Prothomalo:
2025-11-17@09:17:40 GMT

দুর্গাপূজা ও ঠাকুর পরিবার

Published: 30th, September 2025 GMT

বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র উৎসবের দিনই একজনের গৃহ সবার গৃহ হয়। অতএব উৎসব সবার। এতে আকার–নিরাকারের ভেদ থাকবে কেন?

এই দিনে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের দোলা হয়। ১৯০৩ সালের ২২ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ বোলপুর থেকে কাদম্বরী দেবীকে চিঠিতে লেখেন, ‘সাকার–নিরাকার একটা কথার কথামাত্র। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর নন, আমরা প্রত্যেকে সাকার এবং নিরাকার। তাঁকে রূপে ও ভাবে, আকারে এবং নিরাকারে, কর্মে ও প্রেমে সব রকমেই ভজনা করতে হবে। আকার তো আমাদের রচনা নয়। এই আকার তাঁরই।’

কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপূজার সময় প্রবাসে কাটাতেন। এ জন্য দুর্গাপূজা উপলক্ষে যাত্রা, গান ইত্যাদি যা কিছু হতো, তাতে পরিবারের অন্যরা মেতে থাকলেও দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সরাসরি এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন না। কিন্তু ষষ্ঠীর দিন ছেলেমেয়েদের, আত্মীয়স্বজনদের, কর্মচারী, ভৃত্য এমনকি ঝিদেরও নতুন জামাকাপড় দেওয়া হতো। দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ ছিলেন এবং প্রচুর খরচ করতেন। তিনি মোয়া, ক্ষীর ইত্যাদি মিশিয়ে বৃহদাকার মিঠাই তৈরি করাতেন এবং সবাইকে আপ্যায়ন করতেন।

আবার রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়েছেন, ‘দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, ধূপধুনো–বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য–আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস।’

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনী দেবী লিখেছেন, ‘আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল, ছেলেরা তখন বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরে প্রতিমার সঙ্গে চলত। আমরা মেয়েরা তেতলার ছাদে উঠে প্রতিমা বিসর্জন দেখতাম।’

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিজয়ার রাতে শান্তিজল দান ও ছোট-বড় সবার মধ্যে কোলাকুলি খুব প্রিয় ছিল।

নিজেদের বাড়িতে হতো বিজয়া সম্মিলনী। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বসত মস্ত জলসা। খাওয়াদাওয়া, তাতর পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি। ঝাড়বাতি জ্বলত। ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন।’

ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো। ভাসানের সময়ও তা খুলে নেওয়া হতো না। সালংকারা মা দুর্গাকে বিসর্জন দেওয়া হতো।’

তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দশ বছর পরও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজা আর জগদ্ধাত্রীপূজা অনুষ্ঠিত হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভাই নগেন্দ্রনাথের মতে, ‘দুর্গোৎসব আমাদের সমাজবন্ধন, বন্ধুমিলন ও সবার সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। এর উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। করলে সবার মনে আঘাত লাগবে।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট কাকার ধারণায় প্রভাবিত ছিলেন বলে অনেকের ধারণা। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘অবর্ণনীয় দুঃখ আর অনির্বচনীয় আনন্দের ঠিক মাঝখানে বাঙালি চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিগতভাবে এখানেই তার অনন্যতা, এখানেই তার অমরত্ব। এই কোজাগরী পূর্ণতার মধ্যেই সে তার মৃণ্ময়ী জননীর মুখ দেখাতে পায়। ক্ষুদ্রতায় ঘেরা তার গৃহকোণ তখন জীবনলীলা গৃহাঙ্গন হয়ে ওঠে। জগজ্জননী বসুন্ধরা হয়ে ওঠেন বিশ্বরূপা; ভয়ংকরী আদ্যাশক্তি রূপান্তরিত হন শুভঙ্করীতে। এই জীবনপ্রতিমা থেকে জন্ম নেয় তার প্রতিমা। মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা।’

রবীন্দ্রসাহিত্যে তাই দুর্গাপূজা অবলীলায় স্থান করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তর্বেদনা আছে—মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেই জন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বারংবার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান।’

রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপূজা ও দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণকারীদের গভীর সমতার চোখে দেখেছেন। এভাবে তাঁর কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে দুর্গোৎসব প্রাসঙ্গিক হয়ে স্থান নিয়েছে। বড় উৎসবে ছোট মানুষের অংশগ্রহণের বিড়ম্বনা ও কষ্ট রবীন্দ্রনাথ চিত্রিত করেছেন তাঁর লেখায়। অমন বড় মাপের লেখককেও ব্যস্ত রেখেছে দুর্গাপূজা। এখানেই দুর্গাপূজার সার্থকতা।

ডা.

