছে যান আবদুর রহিম। পত্রিকা বিলি করেন সকাল ৬টা থেকে টানা ৭ ঘণ্টা। বিকেল ৫টা থেকে ৪ ঘণ্টা বিলি করা পত্রিকার টাকা সংগ্রহ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় হেঁটে পত্রিকা বিলি ও টাকা সংগ্রহ করেন। দূরের পাঠকের কাছে যান বাইসাইকেলে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হেঁটে বিলি করেন পত্রিকা। এভাবেই দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে গাইবান্ধায় পত্রিকা বিলির কাজ করছেন তিনি।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ শুরু করি। বেলা ১টার দিকে শেষ হয়। উপজেলা সদরে হেঁটে বিলি করি। তবে সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে জুনদহ, কালীতলা, ঢোলভাঙ্গা, হোসেনপুর এলাকায় সাইকেলে যাই। এসব জায়গায় সাইকেল রেখে হেঁটে পত্রিকা বিলি করি। দুপুরে বাড়িতে বিশ্রাম নিই। এরপর পত্রিকা বিক্রির টাকা তোলা শুরু করি। টাকা তুলতে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি হয়ে যায়। এ রকম ব্যস্ততায় কীভাবে ৪১ বছর কেটে গেল, টেরই পেলাম না! তবে পত্রিকা বিলি করে আনন্দ পাই। অনেক পাঠক আমাকে ভালোবাসেন, খোঁজখবর নেন।’
দীর্ঘ সময় পত্রিকা বিলি করতে সমস্যা হয় কি না, তা জানতে চাইলে আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার কোনো অসুখবিসুখ নেই। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, তত দিন এই কাজ চালিয়ে যাব।’
ব্যবসার শুরুরহিমের পৈতৃক বাড়ি রংপুর শহরের আরাজি গুলাল বুদাই এলাকায়। সেখানে তাঁর বাবার ৩ শতাংশ জমিতে বসতভিটা ছিল। এ ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। বাবা আবেদ আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। লেখাপড়া করেছেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন একই এলাকায়। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। দারিদ্র্যের কারণে সংসার চালানো একসময় কঠিন হয়ে পড়ে।
রহিমের খালাতো ভাই রংপুর শহরে পত্রিকা বিলি করতেন। তাঁর পরামর্শে ১৯৮৪ সাল থেকে রংপুরে স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে আবদুর রহিমের এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বাসে ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন পত্রিকা। প্রতিদিন রংপুর থেকে বাসে উঠে পলাশবাড়ী পর্যন্ত আসেন। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। এরপর পলাশবাড়ীর স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। ছয় মাস থাকেন সেখানে। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় নুনিয়াগাড়ি এলাকায় সোয়া ৮ শতাংশ জমি কিনে টিনশেড ঘর বানান। বাড়ি থেকে ব্যবসা করতে থাকেন। পলাশবাড়ী চারমাথা এলাকায় বসে ঢাকা, রংপুর ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা সংগ্রহ করে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে বিক্রি করতে থাকেন।
হকার থেকে এজেন্টকয়েক বছর পর আবদুর রহিম নিজের নামে বেশ কিছু পত্রিকার এজেন্সি নেন। পত্রিকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় একা সামলাতে পারছিলেন না। তাই চারজন লোক নিয়োগ করেন। তাঁরা এখনো রহিমের কাছে কমিশনে পত্রিকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ব্যবসা শুরুর সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ কপি পত্রিকা বিলি করতেন। মাসিক আয় ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কয়েক বছর পর পাঠকের চাহিদা বেড়ে যায়। সে সময় মাসিক আয় হতো ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে ছাপা পত্রিকার পাঠক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কপি পত্রিকা বিলি করছেন। বর্তমানে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রিকার ব্যবসা করে রংপুর থেকে এসে পলাশবাড়ীতে বাড়ি করতে পেরেছি, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। সততার সঙ্গে চলছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।’
পলাশবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘আবদুর রহিমকে বহু বছর ধরেই পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। তাঁকে দেখে মনে হয় না ৭১ বছর বয়স হয়েছে। তাঁর মধ্যে ক্লান্তি দেখা যায় না। দিন-রাত পরিশ্রম করেন। কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন।’