মণ্ডপের প্রতিমার আগেই চোখে পড়ছে পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা নির্যাতিত এক নারীর ছবি। তাঁর আঁচল ছড়িয়ে পড়েছে নিচের সিঁড়িতে। তার একপাশে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য। অপর পাশে ইভ টিজিং আর শিশু ধর্ষণের শিকার আতঙ্কিত নারীমুখের ছবি।

নিচের অংশে মাঝখানে স্থাপন করা হয়েছে প্রতিমা। তার বাঁ পাশে দেওয়া হয়েছে ভ্রূণহত্যা নিয়ে কন্যাশিশুর আবেগপূর্ণ কিছু কথা। আর ডান পাশে রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে যন্ত্রণাকাতর এক মায়ের প্রতিকৃতি।

সব মিলিয়ে রাজশাহী শহরের মালোপাড়ার শ্রীশ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ দেব বিগ্রহ ঠাকুর মন্দির যেন এবার নারী নির্যাতনবিরোধী চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে আকুতি জানানো হচ্ছে নারীর অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষার।

গত সোমবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা গেল, নির্যাতিত নারীর ছবির বাঁ পাশে বড় হরফে লেখা হয়েছে, ‘সুনিশ্চিত হোক নারীর নিরাপত্তা, থেমে না যাক তাদের স্বপ্নযাত্রা।’ ডান পাশে লেখা রয়েছে, ‘গ্রাম থেকে শহর—প্রতিটি পথে, নিরাপদ চলুক নারী দিন-রাতে।’

প্যান্ডেলে বিভিন্ন শিরোনামে সাজানো হয়েছে নারীর জীবনচক্রের অধ্যায়গুলো। কন্যাভ্রূণের অস্তিত্বের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও তার নীরব যন্ত্রণাগুলো কবিতায় বলা হয়েছে, ‘আসতে দাও পৃথিবীতে, করছ কেন খুন? আমার দোষ কি শুধু আমি কন্যাভ্রূণ? আমার থেকেই নতুন জীবন, সৃষ্টি মানে আমি। আমি যদি খুন হয়ে যাই, কীভাবে আসবে তুমি?’

ইভ টিজিংয়ের ভীতিকর হুমকি, চারদেয়ালে বন্দী নারীর একাকিত্ব, সমাজের কুকথা থেকে নারীর কষ্টের ছবির পাশে লেখা হয়েছে, ‘লালসায় উত্তপ্ত চোখ, শিশু ধর্ষণ বন্ধ হোক।’ অন্যায়ের অন্ধকারে মেয়েদের মনের অনুভূতি নিয়ে বলা হয়েছে, ‘বেরোতে পারি না একা, এ সমাজ নষ্ট মানুষের মুখোশে ঢাকা।’ সংগ্রামী নারীর সমাজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী আকুতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘ফিনফিনে কাপড়ের ভাঁজে খুঁজে ফেরো নারী। কখনো মানুষ ভেবে সুযোগ দিয়ো! দেখবে, আমরাও পারি।’

শেষ চরণে প্যান্ডেলটি বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্ক নারীর উপেক্ষা ও ত্যাগের গল্প তুলে ধরে একটি নান্দনিক, অথচ করুণ মনোভাবের কথা জানান দিয়েছে এভাবে—
‘দশ মাস দশ দিন যন্ত্রণার ফল কি আজ বৃদ্ধাশ্রম!’
‘মা সেদিনও কেঁদেছিল, ছেলে ভাত খায় না বলে,
আর আজ কাঁদে, ছেলে ভাত দেয় না বলে।’
‘এক মাকে পুজো করো, আরেক মাকে ঘর থেকে বের করো?’
বৃদ্ধাশ্রমের মায়ের ছবির পাশে নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের একটি চরণ লেখা হয়েছে, ‘ছেলে আমার মস্ত বড়, মস্ত অফিসার.

..।’

দেবীমূর্তির প্রতিচ্ছবিতে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর শান্ত সৌন্দর্যের সঙ্গে চণ্ডীর শক্তির রূপও ফুটেছে। প্যান্ডেলে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পৌরাণিক দৃশ্যটি তুলে আনা হয়েছে, যার মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর নিজস্ব প্রতিরোধ ও দেবীশক্তির আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে।

মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুনন্দন দাসের মতে, ‘আমরা চাই, মানুষ দেবীর পূজার আনন্দ উপভোগের সঙ্গে নারীর অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ভাবুক।’ সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী পাপন চন্দ্র রায়ের ভাষ্য, ‘দুর্গোৎসব শুধু উৎসবই নয়, এটি হোক সচেতনার এক মঞ্চ। এ থিমের উদ্দেশ্য কোনো প্রতিবাদ নয়, বরং উৎসবের মধ্যে নারীদের সংগ্রামী জীবন ফুটিয়ে তোলা। সে উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই আমাদের ক্ষুদ্র বাজেটের এই থিম।’

উৎসব শুধু আনন্দের নয়, সচেতনতার মঞ্চও হতে পারে। আয়োজকেরা দেখিয়েছেন, পূজার মঞ্চকে ব্যবহার করে সমাজে ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।বিভা সাহা, দর্শনার্থী

কথা হয় কোষাধ্যক্ষ রতন পালের সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘আশা করি, এই থিম সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার কথা জাগিয়ে তুলবে এবং বাস্তব জীবনে আরও ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে।’

উপস্থিত দর্শনার্থীরা সবাই দাঁড়িয়ে মণ্ডপের দেওয়ালের ছবিগুলোর পাশের সচেতনতামূলক লেখাগুলো মন দিয়ে পড়ছিলেন। দর্শনার্থী বিভা সাহা জানান, সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক দিক হলো, আয়োজন সাদামাটা হলেও প্যান্ডেলটির বার্তা অনেক বড়। এর সরল উপস্থাপনা দর্শনার্থীদের মনে ধরেছে। তিনি বলেন, ‘আর কোনো মণ্ডপেই এত সময় দিইনি। উৎসব শুধু আনন্দের নয়, সচেতনতার মঞ্চও হতে পারে। আয়োজকেরা দেখিয়েছেন, পূজার মঞ্চকে ব্যবহার করে সমাজে ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।’

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

রবীন্দ্রসরোবরে সুরে–ছন্দে জমজমাট নবান্ন উৎসব

অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে নবান্ন উৎসব হলো রাজধানীতে। নাচ, গান, আবৃত্তি, আলোচনায় রোববার ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে উদ্‌যাপন করা হলো ঋতুভিত্তিক এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব।

হেমন্তের বেলা শেষে ষড়ঋতু উদ্‌যাপন জাতীয় পর্ষদ আয়োজিত নবান্ন উৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এরপর ছিল ফারহানা করিমের নেতৃত্বে সমবেত নৃত্য।

নবান্নকথনে অংশ নেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি এহসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আবহমানকাল থেকে আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে অগ্রহায়ণে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠে। নতুন ধান তাঁদের জীবনে নিয়ে আসে সচ্ছলতা। নিয়ে আসে আনন্দ। তবে নবান্ন কেবল ফসলের আনন্দই নয়, আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি শক্তিশালী উপাদান। নাগরিক পরিবেশে ঋতুভিত্তিক এই উৎসবকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বসন্ত, বর্ষা, শরৎসহ ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো আয়োজন করা হবে।’

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ ও মঞ্চের চারপাশের স্থান বর্ণাঢ্যভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। এর সঙ্গে ছিল ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলির স্টল।

আলোচনার পরে শুরু হয় গানের পালা। সাগর বাউল শুরু করেছিলেন ভবা পাগলার গান ‘বারে বারে আসা হবে না’ গেয়ে। এরপর তিনি পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘লোকে বলে লালন ফকির কোন জাতের ছেলে’ এবং রাধারমণ দত্তের গান ‘অবলারে কান্দাইয়া’। ঢোল, একতারার বাজনা, বাঁশির সুর আর লোকসাধকদের এসব মরমি গানে গানে সাগর বাউল শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন।

অনুষ্ঠানে নজরুলসংগীত পরিবেশনের কথা ছিল শিল্পী ফেরদৌস আরার। তবে তিনি অসুস্থতার জন্য সংগীত পরিবেশন করতে পারেননি। এই চমৎকার অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ ও শ্রোতাদের শুভেচ্ছা জানান।

লোকশিল্পী আলেয়া বেগম পরিবেশন করেন ‘মালা কার লাগিয়া গাঁথি’সহ বেশ কয়েকটি গান। গানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল আবৃত্তি ও কবিদের কবিতা পাঠ। এই পর্বে অংশ নেন কবি রাসেল রায়হান, রিক্তা রিনি, সানাউল্লাহ সাগর, জব্বার আল নাইম, ইসমত শিল্পীসহ অনেকে।

সংগীতশিল্পীদের মধ্যে কোহিনূর আক্তার পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের গান ‘তিন পাগলের হইল মেলা’। ডলি মণ্ডল পরিবেশন করেন ‘সব লোক কয় লালন কী জাত সংসারে’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ষড়ঋতু উদ্‌যাপন জাতীয় পর্ষদের সদস্যসচিব দীপান্ত রায়হান।

শীতের মৃদু পরশ লেগেছে রাজধানীর হাওয়ায়। হালকা কুয়াশাও জমছে আকাশে। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে সুরে-ছন্দে বেশ খানিকটা রাত অবধি জমজমাট হয়ে উঠেছিল এই নাগরিক নবান্ন উৎসব।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জানা গেল রাজামৌলির ছবির নাম, থাকছেন মহেশ বাবু-প্রিয়াঙ্কা
  • দেশের প্রথম নারী এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদারের জয়ের গল্প আসছে
  • নানা আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আদি নববর্ষ’ উদ্‌যাপন
  • মুগ্ধ করল নবান্ন উৎসবে ধান কাটার প্রতিযোগিতা
  • রবীন্দ্রসরোবরে সুরে–ছন্দে জমজমাট নবান্ন উৎসব
  • নবান্নের পিঠায় সুবাসিত রাবি
  • ঘূর্ণির জাদুতে বিশ্বজয় 
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারুণ্যের উৎসব রোববার
  • পয়লা অগ্রহায়ণে ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন করবে ডাকসু
  • দিনভর আনন্দ আয়োজনে সাফল্য উদ্‌যাপন