এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন
Published: 1st, October 2025 GMT
জিটিওর মেহদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া, শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচন আয়োজনে কেন দেড় বছর সময় লাগছে, তার ব্যাখ্যা এই সাক্ষাৎকারে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সাক্ষাৎকারের এই অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রশ্নোত্তর আকারে হুবহু তুলে ধরা হলো।
মেহদি হাসান: আপনার অন্তর্বর্তী সরকার এখন এক বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। আপনি বলেছেন যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি আরও পরে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আপনি এটিকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে এনেছেন। কিন্তু.
অধ্যাপক ইউনূস: ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। রমজানের কারণে।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে যা বলেছেন অধ্যাপক ইউনূস৪ ঘণ্টা আগেমেহদি হাসান: বুঝেছি। কিন্তু আপনি এই সাক্ষাৎকারের শুরুতে যেমন বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনই পদক্ষেপ চান—আগামীকাল নয়, ছয় মাস পরেও নয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি অনেক দেরি। নির্বাচনের জন্য আরও ছয় মাস অপেক্ষা করাটা অনেক দীর্ঘ সময়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ছেন। আমরা কেন আগে নির্বাচন করতে পারছি না? নেপালে, যেখানে এই বছরে কিছুদিন আগে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, সেখানকার অন্তর্বর্তী নেতা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের একটি নির্বাচনের জন্য কেন ১৮ মাস লাগছে বা লাগবে?
অধ্যাপক ইউনূস: অবশ্যই, আপনি বললেন, মানুষ বলছে অনেক সময় লাগছে। এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। সুতরাং মানুষ সব ধরনের কথা বলছে। আপনি থাকুন, নির্বাচন কেন? কার নির্বাচন দরকার?
মেহদি হাসান: ঠিক আছে, কিন্তু তাঁরা সেই লোক, যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরা বলছেন, আমরা কেন আরও দ্রুত নির্বাচন করতে পারিনি? দেরি কেন হচ্ছে?
অধ্যাপক ইউনূস: তারা যখন এ কথা বলে, তখন এটা গণতন্ত্রের বিষয় নয়। তারা কথা বলে সুশাসন নিয়ে। আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা দেখতে চাই, তাই আপনি থাকুন। কারণ, আমরা নির্বাচনের পর আবার বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়তে চাই না। আমি যা বলতে চাই, তা হলো আপনি একটি বক্তব্য তুলে ধরেছেন, অন্য বক্তব্যও আছে। কোন বক্তব্যটি বেশি শক্তিশালী...।
আরও পড়ুনহিন্দুদের ওপর সহিংসতা বাড়েনি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে: প্রধান উপদেষ্টা১ ঘণ্টা আগেমেহদি হাসান: কিন্তু আপনি কি আজ আমাদের দর্শকদের বলতে চান, নির্বাচনে যেতে এত সময় লাগার কারণ কী?
অধ্যাপক ইউনূস: হ্যাঁ, আপনি নেপালের উদাহরণ দিয়েছেন। নেপালের সরকার আমাদের পরিভাষায় একধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অর্থাৎ আপনার দায়িত্ব একটি নির্বাচন আয়োজন করা। তাই সম্ভবত এটাই তাদের কাজ।
মেহদি হাসান: আপনারা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নন?
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা নই। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার।
মেহদি হাসান: ঠিক আছে।
অধ্যাপক ইউনূস: আমাদের কত দিন থাকতে হবে, তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি।
মেহদি হাসান: ঠিক আছে।
অধ্যাপক ইউনূস: আমরা কত দিন থাকব, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের বোঝাপড়া আছে যে আমাদের তিনটি কাজ রয়েছে। একটি হলো সংস্কার, আরেকটি বিচার ও শেষটি হলো নির্বাচন।
মেহদি হাসান: ঠিক আছে।
অধ্যাপক ইউনূস: তাই আমরা সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছি। এটি একটি বড় এজেন্ডা।
মেহদি হাসান: হ্যাঁ।
অধ্যাপক ইউনূস: কারণ, আপনি যদি শুধু একটি নির্বাচন করেন, তবে সেই পুরোনো জিনিসগুলো আবার ঘটবে। ভিন্ন নামে, ভিন্ন চিত্রে, আরও অনেকভাবে। আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। আপনি যদি শুধু নির্বাচন করেন, তবে সবকিছুর একই পুনরাবৃত্তি হবে। কারণ, আইন, নিয়ম, পদ্ধতি একই থেকে যাবে।
মেহদি হাসান: হ্যাঁ।
অধ্যাপক ইউনূস: তাই ছাত্রদের নেতৃত্বে জনগণের একটি দাবি ছিল সংস্কার করা। নিশ্চিত করা যে সব শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে, যাতে আপনার একটি ভিন্ন ধরনের কাঠামো থাকে, যেন এই জিনিসগুলো ফিরে আসতে না পারে। ফ্যাসিবাদ যেসব পথে প্রবেশ করে, সেই পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া, যাতে তারা আর আসতে না পারে। তাই এটি আমাদের এজেন্ডা। এটি একটি বড় এজেন্ডা। তারপর বিচার। সব ঘটনার জন্য দোষী সব ব্যক্তির বিচার, যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই ওই বিচার করার জন্য আমাদের একটি বিশেষ আদালত স্থাপন করতে হবে এবং যে ফলাফল আসে, তা দেখাতে হবে। আদালতব্যবস্থা থেকে দৃশ্যমান ফলাফল আসতে হবে যে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয়টি হলো নির্বাচন। তাই আমাদের এই তিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, শুধু একটি নয়। নেপালে তারা শুধু নির্বাচন করছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বছর থ ক ন র জন য বল ছ ন আম দ র র একট আপন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।
প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।
প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।
অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।
সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়