ইরান এবার বড় যুদ্ধের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হচ্ছে
Published: 6th, July 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যে অস্বস্তিকর যুদ্ধবিরতি হয়েছে, তাতে ১২ দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার অবসান ঘটেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সংঘাতে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করেছেন। একুশ শতকের স্বল্প স্থায়ী একটি যুদ্ধ হিসেবে এটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
ইরানও এই যুদ্ধে বিজয় দাবি করেছে। ১৯৮০-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষে যেমন করে ইরান বিজয় দাবি করেছিল, এবারের ঘটনাটি অনেকটাই তার সঙ্গে মিলে যায়। সেই যুদ্ধ ছিল বিশ শতকের অন্যতম দীর্ঘ প্রথাগত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও বিজয় দাবি করেছিলেন।
দুটি ক্ষেত্রেই ইরান আক্রান্ত হয়েছে। ইরানের শাসকেরা দুটি সংঘাতকেই ‘আরোপিত যুদ্ধ’ বলে চিত্রিত করেছেন এবং দাবি করেছেন এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবুজ সংকেত’ ছিল।
দুটি ক্ষেত্রেই ইরান তাদের বিজয় ঘোষণার ক্ষেত্রে কৌশলগত ধৈর্য (সব্র-ই রাহবর্দি) প্রদর্শনের নীতি নিয়েছে। অর্থাৎ সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্যকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার নীতি অবলম্বন করেছে ইরান।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর, ইরান অপেক্ষা করে ছিল। সময় ও পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরান নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রই ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দামের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করেছিল। এরপর ২০০৩ সালে তাঁকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
তেহরানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে আজকেও তারা সেই একই কৌশলগত ধৈর্যের নীতি প্রয়োগ করছে।
বর্তমান যুদ্ধবিরতিকে প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছে ইরান। কিন্তু দেশটির শাসকেরা বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামরিক মহল এটিকে একটি কৌশলগত যুদ্ধবিরতি হিসেবে দেখছেন। তাঁরা এটাকে টেকসই শান্তি হিসেবে দেখছেন না।
ইরানের জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে এই যুদ্ধবিরতি একটি স্পষ্ট কৌশলগত উদ্দেশ্য বহন করছে।
এই কৌশলগত ঘাটতি পূরণে, ইরান এখন জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও সু-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের উদ্যোগ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান নেওয়ার বিষয়টিকেও ইরান এখন বিবেচনা করবে। কেননা, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় চীনের যুদ্ধবিমান সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।ইরানের এই কৌশলগত ধৈর্যের নীতিতে সময়কে একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরান এখন সময়কে পারমাণবিক কৌশল পুনর্মূল্যায়নের, আঞ্চলিক জোট সম্প্রসারণের এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের দৃঢ়তার সীমা পরীক্ষার উপায় হিসেবে গ্রহণ করবে।
এই সময়ে ইরানের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে আবার পর্যালোচনা করবেন। বিশেষ করে নৌবাহিনীর সক্ষমতা এবং সাইবার অপারেশনের সক্ষমতার মতো বিষয়গুলো তাঁরা আবারও মূল্যায়ন করবেন। আর এসব কিছুর লক্ষ্য হচ্ছে, একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা।
সময়, তেহরানের সামনে তিনটি জায়গায় নতুন করে চিন্তাভাবনা করার গুরুত্বপূর্ণ ফুরসত এনে দিয়েছে। প্রথমত, নেতৃত্ব পুনর্গঠন; দ্বিতীয়ত, অস্ত্রভান্ডার পূর্ণ করা এবং তৃতীয়ত, একটি আন্তর্জাতিক পরিসরে কূটনৈতিক আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা।
১৯৮১ সালের জুন মাসে ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টির কার্যালয়ে বোমা হামলা করা হয়। এতে দলটির মহাসচিব মোহাম্মদ বেহেশতিসহ ৭৪ জন উচ্চপদস্থ কর্তা নিহত হন। ওই একই মাসে, ইরান ইরাক সীমান্তে এক লড়াইয়ে দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার মোস্তাফা চামরান নিহত হন।
১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-আলি রাজাই এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ-জাভাদ বাহোনার তেহরানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বোমা হামলায় নিহত হন।
এই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল মুজাহিদিন-ই-খালক নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী। বিরোধী এই গোষ্ঠী ইসলামিক রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলেছিল।
বোমাটি স্থাপন করেছিল মাসউদ কেশমিরি। তিনি ছিলেন মুজাহিদিন-ই-খালকের সদস্য। নিরাপত্তা কর্মকর্তার ছদ্মবেশে তিনি সরকারে অনুপ্রবেশ করেছিল। বিস্ফোরণে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় পুলিশের প্রধান, জ্যেষ্ঠ সামরিক উপদেষ্টা এবং সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যসহ আটজন পদস্থ কর্তা নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শুরুর বছরে এটি ছিল ভয়ানক একটি নাশকতা।
এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরেও ইরান পাল্টা আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানের ভূখণ্ড থেকে ইরাকের সমস্ত সেনাকে বিতাড়িত করেছিল।
গত ১৩ জুন ভোররাতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান শুরু করে।