প্রমিত অনন্য চক্রবর্তী ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন দ রন থ ঠ ক র ব ন দ রন থ র দ ব ন দ রন থ আম দ র করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

রবীন্দ্রসরোবরে সুরে–ছন্দে জমজমাট নবান্ন উৎসব

অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নবান্ন উৎসব হলো রাজধানীতে। নাচ, গান, আবৃত্তি, আলোচনায় রোববার ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে উদ্‌যাপন করা হলো ঋতুভিত্তিক এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব।

হেমন্তের বেলা শেষে ষড়ঋতু উদ্‌যাপন জাতীয় পর্ষদ আয়োজিত নবান্ন উৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এরপর ছিল ফারহানা করিমের নেতৃত্বে সমবেত নৃত্য।

নবান্নকথনে অংশ নেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি এহসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আবহমানকাল থেকে আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে অগ্রহায়ণে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠে। নতুন ধান তাঁদের জীবনে নিয়ে আসে সচ্ছলতা। নিয়ে আসে আনন্দ। তবে নবান্ন কেবল ফসলের আনন্দই নয়, আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি শক্তিশালী উপাদান। নাগরিক পরিবেশে ঋতুভিত্তিক এই উৎসবকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বসন্ত, বর্ষা, শরৎসহ ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো আয়োজন করা হবে।’

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ ও মঞ্চের চারপাশের স্থান বর্ণাঢ্যভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। এর সঙ্গে ছিল ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলির স্টল।

আলোচনার পরে শুরু হয় গানের পালা। সাগর বাউল শুরু করেছিলেন ভবা পাগলার গান ‘বারে বারে আসা হবে না’ গেয়ে। এরপর তিনি পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘লোকে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে’ এবং রাধারমণ দত্তের গান ‘অবলারে কান্দাইয়া’। ঢোল, একতারার বাজনা, বাঁশির সুর আর লোকসাধকদের এসব মরমি গানে গানে সাগর বাউল শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন।

অনুষ্ঠানে নজরুলসংগীত পরিবেশনের কথা ছিল শিল্পী ফেরদৌস আরার। তবে তিনি অসুস্থতার জন্য সংগীত পরিবেশন করতে পারেননি। এই চমৎকার অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ ও শ্রোতাদের শুভেচ্ছা জানান।

লোকশিল্পী আলেয়া বেগম পরিবেশন করেন ‘মালা কার লাগিয়া গাঁথি’সহ বেশ কয়েকটি গান। গানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল আবৃত্তি ও কবিদের কবিতা পাঠ। এই পর্বে অংশ নেন কবি রাসেল রায়হান, রিক্তা রিনি, সানাউল্লাহ সাগর, জব্বার আল নাইম, ইসমত শিল্পীসহ অনেকে।

সংগীতশিল্পীদের মধ্যে কোহিনূর আক্তার পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘তিন পাগলের হইল মেলা’। ডলি মণ্ডল পরিবেশন করেন ‘সব লোক কয় লালন কী জাত সংসারে’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ষড়ঋতু উদ্‌যাপন জাতীয় পর্ষদের সদস্যসচিব দীপান্ত রায়হান।

শীতের মৃদু পরশ লেগেছে রাজধানীর হাওয়ায়। হালকা কুয়াশাও জমছে আকাশে। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে সুরে-ছন্দে বেশ খানিকটা রাত অবধি জমজমাট হয়ে উঠেছিল এই নাগরিক নবান্ন উৎসব।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জানা গেল রাজামৌলির ছবির নাম, থাকছেন মহেশ বাবু-প্রিয়াঙ্কা
  • দেশের প্রথম নারী এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদারের জয়ের গল্প আসছে
  • নানা আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আদি নববর্ষ’ উদ্‌যাপন
  • মুগ্ধ করল নবান্ন উৎসবে ধান কাটার প্রতিযোগিতা
  • রবীন্দ্রসরোবরে সুরে–ছন্দে জমজমাট নবান্ন উৎসব
  • নবান্নের পিঠায় সুবাসিত রাবি
  • ঘূর্ণির জাদুতে বিশ্বজয় 
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারুণ্যের উৎসব রোববার
  • পয়লা অগ্রহায়ণে ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন করবে ডাকসু
  • দিনভর আনন্দ আয়োজনে সাফল্য উদ্‌যাপন