সরকার পতন হলেও ব্যবস্থা বদলায়নি
Published: 10th, January 2025 GMT
সারা দেশে এখন একটা হতাশা ও বিষণ্নতা বিরাজ করছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। গত ৫ আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে মস্ত বড় ঘটনা মনে করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি
বলেন, ‘কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে যে এটা একটা সরকারের পতন মাত্র, ব্যবস্থার পতন নয়। ব্যবস্থা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে এবং সে জন্য দেশে একটা হতাশা বিরাজ করছে, একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে।’
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর ২৯তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে দশম জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা বলেন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্র বারবার বদল করেছি। বড় রাষ্ট্রকে ছোট রাষ্ট্র করেছি, কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। বলা হয়েছিল যে বিপ্লব ঘটেছে। বিপ্লব তো দেখা যাচ্ছে না। একটা সরকারের পতন হয়েছে মাত্র, ব্যবস্থা তো সব আগের মতোই রয়েছে।’
১৪২ মাস পার হলেও ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ দেশে তরুণ এবং তারুণ্য নিরাপদে নেই। প্রমাণিত হয় যে এ দেশের বিচারব্যবস্থা এমন, যেখানে অপরাধীদের শাস্তি হয় না এবং অপরাধীরা ক্ষমতায় থাকে এবং নিশ্চিতে বিরাজ করতে থাকে সমাজের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল বিচার চাই না। যে সমাজ বিচার করে না, যে সমাজ নিরাপত্তা দেয় না, যে সমাজ ত্বকীদের হত্যা করে, সেই সমাজকেই পরিবর্তন করতে হবে।’
ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও একসময় কিশোর আন্দোলন ছিল উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, এখন কিশোর আন্দোলন নেই। ত্বকীর মতো বই পড়া, আন্দোলনে যাওয়া, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা তরুণেরা প্রাণ হারাচ্ছেন। অথবা জীবন্ত থেকেও টিকে আছে কোনোমতে। সেই ব্যবস্থাকে বদল করার জন্য তরুণদের সংগঠিত করা দরকার। সারা দেশে এখন একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি করা দরকার।
প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নিত্বকীর মতো অসংখ্য হত্যাকাণ্ড এবং তার সঙ্গে লুণ্ঠন, সম্পদ পাচার, মানুষের ওপর অত্যাচার—এসব মিলে যে ক্ষোভ জমেছিল, তারই প্রকাশ দেখা গেছে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে। এ কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পরে স্বাভাবিকভাবেই সবার প্রত্যাশা যে এগুলোর বিচার করতে হবে। সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। বিচারকাজ সন্তোষজনকভাবে অগ্রসর হয়েছে, এটাও বলা যায় না।
স্বৈরশাসনের পতন হলেও খুনিদের পৃষ্ঠপোষকদের বিদায় হওয়ার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ক্ষমতাশালী দল কিংবা পুলিশ এখনো মামলা ও আটক–বাণিজ্য করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বৈরশাসনের পতনের পর এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার কথা নয়, কিন্তু সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তিনি এর নিন্দা জানান।
আমরা রাষ্ট্র বারবার বদল করেছি। বড় রাষ্ট্রকে ছোট রাষ্ট্র করেছি, কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি।অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীস্বৈরশাসন সময়কার বড় অপরাধীদের কয়েকজন বাদে সবাই বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় পালিয়ে গেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যেমন সরকারের দায়িত্ব, ঠিক সেভাবে যারা অপরাধী নন তাঁদের হয়রানি না করাটাও সরকারের দায়িত্ব। যাঁরা অপরাধী নন, তাঁদের হয়রানি করাটাও একটা অপরাধ।
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের এখনো দরকার আছে বলে মনে করেন আনু মুহাম্মদ। কারণ, এখনো সন্ত্রাস চলছে। মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষকে অত্যাচার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ। খুন কমছে না।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি। স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই জনগণের পক্ষে ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর ফলে জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে না। রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই পরিবর্তনের জন্য নতুন রাজনীতির প্রয়োজন।
নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায় অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। বিজয়ীদের মধ্যে কথা বলেন অশেষ লস্কর ও দেবাশ্রীতা পাল।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রকাশ্যে গুলি ছোড়েন কিশোর গ্যাং নেতা, রয়েছে নিজস্ব টর্চার সেল
চুরি, ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধে হাতেখড়ি। এরপর জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারে। আধিপত্য বজায় রাখতে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। নামের সঙ্গে যুক্ত হয় কিশোর গ্যাং নেতা। পুলিশের খাতায় তোলেন নাম। ছিনতাই, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, মাদকের ২০টি মামলাও হয় তাঁর বিরুদ্ধে। চাঁদা আদায় ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে কথায় কথায় প্রকাশ্যে ছোড়েন গুলি। রয়েছে ‘টর্চার সেল’ও। চট্টগ্রামের আলোচিত এই ‘সন্ত্রাসীর’ নাম শহীদুল ইসলাম। এলাকার মানুষ ও পুলিশের কাছে তিনি পরিচিত বুইস্যা নামে।
চট্টগ্রাম নগরের আলোচিত ‘সন্ত্রাসী’ শহীদুল ওরফে বুইস্যা চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকার মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম। পুলিশ বলছে, মাদক বিক্রি ও চাঁদাবাজির টাকা দ্রুত গুনতে তাঁর রয়েছে টাকা গণনার যন্ত্র। তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর কথা বলছে পুলিশ। ইতিমধ্যে তাঁর কিছু সহযোগী গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
শহীদুল ইসলাম বুইস্যা ও তাঁর বাহিনীর লোকজন চাঁদা না পেলেই গুলি ছোড়েন। এই কারণে চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর বুইস্যার সহযোগী মুন্না পাঁচলাইশ বাদুরতলা এলাকায় একটি গ্যারেজের সামনে গুলি ছোড়েন। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিজয় চৌধুরীর গ্যারেজের সামনে এসে হুমকি দিতে থাকেন মুন্না। একপর্যায়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করেন। তবে এ ঘটনায় কেউ আহত হননি। পরবর্তী সময়ে গ্যারেজ মালিকসহ আশপাশের লোকজন ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করলে মুন্না পালিয়ে যান।কে এই বুইস্যাভোলার দৌলতখান থানা সদরের মোহাম্মদ আলীর ছেলে শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা। চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম ষোলোশহর এলাকায় থাকেন তিনি। পড়াশোনা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কোনো রকমে নিজের নামটি লিখতে পারেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে দলবল নিয়ে যোগদান করতেন তিনি। সেসবের ছবি, ভিডিও রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নিজেকে পরিচয় দিতেন নিষিদ্ধ সংগঠন নগর ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে। তবে কোনো পদে ছিলেন না।
পুলিশ জানায়, শুরুতে চুরি, ছিনতাই করতেন। গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে জটলা পাকিয়ে লোকজনের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতেন। পরে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি করে আসছেন।
গত বছরের মার্চে নগর পুলিশের করা এক জরিপে উঠে আসে, চট্টগ্রাম নগরে সক্রিয় প্রায় ২০০ কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ৪০০ জনের মতো। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত। তাঁদের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় ৬৪ ‘বড় ভাই’ থাকার কথা সেই জরিপে উঠে আসে। তালিকায় শহীদুল ওরফে বুইস্যার নামও রয়েছে।
অস্ত্রসহ ধরা পড়া সন্ত্রাসী শহীদুলের সহযোগীরা