এই হামলা শুধু পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল ইসরায়েল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কমান্ডার হোসেইন সালামি, এবং অ্যারোস্পেস প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহ। বেশ কয়েকজন পারমাণুবিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাকেও হত্যা করেছিল ইসরায়েল।
এরপরও ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে সক্ষম হয়। ইসরায়েলের বহুল প্রশংসিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে চরম চাপের মুখে ফেলে দেয়। এই যুদ্ধে ইরানের স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কমেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শান্তির এই নতুন পর্যায়ে, ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার পূর্ণ করা এবং আধুনিকায়নে অগ্রাধিকার দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ফাত্তাহ ও খাইবার শেকানের মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের যেকোনো আকস্মিক হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে ইরান এখন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও জোরদার করবে।
সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধ থেকে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে, একটি আধুনিক যুদ্ধে একটি সক্ষম ও উন্নত বিমানবাহিনী ছাড়া বিজয় অর্জন সম্ভব নয়।
যদিও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনভিত্তিক প্রতিরোধব্যবস্থা কিছুটা কৌশলগত শক্তি দেখিয়েছে। কিন্তু এর বড় ধরনের দুর্বলতাও উন্মোচিত হয়েছে। আধুনিক বিমান ও বৈদ্যুতিন যুদ্ধের সক্ষমতা আছে, এমন শক্তির বিরুদ্ধে শুধু এই ব্যবস্থা সেভাবে কাজ করে না।
এই কৌশলগত ঘাটতি পূরণে, ইরান এখন জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও সু-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের উদ্যোগ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান নেওয়ার বিষয়টিকেও ইরান এখন বিবেচনা করবে। কেননা, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় চীনের যুদ্ধবিমান সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
এ ছাড়া ইরানের সামরিকবিদেরা আরেকটি বড় ঘাটতিকে চিহ্নিত করেছেন। সেটা হলো, এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম বা আকাশপথে কোনো আক্রমণ হলে আগেভাগেই সতর্ক করার প্রযুক্তি না থাকা।
সবচেয়ে উন্নত ভূমিভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতাও মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ছাড়া। এ কারণে তেহরান এখন চীন বা রাশিয়া থেকে এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম সংগ্রহে অগ্রাধিকার দেবে।
এর বাইরেও ইরান এখন কূটনৈতিক ও আইনি পাল্টা আক্রমণ শাসানোর ভূমি প্রস্তুত করবে।
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
মোহাম্মদ ইসলামি, পর্তুগালের মিনহো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
ইব্রাহিম আল-মারাশি, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মারকোসের মধ্যপ্রাচ্য ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র এই য দ ধ ম হ ম মদ ক শলগত কর ছ ন ত কর ছ ত হয় ছ কর ছ ল ক ষমত র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে হুমকির মুখে পড়ল ইসরায়েল
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের সাম্প্রতিক হামলাগুলো কেবল সামরিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রূপ নিয়েছিল কৌশলগত আক্রমণে।
এর লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভিত্তি অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবকাঠামোগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া। প্রতিশোধমূলক আক্রমণ দিয়ে শুরু হলেও এটি বহুমাত্রিক আক্রমণ অভিযানে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষতি করাই এর লক্ষ্য ছিল না, বরং ইসরায়েলের যুদ্ধ-অর্থনীতির আর্থিক ও লজিস্টিক কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল।
ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ফর ইসরায়েলের (ইসরায়েলি বন্ডস নামে পরিচিত) প্রধান নির্বাহী দানি নাভেহের বাড়ি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি সে কারণে মোটেই কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। নাভেহ শুধু ইসরায়েলের আমলাতন্ত্রের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব নন, দেশটির বৈশ্বিক বন্ড বিক্রি ব্যবস্থার একজন স্থপতিও।
২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে তাঁর নেতৃত্বে প্রবাসী ইহুদি এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৫ বিলিয়নের বেশি ডলারের মূলধন ইসরায়েলে এসেছে। এর মধ্যে ১.৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে। এই বন্ডগুলো যুদ্ধরত ইসরায়েলের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাভেহর বাড়িতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তেহরান মূলত ইসরায়েলের ঋণ সংগ্রহব্যবস্থার সবচেয়ে নাজুক জায়গাটিতে আঘাত করেছে। সেটি হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা।
আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েল যেভাবে ধরা খেল২৫ জুন ২০২৫এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারের প্রতি ইরান একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। সেটি হলো ইসরায়েলের কোনো অর্থনৈতিক বা আর্থিক কেন্দ্রই নিরাপদ নয়। এটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ের আক্রমণ নয়। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন আর্থিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টাও। একই সঙ্গে তেহরানের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল তেল আবিবের অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইফার কৌশলগত বন্দর ও তেল পরিশোধনাগার। ইসরায়েলের আর্থিক অবকাঠামো ক্ষতি করার এটা ইরানের পরিকল্পিত নীতি। জ্বালানি পরিশোধনাগারে সাইবার ও ক্ষেপণাস্ত্র—দুই ধরনের আক্রমণ করেই শিল্প ও বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে ইরান।
গাজা যুদ্ধের ব্যয়ের কারণে ইসরায়েল এরই মধ্যে চাপে আছে। এখন জ্বালানির উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইসরায়েলকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ইসরায়েলের অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছিল বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহন খাত থেকে। গত ২০ জুন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম কনটেইনার শিপিং কোম্পানি মের্কস ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে সব ধরনের জাহাজ ভেড়া স্থগিত করে দিয়েছিল।
হাইফা হলো ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি শিল্প যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কৌশলগত জিনিসপত্র আমদানির কেন্দ্র। এই বন্দর বন্ধ হলে ইসরায়েলি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দেশটিতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং পণ্য মজুতের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধের ঝুঁকির মুখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কোম্পানিটি। বাস্তবে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছিল। কোনো আনুষ্ঠানিক নৌ অবরোধ ঘোষিত না হলেও, এর প্রভাব ছিল কার্যত অবরোধের সমান। ইরানের আক্রমণের কারণে ইসরায়েলের বাণিজ্যে যে বিঘ্ন তৈরি হয়েছিল, সেটা লোহিত সাগরে হুতিদের অবরোধের কারণে সৃষ্ট সংকটের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বাব আল-মান্দাব শুধু কার্গোর রুট বদলে দিয়েছিল। মের্কসের হাইফা ত্যাগ নৌ–বাণিজ্যের সব পথই বন্ধ করে দিয়েছিল।
হাইফা হলো ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি শিল্প যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কৌশলগত জিনিসপত্র আমদানির কেন্দ্র। এই বন্দর বন্ধ হলে ইসরায়েলি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দেশটিতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং পণ্য মজুতের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হওয়ার পর মের্কস আবারও হাইফা বন্দর দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচলে রাজি হয়। তথাপি সংঘাতের সময় ইসরায়েলের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা অনেক বড়।
এর বিপরীতে, ইরান ন্যূনতম খরচ করে সর্বোচ্চ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র খাতে আনুমানিক ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি মূলত কৌশলগত বিনিয়োগ। এর বাইরে মুদ্রাবাজারে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রচলিত বাজারে তেল বিক্রির কূটনীতি এবং বিভিন্ন খাতে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইরান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে চলেছে। ইরান বহু বছর ধরেই নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মধ্যে বাস করছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে দশকের পর দশক টিকে থাকার সক্ষমতা দেশটি গড়ে তুলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঘাত ঘটতে থাকলে ইসরায়েলের অর্থনীতি ও রাজনীতি ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু ইরান এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেটা সংঘাতের মধ্যেও টিকে থাকবে। ইরানের কৌশলগত ধৈর্য কয়েক দশকের চাপের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এটা ইরানকে গভীর জাতীয় সংকল্প দিয়েছে। আর এটিই ইসরায়েলি রাষ্ট্রের যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য ও যুক্তিকে পরাভূত করার হুমকি তৈরি করছে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক সংকট শুধু ব্যয়ের কারণে নয়, বরং আস্থার সংকটে তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি মুদ্রার মান ধারাবাহিকভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে। বন্ডের সুদের হার বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঋণের মানেও অবনমন ঘটেছে।
শহরগুলোতে কাজের ঘণ্টা কমে যাওয়ায় সেই ধাক্কা উৎপাদনে এবং রাজস্ব আহরণে এসে লেগেছে। বেকারত্ব বেড়েছে। বেড়েছে জন–অসন্তোষ। অন্যদিকে সরকার মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়েছে, সামাজিক ব্যয় কাটছাঁট করেছে। দেশীয় উৎস থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নয়, এটি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থা।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ ব্যয় কমিয়ে সামরিক খাতে ব্যয়ের জোগান দেওয়া হচ্ছে। মানব পুঁজির ক্ষয় হচ্ছে। পুঁজি ও মানবসম্পদের দেশান্তর দ্রুততর হচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। অর্ধশতকের বেশি বছরের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল অস্ত্রের জন্য নয়, বরং নগদ অর্থের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আবেদন জানিয়েছে। এটি দেশটির অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার প্রতিচ্ছবি।
আহমেদ আলকারউত রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত